‘সব ভাল তার, শেষ ভাল যার’ অথবা ‘শেষ ভাল যার, সব ভাল তার’ এটি আমাদের দেশে এক বহুল প্রচলিত প্রবাদ। প্রবাদ-প্রবচন একেবারে মূল্যহীন কিংবা নিরর্থক কিছু নয়। বাংলা সাহিত্যে প্রবাদ-প্রবচন এক অমূল্য সম্পদ। যারা এ সকল প্রবাদ-প্রবচন রচনা করেছেন, তারা নিঃসন্দেহে জ্ঞানী ও পণ্ডিত লোক ছিলেন।
তাই দেখা যায়, এ সবের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বাস্তবতার নিরিখে সঠিক ও যথার্থ।
প্রবচনটি দেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীর বেলায় তাঁদের বাস্তব জীবনের এক নির্মম সত্যকে ফুটিয়ে তুলে। এমপিও শিক্ষকদের জীবনে না পাওয়ার বেদনা অসীম। তাঁদের শেষ জীবনের বঞ্চনাই প্রমাণ করে, তাঁরা সারা জীবন কতই না নিগৃহীত ও বঞ্চিত হন।
এমন একটা দিন ছিল, যখন একজন এমপিও শিক্ষক কেবল ছাতি আর লাঠি নিয়ে অবসরে যেতেন। শিক্ষকতা জীবনের সমাপ্তিলগ্নে ছাত্র ছাত্রীরা তাঁদের ভালবাসার অর্ঘ্য স্বরুপ শিক্ষকের জন্য বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো। সে অনুষ্ঠানে শিক্ষককে একটি মানপত্র, পাজামা-পাঞ্জাবি, তসবিহ, কোরাণ মজিদ, জায়নামাজ ও ছাতি-লাঠি উপহার দেয়া হতো। নিজের ছাত্র ছাত্রী ও সহকর্মীদের ভালবাসায় সিক্ত হয়ে তৃপ্ত মনে বাড়ি ফিরতেন শিক্ষক। আজ সে তৃপ্তিটুকু ও নেই। অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্টের বিড়ম্বনা শিক্ষকের সে তৃপ্তিটা কেড়ে নিয়েছে ।আমাদের দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান নানা বৈষম্য ও অসঙ্গতির যাঁতাকলে নিত্য পিষ্ঠ হচ্ছেন এ দেশের নিরীহ এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীগণ। অথচ শিক্ষা ক্ষেত্রে আজ যেটুকু সাফল্য অর্জিত হচ্ছে, তার সিংহ ভাগ তাঁদের হাতেই সম্পাদিত। সরকারের বই উৎসব সফল করেন তাঁরা। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি বাস্তবায়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ, দূর্ণীতিমুক্ত সোনার বাংলা গঠন, সরকারের ভিশন-২০২১’র লক্ষ্যমাত্রা অর্জন প্রভৃতি কাজে তাঁদের গৌরবজনক অংশগ্রহণ । অথচ, তাঁরা কী-না দেশের সর্বাপেক্ষা নিপীড়িত ও নিগৃহীত জনগোষ্ঠী !
