এমপিও, নন এমপিও শিক্ষকের অন্তহীন কষ্টের বচন

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

‘ভিক্ষুক মুক্ত বাংলাদেশ’ গড়ার প্রত্যয়ে দিনরাত নিরলস কাজ করে যাচ্ছে সরকার। ভিক্ষুক পূনর্বাসনে ও তাদের নানা উদ্যোগ। প্রিয় স্বদেশকে জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলায় রুপান্তর করার যতসব আয়োজন। কিন্তু, কারা যেন এ দেশের শিক্ষক সমাজকে বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকদের ভিক্ষুকের দলে ঠেলে দেবার অদৃশ্য এক প্রয়াস অবিরাম অব্যাহত রেখেছে? এ এক চরম লজ্জার কথা। মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতির জন্য ‘ভিক্ষুক মুক্ত বাংলাদেশ’ হয়তো একটা ফ্যাক্টর বা সূচক । কিন্তু, নিত্য যে দেশে শিক্ষকরা দূর্বিষহ জীবন যাপন করেন, সেখানে মধ্যম আয়ের দেশের সত্যিকারের প্রতিচ্ছবি কতটুকু খুঁজে পাওয়া সম্ভব ?

যে সব স্কুল- কলেজ কুড়ি বছরে আজো এমপিও’র মুখ দেখতে পায় নাই, তাদের শিক্ষক-কর্মচারীর কথা আসুন একবার ভেবে দেখি। তারা কী পেটে পাথর বেঁধে থাকেন ? তারা যে কী নির্মম বাস্তবতা মেনে জীবন যুদ্ধে টিকে আছেন , সেটুকু ভাবার মত সময় ও আমাদের অনেকের নেই। জাতি গঠনের এ সব মহান কারিগর জাতিকে কেবলি উজাড় করে দিয়ে নিজে নিঃস্ব হচ্ছেন, তাদের প্রাপ্তির খাতা ও একেবারে শুন্য থেকে যাচ্ছে।

আইসিটি শিক্ষক, শাখা শিক্ষক সহ কয়েকটি আবশ্যিক বিষয়ে বিধি মতে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের কষ্টগুলো আরেক রকমে আলাদা। ১৩ নভেম্বর,২০১১ সনের কালো প্রজ্ঞাপনটি তাদের জীবনকে অমানিশার ঘোর অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে । তাদের প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত। তাদের সহকর্মীগণ এমপিও মারফত বেতন কিংবা অনুদান যাই হোক না কেন, প্রতিমাসের একটি অনির্ধারিত তারিখে হলে ও হাতে কিছু পান । তা দিয়ে তারা তাদের অন্তহীন অভাবের সাথে কোন মতে আপোষ করে দিন অতিবাহিত করেন। কিন্তু, এমপিও বিহীন শিক্ষকদের মনের অবস্থা কেমন ? তাদের ও তো পেটে পাথর বাঁধা ছাড়া করার কিছু নেই । তাদের বুড়ো মা-বাবা, স্ত্রী ও সন্তানের কাছে তাদের কী মূল্যায়ন ? একই প্রতিষ্ঠানে এক সাথে কাজ করে কেউ কিছুটা হলে ও পাবে, আর কেউ মোটে ও পাবে না-সে তো হতে পারে না। যারা পান তারা পর্যন্ত, যারা পান না-তাদের বেদনায় জর্জরিত হয়ে পড়েন।

বেশ ক’দিন থেকে শোনা যাচ্ছিল, আইসিটি ও শাখা শিক্ষকদের এমপিও দেবার সিদ্ধান্ত হয়েছে । তারা আশায় বুক বেঁধে ছিলেন। কিন্তু,কই? পথের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে তারা আবার আগের হতাশায় পুনশ্চ নিমজ্জিত হয়েছেন।
এ সব শিক্ষক নিজে বাঁচবেন কী করে আর পরিবার-পরিজনকেই বা বাঁচাবেন কী করে ? তারা যেমন অন্যের বাড়ীতে কাজে যেতে পারেন না,তেমনি কারো কাছে হাত ও পাততে পারেন না। তা হলে তাদের উপায় কী ? মাঝে মাঝে কেউ কেউ মনের দুঃখে শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথাও ভিন্ন কোন কাজে জড়িয়ে যান। এমনি জনৈক শিক্ষক কয়েক বছর শিক্ষকতা করে পরিবার-পরিজন ও পেটের দায়ে শিক্ষকতা ছেড়ে অবশেষে রিক্সা ড্রাইভারের কাজ নিয়েছেন বলে খবরে জানা যায়।আমাদের জাতির জন্য এ এক চরম দুঃসংবাদ বৈ কিছু নয়।

