এদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা বড় ধকলের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। কথাটা আপাতদৃষ্টিতে তিক্ত মনে হলেও বাস্তব সত্য নিরূপিত করার বিকল্প কোনো উপমা নেই। শিক্ষা বলতে যে অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা দ্বারা মানুষ তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক জীবনে ইতিবাচকভাবে নিজেকে আত্মপ্রকাশ ও খাপ খাইয়ে নিতে পারে। অর্থাত্ শিক্ষাকে সংজ্ঞায়নের মধ্যে নৈতিকতার কথা যেমন লিপিবদ্ধ করা আছে তদ্রূপ বাস্তব কর্মমুখী জীবনের জন্য আবশ্যক জ্ঞান ও দক্ষতার কথা বলা হয়েছে। এ বাস্তবমুখী জ্ঞান ও দক্ষতা দ্বারা একদিকে যেমন মানুষ শিল্প ও কল-কারখানার উত্পাদন ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটাবে, বিজ্ঞানে-আবিষ্কারে নিজেদের বলিষ্ঠ অবস্থানের ইঙ্গিত দিবে, জল-স্থল-আকাশপথে জয়সংগীত রচনা করবে তেমনি নৈতিকতার ধারালো কাস্তে দ্বারা অন্যায় ও অপকর্ম ছাঁটাই করবে। কাব্যে-কলায়, শিল্প-সাহিত্যে অমরত্বের কাব্য রচনা করবে। অর্থাত্ শিক্ষার দুই ইতিবাচক দিকই এক সুতায় যখন গ্রথিত হবে তখনই কেবল শিক্ষা সুশিক্ষায় রূপ নিবে, সত্যিকার শিক্ষিত মানুষ সমাজ বিনির্মাণে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করবে। এ শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষক এরিস্টটলের নৈতিকতা ও আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের সমন্বয় ঘটাবে। এভাবে শিক্ষার্থীর মানসে বাস্তবমুখী ও নৈতিকতার চেতনা একসঙ্গে বপন করা যাবে। তখন আর এরা সংকীর্ণ মনোভাবে নিজেদেরকে আবদ্ধ করে রাখবে না।
আলস্য, জড়তা বা নেতিবাচক কোনো মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিভ্রান্তির পথে পা বাড়াবে না। আমাদের দেশে জঙ্গিবাদে তরুণদের আসক্ত হবার মূল কারণ মূলত এটাই। জোর দিয়েই বলা চলে যে, এদেশে শিক্ষাব্যবস্থায় শতকরা ৭০% শিক্ষার্থীদের চিন্তা-চেতনা পরিপক্ব না বা তাদের সামগ্রিক সমাজ নিয়ে চিন্তা করার ইচ্ছাশক্তি নেই। তাই যার বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে জ্ঞান নেই, বিভিন্ন জাতির ইতিহাসে যে ধারে-কাছে যায় না সে অন্য ধর্মাবলম্বীর বা অনুসারীদের সহ্য করতে পারবে না এটাই স্বাভাবিক। তার জানার থলি শূন্য হওয়ায় সে তো জানেই না যে, অন্যের ধর্মের উপর আঘাত হানা পাপ। কোনো ধর্মকে হেয় প্রতিপন্ন করার অধিকার নেই বা কারো ধর্মীয় স্বাধীনতা হস্তক্ষেপ করা ঈশ্বরের কাছে যেমন পাপ তেমনি নৈতিকভাবেও সেটা নিষিদ্ধ। সম্প্রতি সময়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় তরুণ শিক্ষার্থীদের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতায় বিষয়টি অনুধাবনীয়। আর এ জঙ্গি মতাদর্শ থেকেই যে এক ধরনের সন্ত্রাসবাদ তৈরি হয় সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। হলি আর্টিজানে সংঘটিত ঘটনা শুধু দেশে নয় বিদেশি মহলে সন্ত্রাসবাদের জোরালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আর এ ঘটনায় একঝাঁক তরুণের সংশ্লিষ্টতা ছিল। তারা একসময় নিশ্চয় শিক্ষার্থী ছিল বা কেউ কেউ এখনো আছে। কিন্তু এ শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটির দায় শুধু সরকারের নয় বা শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের না।
আমাদের বই পড়ার অভ্যাস একেবারেই ক্ষীণ হয়ে গেছে। আর এটার জন্যই মূলত গোটা বাস্তু সংস্থানটাই অচল হয়ে পড়েছে। আমাদের শিশুরা পারিবারিক আবহ থেকে উন্মেষকালেই স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিক ও প্রাণহীন নীরস মানুষ হবার শিক্ষা রপ্ত করছে। প্রাক-প্রাথমিক অবস্থায় যে শিশুকে বৈচিত্র্যমুখী ক্যারিয়ারের হিসাব-নিকাশ দেখানো হয় এবং তাকে লোভী পেশার দিকে তার মনের বিরুদ্ধে ঠেলে দেওয়া হয় তখন এই ছেলেটা আর যাই হোক আজীবন মানসিক অসন্তুষ্টির মধ্যে থাকে। আবার তাকে প্রয়োজনের বাইরে