গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে শিক্ষকদের ভূমিকা

প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন |

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষার প্রসারের পাশাপাশি শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত করে সামাজিক শান্তি ও সম্প্রীতি নিশ্চিত করা শিক্ষকদের অন্যতম কর্তব্য ও দায়িত্ব। বাংলাদেশকে ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত ১৭টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। এই সকল লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে গুণগত শিক্ষার বিকল্প নেই। আমাদের সামাজিক জীবনে শিক্ষার আকাঙ্ক্ষা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেলেও এর গুণগতমান নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ যোগ্য ও নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব, পিতা-মাতার উদাসীনতা, সামাজিক দায়বদ্ধতার অভাব, শিক্ষার্থী ঝরে পড়া, মাদকাসক্তি, জঙ্গিবাদ, ইভটিজিং, লিঙ্গবৈষম্য, বাল্যবিবাহ, সুশাসনের অভাব, দুর্নীতি, সাইবার অপরাধ, সড়ক দুর্ঘটনা ইত্যাদি বিষয়গুলো প্রতিদিন দৃশ্যমান যা গুণগত শিক্ষা অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এভাবে চলতে থাকলে সরকারের গৃহীত ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ডিজিটাল বাংলাদেশ, ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, ২০৪১ খ্রিষ্টাব্দে উন্নত রাষ্ট্র এবং ২১০০ খ্রিষ্টাব্দে ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়বে।  

‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’ এ কথাটি শ্বাশত ও চিরন্তন। প্রশ্ন হলো, এক্ষেত্রে গুণগত শিক্ষার সংজ্ঞা সুনির্দিষ্টকরণ হয়েছে কিনা। শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো দেশের জনগোষ্ঠীকে তাঁদের কৌতূহলী প্রশ্নের সমাধান খুঁজে পাওয়ার সক্ষমতা অর্জন করার সুযোগ করে দেয়া, আর গুণগত শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো জনগোষ্ঠীকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে মানবিক ও সামাজিক মুল্যবোধ সম্পন্ন জনসম্পদে পরিণত করা।

গুণগত শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তাঁর সমাজ ও দেশের সম্পদে পরিণত হয়, তাঁর চিন্তা-চেতনায়, কর্মে, বিশ্বমানের পরিবর্তন আসে; তাঁদের সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হয়ে আচরণে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ঘটে, প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে নিজের ও সমাজের উন্নয়নে নিজেকে সক্ষম করে তোলে, ফলে সে তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যায়, প্রয়োজনে নিজেকে বদলাতে শেখে, বাঁচতে শেখে, বাঁচাতে শেখে, ভালো মানুষ হতে শেখে, শিখে নেয় কীভাবে প্রতিকূলতার সাথে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। এ শিক্ষা শুরু হয় তার জন্ম থেকে এবং তা চলে আমৃত্যু।

গুণগত শিক্ষা বিষয়টি কেবল শিক্ষক, বিদ্যালয়, পুস্তক, শিক্ষার্থী বা শ্রেণিকক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বা তা কোনো পদ্ধতিগত উপাদানও নয়। কারণ গুণগত শিক্ষাকে সামগ্রিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয় যার সাথে বিদ্যালয়ের কর্মতৎপরতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গুণগত শিক্ষা শিক্ষার্থীদেরকে ন্যায়বোধ, কর্তব্যপরায়ণতা, শৃঙ্খলা, আচরণবিধি, ধর্মনিরপেক্ষতা, বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব, সহাবস্থান, অনুসন্ধিৎসু, দেশপ্রেমিক, দেশের অতীত ও বর্তমান ইতিহাস, দেশের গুণিজন ও সাধারণ জনগণের প্রতি ভালোবাসাবোধ, দায়বদ্ধতা, অধ্যবসায়সহ নৈতিক ও আধ্যাত্মিক অন্তর্নিহিত গুণ উন্মোচনে সহায়তা করে। এটি শিশুদের কুসংস্কার থেকে বিজ্ঞানমনস্ক ও সংস্কৃতিমনা হিসেবে গড়ে উঠতে উৎসাহিত করে। অধিকন্তু, এটি শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে, আর শিক্ষার্থীদের সঠিক দক্ষতা ও  প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জনের মধ্য দিয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জনের দিকে ধাবিত করে। শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান, জীবন দক্ষতার উন্নয়ন, দৃষ্টিভঙ্গির গুণগত পরিবর্তন এবং সামাজিকভাবে সচেতন করে তোলাসহ পরবর্তী ধাপের শিক্ষা গ্রহণের উপযোগী করে তোলে (জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০)।

গুণগত শিক্ষার প্রতিফলনই সমাজের অন্ধকার দিকগুলো যথা- মাদক সেবন, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, ইভটিজিং, বাল্য বিবাহের অভিশাপ, লিঙ্গবৈষম্য, সাম্প্রদায়িক মনোভাব, খাদ্যে ভেজাল, সাইবার অপরাধ, ইত্যাদি অনাকাক্সিক্ষত অভ্যাস ও কার্যক্রম থেকে শিক্ষার্থীদের বিরত রেখে একটি সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করে উৎপাদনশীল, সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতা সম্পন্ন মানব তৈরি করে, ন্যায়বিচার, বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা গঠন, সততা, নিষ্ঠা, সহযোগিতা ও সহনশীল মনোভাব তৈরির পরিবেশ নিশ্চিত করে। সুশিক্ষাই শারীরিক সুস্থতা, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী শক্তিকে তরান্বিত করে সামাজিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সক্ষম।

গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করার প্রধান উপায় হচ্ছে মানসম্মত বা মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ। গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে নিম্নবর্ণিত কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে-

শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক সম্পর্ক: গুণগত শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক সুসম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একবিংশ শতাব্দিতে ফলপ্রসূ শিক্ষার ব্যাপারে যে 4Cs (Critical Thinking, Creativity, Collaboration, Communication) এর কথা বলা হয়, তার যথাযথ ফলাফল পেতে হলে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক হতে হবে অত্যন্ত সুনিবিড়। ছাত্রদের মধ্যে সৃজনশীলতা, সমস্যা সমাধানের এবং নেতৃত্বদানের গুণাবলী ফুটে উঠবে তখনই যখন তার চিন্তা জগতে সঠিকভাবে আঘাত করা সম্ভব। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক কোনোমতেই প্রভু-ভৃত্যের মতো হতে পারবে না। 

কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা: কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা অর্জনই প্রকৃত অর্থে গুণগত শিক্ষা। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এ বলা হয়েছে, দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি সাধনের জন্য শিক্ষাকে সৃজনশীল ও প্রয়োগমুখী করে তুলতে হবে। শিক্ষার্থীদেরকে শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও আগ্রহী এবং শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বৃত্তিমূলক শিক্ষায় দক্ষতা অর্জনে সামর্থ্য করে তুলতে হবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেসব বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি দিচ্ছে, পরবর্তীকালে বাস্তবজীবনে তা কতটুকু কাজে লাগাতে পারছে, তা ভাববার দরকার রয়েছে। উচ্চশিক্ষা নেবার পর তাঁদের মধ্যে যে উচ্চ আকাঙ্ক্ষা তৈরি হচ্ছে, তা যখন তাঁরা পূরণ করতে পারছে না, তখন তাঁদের মধ্যে একটি হতাশার জন্ম দিচ্ছে। দিন দিন আমাদের প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থা হতাশাগ্রস্ত যুবক-যুবতী বৃদ্ধি করে চলেছে। ফলে এসব হতাশাগ্রস্থ জনগণ অনেক সময় বিপথে যাচ্ছে, সমাজে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যদি শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল দক্ষ জনবল তৈরি করতে সক্ষম হতো তবে আমরা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে পারতাম। তবে সম্প্রতি শিক্ষার্থীরা কারিগরি শিক্ষায় লেখাপড়া করতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। কৃষি কাজ, পশুপালন, মৃৎশিল্প, তাঁত শিল্প, মৎস্য শিল্প, ইত্যাদি যে ছোট কাজ নয় তা শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমেই আমাদের বাচ্চাদের শেখাতে হবে। জাপানি একটি প্রবাদ রয়েছে, ‘‘তুমি আমাকে একটি মাছ দিলে মানে তুমি আমাকে এক বেলা মাছ খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলে কিন্তু তুমি আমাকে মাছ ধরার কৌশল শেখালে মানে তুমি আমাকে সারাজীবন মাছ খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলে।’’

উপসংহারে বলা যায় যে, জাতীয় উন্নয়ন ও সামাজিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য  সরকার উপরোল্লিখিত কয়েকটি বিষয়ে জিরো টলারেন্স প্রর্দশন করছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২ ও জাতীয় শিক্ষা নীতি-২০১০ এর আলোকেও দেশে গণমুখী, সর্বজনীন, সুপরিকল্পিত, বিজ্ঞানমনস্ক, নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানবসম্পদ গড়ে তোলার দায়িত্ব শিক্ষকদের। জাতীয়  উন্নয়ন ও শিক্ষা উন্নয়ন দুটি শব্দ হলেও  তা পরস্পর একই সূত্রে গাঁথা । এ দেশে এ নিয়ে শত বছরে  অনেক সভা, সমাবেশ, সেমিনার, সম্মেলন হয়েছে। পরিবর্তনশীল বিশ্বে উন্নত জাতি হিসেবে  নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে আমাদের জাতীয় উন্নয়নকে আরও বেগবান করা এখন সময়ের দাবি। এ দাবি মেটাতে শিক্ষকরাই সুদক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার দায়িত্ব নিতে পারে। শিক্ষকরাই ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে সরকারের দেয়া নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলবে এবং এই দেশের ১৭ কোটি দেশপ্রেমিক মানুষের ৩৪ কোটি দক্ষ ও কর্মঠ হাত একসাথে কাজ লাগিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকাকে বেগবান করবে এটাই হলো গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণের মূল উদ্দেশ্য।

লেখক: পরিচালক (প্রশিক্ষণ ও বাস্তবায়ন), জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম), শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী - dainik shiksha গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট - dainik shiksha জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ - dainik shiksha আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0059769153594971