সারাদেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অবসরে যাওয়া ৩৩ হাজার শিক্ষক তাদের অবসর সুবিধার টাকা পাচ্ছেন না। আবেদন করেও তাদের কেউ তিন বছর, কেউ দুই বছরের বেশি সময় ধরে এককালীন এ টাকার অপেক্ষায় আছেন। টাকা না পেয়ে মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে অবসরে যাওয়া মানুষ গড়ার কারিগরদের। টাকা পেতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন অবসরে যাওয়া শিক্ষক-কর্মচারী ও তাদের স্বজনরা।
২০২০ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি পর্যন্ত অবসর সুবিধার টাকা পেতে ৩৩ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী আবেদন করেছেন। কিন্তু অর্থাভাবে এসব আবেদন নিষ্পত্তি করতে পারছে না বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড। ৩৩ হাজার আবেদনকারীর জন্য্র সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। অবসর সুবিধা বোর্ড বলছে, দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিলে সমস্যার কিছুটা সমাধান হবে।
এমন পরিস্থিতিতে অপেক্ষমান শিক্ষকদের অবসর সুবিধার টাকা দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আগামী অর্থবছরের বাজেটে হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে। গতকাল সোমবার মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা দৈনিক আমাদের বার্তাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। যদিও এ বরাদ্দ পেলে সব শিক্ষকের প্রাপ্য টাকা পরিশোধ করা যাবে কি না তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। সরকার এ খাতে বরাদ্দ দিলেও প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীকে টাকা দেয়া সম্ভব হবে না।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ ও আওতাধীন দপ্তর-সংস্থার মাসিক সমন্বয় সভায় ৩৩ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর দুর্দশা নিয়ে আলোচনা হয়। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান। যিনি পদাধিকার বলে অবসর সুবিধা বোর্ডের চেয়ারম্যানও।
সভার কার্যবিবরণী দৈনিক আমাদের বার্তার হাতে এসেছে। সেদিনের সভায় সচিব সোলেমান খান বিভিন্ন সংস্থার কাছে জরুরি কাজ সম্পর্কে জানতে চান। সভায় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অবসর সুবিধা বোর্ডের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি পর্যন্ত ৩৩ হাজার শিক্ষকের অবসর সুবিধার আবেদন পেন্ডিং আছে। যেগুলো নিষ্পত্তি করা অত্যন্ত জরুরি। এজন্য তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা প্রয়োজন। তবে দুই হাজার কোটি টাকা হলে এ সংকট কিছুটা সমাধান হবে। সেদিন সভায় এ বিষয়টি পরীক্ষা করার দায়িত্ব দেয়া হয় বিভাগের বাজেট শাখার উপসচিবকে।
মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের বাজেট শাখার উপসচিব মো. নূর-ই-আলম গতকাল সোমবার বিকেলে দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, আমরা হিসেব করে দেখেছি সব শিক্ষক-কর্মচারীর অবসর সুবিধার আবেদন নিষ্পত্তি করতে প্রয়োজন সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। এ সংকট সমাধানে আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছি অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে। এখন বাজেট পাস হলে বলা যাবে কতো টাকা সরকার এ খাতে দিচ্ছে।
জানা গেছে, বর্তমানে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অবসর সুবিধার টাকা তিন খাত থেকে দেয়া হয়। আগে এ টাকা মেটানো হতো শিক্ষকদের এমপিও থেকে কেটে রাখা টাকা এবং সরকারি বরাদ্দ বা অনুদান থেকে। আর নতুন করে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভর্তিতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১০০ টাকা করে আদায়। ভর্তির সময় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১০০ টাকা করে নিয়ে এর একটি অংশ থেকে শিক্ষকদের অবসর সুবিধা মেটানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
দৈনিক আমাদের বার্তার অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিও (বেতন-ভাতার সরকারি অংশ) থেকে প্রতি মাসে অবসর সুবিধা বোর্ডের জন্য কেটে রাখা হয় ৬৫ কোটি টাকারও বেশি। বছরে এ খাত থেকে ৭৮০ কোটি টাকার মতো সংগ্রহ করে অবসর সুবিধা বোর্ড। আর শিক্ষার্থীদের ভর্তি খাত থেকে ১২০ কোটি টাকা আসতে পারে। এর সঙ্গে সরকার চলতি অর্থবছরে এক হাজার কোটি টাকা অনুদান দিলে সংকট কিছুটা কাটবে। তবে, সব শিক্ষকের পাওনা মেটানো যাবে না। সরকার বাজেটে এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিলে তা দিয়ে অপেক্ষমান ২০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর পাওনা মেটানো সম্ভব হবে।
জানতে চাইলে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অবসর সুবিধা বোর্ডের সচিব অধ্যক্ষ শরীফ আহমদ সাদী দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, সরকারে কাছে আমরা বাজেটে এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছি। এ টাকা পেলে সংকট কিছুটা কাটবে। তিনি বলেন, ভর্তি খাত থেকে টাকা সংগ্রহ শুরু হলেও তার পুরোটা আমরা পাইনি। একাদশে ভর্তিতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেয়া ১৪ কোটি টাকা আমাদের দিয়েছে শিক্ষা বোর্ডগুলো। তবে, স্কুলের ভর্তির সময় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এ খাতে নেয়া প্রায় ১০০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে প্রতিষ্ঠানের ফান্ডে। যেগুলো এখনো আমাদের হাতে আসেনি। আর আমরা এমপিও থেকে কেটে রাখা কিছু টাকা পাই। সরকারি বরাদ্দ, ভর্তিতে এ খাতের টাকা ও এমপিও কেটে রাখা টাকা মিলিয়ে সংকট কিছুটা কাটানো সম্ভব। এ টাকা পেলে ১৫ থেকে ২০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর পাওনা মেটানো যাবে। আর এ বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবগত আছেন। শিগগিরই শিক্ষকদের সংকট কাটবে বলে আশা তার।
প্রসঙ্গত, এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকারি শিক্ষকদের মতো অবসর সুবিধা ও পেনশন পান না। তারা অবসরে গেলে এককালীন কয়েকলাখ টাকা পান । এর জন্য এমপিওভুক্ত হিসেবে পুরো চাকরিকালে বেতন থেকে ৬ শতাংশ হারে টাকা কেটে রাখা হয় অবসর সুবিধার জন্য।