একটা সময় ছিল যখন জমিদার কিংবা অবস্থা সম্পন্ন পরিবারের সন্তানেরা শিক্ষকতায় আসতেন। জমিদারের ছেলে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্য কোথাও থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে বাড়ি ফেরলে জমিদার তার সম্পত্তি যাতে নিজের ছেলে দেখাশুনা করতে পারে সে জন্য একটা বন্দোবস্ত করতেন। তিনি বাড়ির পুকুর পাড়ে কিংবা সুবিধা জনক অন্য কোন স্থানে নিজের জায়গায় একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে দিতেন । সন্তান তাতে শিক্ষকতা করে করে বাবার জমিদারী দেখা শুনা করতেন । জমিদার পুত্রের জন্য বেতনের প্রয়োজন হতো না । আজ আর জমিদারী প্রথা নেই । ধনী পরিবারের অনেকেই এখন শিক্ষকতা নয়, অন্য পেশায় চলে যায় । যারা আজকাল শিক্ষকতায় আসেন, তাদের তো আর জমিদারী নেই যে,বেতন না পেলে ও চলবে । আমাদের শিক্ষা ও শিক্ষকদের বাঁচাতে এ ভাবনার আজ বড় প্রয়োজন।
বৈশাখি ভাতা না দিয়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জোর করে নিজস্ব জাতীয়তাবাদ থেকে বঞ্চিত করার কোন অপচেষ্টা কেউ করছে কীনা-সে আশংকা করছেন দেশের পাঁচ লক্ষ এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী। বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রেরণার অন্যতম উৎস । সে বাঙ্গালিয়ানার স্বাদ থেকে যারা এমপিও শিক্ষকদের বঞ্চিত করার হীন উদ্দেশ্যে বৈশাখি ভাতা দিতে বাঁধ সেধেছে, তারা এ জাতির চির শত্রু । তাদের এ হীন অপচেষ্টা প্রতিহত করতে না পারলে শিক্ষার সমূহ ক্ষতি অবধারিত।

ইনক্রিমেন্ট না পাবার দুঃখে আর রাগে এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীর মনে এখন ক্ষোভের এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। আর কোনদিন বেতন কমিশন হবে না । টাইম স্কেল ও উঠিয়ে দেয়া হয়েছে । পদোন্নতির ও সুযোগ নেই তাদের। ইনক্রিমেন্ট না দিলে কেয়ামত পর্যন্ত তাদের এক জায়গায়ই বসে থাকতে হবে । সরকারি পিয়নের বেতন বেসরকারি শিক্ষকদের চেয়ে বেশী হবে। আমলাদের গাড়ির ড্রাইভার অপেক্ষা বেসরকারি শিক্ষকের বেতন বহু নীচে নেমে যাবে ।
কলির কালে কতকিছু হবে ! ছোট লোক বড় হবে ! বড় লোক ছোট হবে ! তা-ই বুঝি হতে শুরু করেছে ? তা না হলে, মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে শিক্ষকদের অবস্থা ও মর্যাদা অবনমিত হবে কেন ?

লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ও দৈনিকশিক্ষার নিজস্ব শিক্ষা বিশ্লেষক।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষার্থীদের শাস্তি কোনো সমাধান নয় - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের শাস্তি কোনো সমাধান নয় হিটস্ট্রোকের লক্ষণ ও করণীয় - dainik shiksha হিটস্ট্রোকের লক্ষণ ও করণীয় দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে সেশনজটের শঙ্কা বুয়েটে - dainik shiksha সেশনজটের শঙ্কা বুয়েটে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে মাধ্যমিক প্রজন্মের উপার্জন কমবে ৩১ বিলিয়ন পাউন্ড - dainik shiksha মাধ্যমিক প্রজন্মের উপার্জন কমবে ৩১ বিলিয়ন পাউন্ড প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026519298553467