আমাদের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান একটি শোষণমুক্ত সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু, তাঁর সেই স্বাধীন সোনার বাংলায় আজ শিক্ষকরাই সবচেয়ে বেশী শোষণ ও বঞ্চনার শিকার। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আজ হয়তো শিক্ষকদের এতো বঞ্চনা পোহাতে হতো না। সময় মতো বেতন না পাওয়া , বাড়ি ভাড়া ও অন্যান্য ভাতার অপর্যাপ্ততা , পদোন্নতি ও বদলির সুযোগ না থাকা এবং সর্বোপরি চাকুরি জীবন শেষে কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধার নামে এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীগণ যে বিড়ম্বনা ও অপমানের শিকার হন, তা কেবল তাঁদের নয়, গোটা জাতির জন্য একটা বড় লজ্জার বিষয় বটে।
জন্মলগ্নে কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা বোর্ড গঠনকে স্বাগত জানিয়েছিলেন দেশের আপামর এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীগণ। তাঁরা ভেবে আশ্বস্থ হয়েছিলেন যে, অন্ততঃ শেষ বয়সে কিছুটা হলেও স্বস্থিতে জীবনটা কাটাতে পারবেন তাঁরা। কিন্তু , এ সব যে তাঁদের পরিণত বয়সের কষ্টটুকু আরো বাড়িয়ে দেবে তা সে সময়ে কেউ না বুঝলে ও আজ অনেকে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। টের পেয়ে পেয়ে না পাবার বেদনা নিয়ে অনেকেই এতদিনে কবরবাসী হয়ে গেছেন । এ যেন এমপিও শিক্ষকের এ পেশায় আসার অপরাধের চরম শাস্তির শেষ ধাপ। হায়রে পোড়া কপাল! জাতি গঠনের কারিগরদের নিয়ে এ কোন নির্মম উপহাস?
রাজধানী ঢাকার পলাশী-নীলক্ষেত রোডের ব্যানবেইসের নীল ভবনটিতে কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা বোর্ড অফিস। নীলক্ষেত সংলগ্ন এ নীল ভবনটির চারপাশ ঘিরে কতো অবসরপ্রাপ্ত এমপিও শিক্ষকের দূর্ভোগ নিত্যদিন ঘুরপাক্ খায়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে প্রতিদিন কত জীর্ণ-শীর্ণকায়, ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত শিক্ষক-কর্মচারী এক বুক আশা নিয়ে এখানে আসেন আর মাত্র এক দু’টি কথায় সব আশা ধুলিস্যাৎ হয়ে গেলে ভগ্ন হৃদয়ে এক বুক দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বাড়ি ফেরেন। মিথ্যা আশ্বাসে কম দামের হোটেলে দু’চার রাত কাটান কেউ কেউ। তারপর দালাল চক্রের চাহিদা পূরণের সামর্থ্য না থাকায় তাঁরাও এক বুক নিরাশা নিয়ে ফিরে যান। আশা ভঙ্গের বেদনায় ছটফট করে করে একদিন ইহলীলা সাঙ্গ করেন।
কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা পাবার জন্য একজন শিক্ষক-কর্মচারীকে নানা বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। শুরুতে নানা দলিল দস্তাবেজ খোঁজাখুঁজি ও যোগাড় করতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মচারী হিমশিম খান। তারপর ঢাকার বাইরের শিক্ষক-কর্মচারীর জন্য ঢাকায় গিয়ে তা জমা দেয়া আরেক বিরাট ঝামেলা। কেউ কেউ দালালের শরণাপন্ন হন। কেউ কষ্ট করে ঢাকা পর্যন্ত গেলেও শেষ পর্যন্ত ফড়িয়াদের হাতে পড়তে হয়। অনলাইনে আবেদন জমা দেয়া সে আরেক ঝক্কি-ঝামেলা। হাতে হাতে জমা দিলে পৃথক দু’টো রসিদ নিয়ে বাড়ি ফিরে সেই যে অপেক্ষার প্রহর গুনা শুরু, কবে যে এ অপেক্ষার শেষ-সে কেউ জানেনা?