অন্যান্য বই পড়া থেকে বিরত রাখা হয় এবং তার এ মানসিক আজীবন অব্যাহত থাকে। সীমাবদ্ধ জ্ঞানে আবদ্ধ হওয়ায় তার আত্মসত্তা তৈরি হয় না। যার দরুন বাবা-মা’র বেছে দেওয়ার বাইরের পেশার মর্ম অনুধাবন করার ক্ষমতা তার নেই। এ নীরস মনের অধিকারী এ শিক্ষার্থী যখন ডাক্তার হয় তখন সে অর্থ ছাড়া কিছুই বোঝে না। এমনকি টাকার লোভে অসত্ পন্থা অবলোকন করে রোগীকে মেরে ফেলতেও কার্পণ্য করে না। এমন নজির কম নয় এ দেশে। ধর্ষিত হবার পর ও অনেক অসত্ ফরেনসিক ভুয়া রিপোর্ট দেয়। আর এ কর্মকাণ্ড নিশ্চিতভাবে সন্ত্রাসবাদের অন্তর্ভুক্ত। তাকে মূল্যায়ন করার জন্য সমসাময়িক মানদণ্ড আমলে নিলে অন্যায় হবে।
বরং এর জন্য তার সোনালি শৈশবে ফিরে যেতে হবে; যেখানে তার পিতা-মাতা তার চিন্তা করার শক্তি নষ্ট করে দিয়েছে, মানুষের কষ্ট বোঝার পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়নি। এই পিতা-মাতা শিক্ষার নামে, ভালো পেশার জন্য যেমন সন্তানের উপর অযথা ও অযৌক্তিক চাপ সৃষ্টি করে অন্যান্য বই পড়া থেকে বিরত রাখে; তেমনি সন্তানের সঙ্গে তাদের পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া ও কম বা ইতিবাচক নয়। সন্তানের নেতিবাচক চিন্তাশক্তি ও কর্মকাণ্ড তাদের পর্যবেক্ষণের বাইরে। আর এ চাপ থেকে স্বস্তি পেতে বা অতি হতাশা থেকে এরা নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। এর পরের ধাপগুলো অতি পরিচিত। নেশার টাকা সংগ্রহের জন্য যা দরকার তা করা। বহু আলোচিত চরিত্র ঐশীর জীবনী-ই এর বড় দৃষ্টান্ত। কেউ কেউ এখান থেকে ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজে লিপ্ত হয় নেশায় বিকৃত হয়ে গিয়ে। সর্বশেষ পর্যায়ে এরাই সমাজে সন্ত্রাস ও রাহাজানি করে, শুভবুদ্ধির চেতনাকে নস্যাত্ করে ভয়ঙ্কর সংস্কৃতির জন্ম দেয়। আবার অমানানসই শিক্ষার চাপে অনেক শিক্ষার্থী খিটমিটে স্বভাবের হয়ে যায়। অনেকক্ষেত্রে বন্ধুর সঙ্গে সামান্য মনোমালিন্য থেকে তাকে মেরেও ফেলে যা আগেই কল্পনার বাইরে ছিল। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জায়গায়ই এসব ঘটনা অহরহ ঘটছে। এর মধ্যে কিছুদিন আগে মিরপুরে এক শিক্ষার্থীকে তার সহপাঠীদের দ্বারা প্রাণ হারাতে হয়েছে তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মনোমালিন্য থেকে।
আমাদের শিক্ষকদের সমন্বিত ভূমিকার কথা আগেই বলেছি। ক্লাসে তারা রসায়নের সঙ্গে নৈতিকতার শিক্ষাও দিবে, ইতিহাস পড়াতে গিয়ে মহানবী, যিশুর চরিত্র আলোচনা করবেন ; নীতি-নৈতিকতার গুণগান গাইবেন। মূলত স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এ ব্যবস্থা একেবারেই বিলীন। এ জন্য দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয় নোংরা রাজনীতিতে ভরপুর। এখানে কোনো শিক্ষক নৈতিকতার কথা বললে তার পঠিত বিষয়ে তার অদক্ষতার কথা বিবেচনা করা হয়। এজন্য এ মেধাবী শিক্ষার্থীদের দ্বারাও কত যে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ রপ্ত হয় তার ইয়ত্তা নেই। এরাই ধর্ষণ, রাহাজানি, সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে দেশটাকে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মূলত শিক্ষাব্যবস্থা ও নৈতিকতার অভাবেই এটা হচ্ছে। বলতে দ্বিধা নেই যে, যেসব বাবা-মা, শিক্ষক—এই ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যদিয়ে বড় হয়েছেন; এই মতাদর্শ দ্বারাই নিজেদের পরিচালনা করছেন তাদের কাছ থেকে সুশিক্ষিত সন্তান প্রত্যাশা অনর্থক। কেননা ছোট্টবেলায় কোনো বৃক্ষ বাঁকা করে রোপণ করে বড় হলে সেটা সোজা করতে গেলে নিজের হাত ভাঙার সম্ভাবনাটাই বেশি। আর এ শিক্ষাব্যবস্থার জন্যই এক শিক্ষিতের ছেলে অন্য শিক্ষিতের মেয়েকে ধর্ষণ করতে কার্পণ্য করে না। যদিও এদের পিতারা একসময় বন্ধু ছিল। তাই সময় থাকতেই শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হোক এ প্রত্যাশা সবার।
লেখক :শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়