যিনি এতগুলো বছর চাকুরি করলেন, যার খুঁটিনাটি সব তথ্য কর্তৃপক্ষের কাছে আছে, তাঁর কেবল অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা পাবার জন্য এতো কাগজপত্র জমা দেবার কী প্রয়োজন? কেবল একটা আবেদনই কী যথেষ্ট নয়? সব কাগজপত্র জমা দেবার পরও দু’তিন বছরের আগে কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা পাওয়া যায়না। অবসর সুবিধার টাকা পেতে পাঁচ-ছয় বছর কিংবা কখনো কখনো আরো বেশী সময় লাগে। এ সব পাওয়া যেন এক মহা দূর্গতি। খুব কম সংখ্যক শিক্ষক-কর্মচারীই নিজের হাতে শেষ জীবনের পাওনাটা বুঝে পান। আর যা বা দু’এক জন পান, তখন এ সব টাকা দিয়ে কিছু করার শারীরিক সামর্থ তাঁদের দেহে তখন আর থাকে না ।
১৯৯০ সনে ‘বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট’ এবং ২০০২ সনে ‘বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড’ গঠনের পর আজ অবধি এ দু’খাত থেকে টাকা পেতে গিয়ে কত শিক্ষক-কর্মচারী যে কতোভাবে পীড়িত হয়েছেন, তার খবর একমাত্র আল্লাহ জানেন। খুব কম সংখ্যক শিক্ষক-কর্মচারী নিজ হাতে টাকাটা পেয়েছেন, বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মচারীর মৃত্যুর বহুদিন পরে তার পরিবার পরিজনের হাতে হয়তো টাকা এসে পৌঁছেছে ।
পরিণত বয়সে যে কোন মানুষ অত্যন্ত অসহায় হয়ে পড়েন। নানা রোগ-শোক তাঁকে পেয়ে বসে। নিজের কর্মক্ষমতা হারিয়ে অনেকটা পর নির্ভরশীল হন। চলাফেরার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় অতিবাহিত করতে হয় তাঁকে। একজন শিক্ষক-কর্মচারীর ক্ষেত্রে ও তা-ই প্রযোজ্য।
শিক্ষক-কর্মচারীর প্রতিমাসের বেতন থেকে বর্তমানে কল্যাণ ট্রাস্টে ২% হারে এবং অবসর সুবিধা বাবদ ৪% হারে কেটে রাখা হয়। শিক্ষা বিষয়ক একমাত্র জাতীয় পত্রিকা দৈনিকশিক্ষার প্রতিবেদনে জানতে পারলাম, তা বৃদ্ধি করে কল্যাণ ট্রাস্টে ৪% এবং অবসর সুবিধা খাতে ৬% কর্তন করা হবে। এতে শিক্ষক-কর্মচারীর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাতে সরকারি অনুদান না বাড়িয়ে কেবল শিক্ষক-কর্মচারীর চাঁদার পরিমাণ বাড়িয়ে কতটুকু লাভ হবে? শিক্ষক-কর্মচারীর দূর্ভোগের কথা চিন্তা করে যদি তা-ই করা হয়, তবে তাতে সরকারি অনুদান আগে বৃদ্ধি করে সকল অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা দূর করা আবশ্যক।
শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন থেকে চাঁদা কর্তনের হার বৃদ্ধি করার আগে এ ক্ষেত্রে তাঁদের দূর্গতি হ্রাসের নিশ্চয়তা বিধান করা আবশ্যক। তাঁদের অবসর গ্রহণের পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে যাতে তাঁরা সমুদয় টাকা ঘরে বসে পান, সে ব্যবস্থাটা করতে না পারলে সরকারের কেবল দূর্ণাম হতেই থাকবে। সরকারের বদনাম হোক-সে কারো কাম্য নয়।
এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের নানা দূর্গতি ও বিড়ম্বনা দূর করার জন্য তাঁদের চাকুরি জাতীয়করণই একমাত্র পথ। ততদিন পর্যন্ত তাঁরা যেন চাকুরি শেষ হবার তিন মাসের মধ্যে তাঁদের কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধার সমুদয় টাকা ঘরে বসে পান, সে ব্যবস্থাটুকু করার জন্য সদাশয় সরকার বাহাদুর সমীপে দেশের আপামর এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীর বিনীত নিবেদন। এটি করা মোটে ও কোন কঠিন কাজ নয় । এ সরকার কেবল ইচ্ছার জোরে অনেক দুঃসাহসিক কাজ সমাধা করে দেশের মানুষের আস্থা ও প্রশংসা অর্জন করেছে। এ কাজটির জন্য তাদের কেবল একটু সদিচ্ছা হলেই চলে।
লেখক : অধ্যক্ষ চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট সিলেট।