আমি জানি না আমাদের মতো মনঃকষ্টে আর কারা আছেন। এখানে ‘আমরা’ বলতে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যদের কথা বলছি। ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী—সবার কথা। কারণ আমরা কাছে থেকে দেখছি জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টির তপোবন বিশ্ববিদ্যালয় কেমন অনুর্বর ঊষর মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। মনে পড়ে কলেজে পড়ার সময় শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনিতে ফুফুর বাড়ি বেড়াতে এসেছিলাম। ফুফাতো ভাই তাঁর বাবার মতো রেলওয়েতে জয়েন করেছেন। খুব গর্ব করে বললেন তাঁর বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। এই শিক্ষককে আমি কোনো দিন দেখিনি; কিন্তু সেই মুহূর্ত থেকে আমার কাছে আমার এই ভাইটির মর্যাদা অনেক বেড়ে গেল। সোজা কথা নয়, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তাঁর বন্ধু। আমি যখন ছাত্র ও যখন শিক্ষকতায় যোগদান করি সে সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। এর অনেক আগে উপাচার্য ছিলেন সৈয়দ আলী আহসান ও মুহম্মদ এনামুল হকের মতো বিদগ্ধ পণ্ডিতজন। উপাচার্য পদের সঙ্গে এসব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন উজ্জ্বল নক্ষত্র মানিয়ে গিয়েছিলেন। ভালো যে তখন রাজনৈতিক নিয়োগের যুগ শুরু হয়নি। না হলে জানা হতো না অমন বিশাল মাপের পণ্ডিতজনরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন এবং সৌন্দর্য ছড়িয়ে ন্যায়দণ্ড হাতে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করেন। আমার সৌভাগ্য যখন শিক্ষকতা পেশায় আসি তখনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কু-রাজনীতি গ্রাস করেনি। তাই নিজ যোগ্যতার গুণে আর উপাচার্য ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থাকার কারণে আমার আবাল্যের স্বপ্ন পূরণ করে অনায়াসে শিক্ষক হতে পেরেছিলাম। যেহেতু ছাত্রজীবনে রাজনীতি করার কোনো সিলমোহর গায়ে পড়েনি, যেহেতু আমার বড় কোনো প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা মন্ত্রী-এমপি তদবিরকারী নেই এবং যেহেতু শিক্ষক হওয়ার জন্য টাকা ছড়ানোর রুচি ও ক্ষমতা কোনোটাই নেই, তাহলে আজ কোথায় ভেসে যেতাম কে জানে!
আজ সব কিছু দেখে দারুণ হতাশার মধ্যে দাঁড়িয়ে অসংকোচে বলব, জাতীয় পার্টি, বিএনপি, আওয়ামী লীগ—সব দলের ক্ষমতাসীনরা যাঁর যাঁর ক্ষমতাকালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ক্ষমতার অন্যতম হাতিয়ার বানাতে গিয়ে বিদ্যাপীঠকে যেভাবে ধ্বংস করেছেন—করে যাচ্ছেন এর জন্য ইতিহাসের কাঠগড়ায় সবাইকেই একদিন দাঁড়াতে হবে। কিন্তু ততক্ষণে জাতির বড় রকমের ক্ষতি হয়ে যাবে।
হয়তো ব্যতিক্রম আছে, তবু সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয়, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে গেলে মেধাবী ফলাফল, গবেষণার অভিজ্ঞতা ইত্যাদি প্রধান বিষয় নয় বা জরুরি বিষয়ও নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতিতে অভিজ্ঞ একজন ক্ষমতাবান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলছিলেন একজন সহকর্মী। তাঁর মেধাবী মেয়েটি সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেছে। ফলাফল বরাবরই ভালো। এখন তো গ্রেড সিস্টেম। ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট, সেকেন্ড হওয়ার ব্যাপার নেই এখন। তবু অনার্স-মাস্টার্সে যে নম্বর পেয়েছে তাতে ফার্স্ট ক্লাসের সমতুল্য। তবু ০.২, ৩, ৫ নম্বর বেশি পেয়ে আরো তিন-চারজন শিক্ষার্থী মেয়েটির ওপরে আছে। অধ্যাপক সাহেবের ইচ্ছা তাঁর মেয়েটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হোক। তিনি তাঁর দুর্ভাবনার কথা রাজনীতি করা সহকর্মীকে জানালেন। আমাদের জাঁদরেল অধ্যাপক হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমি তো দেখছি আপনার মেয়ের সম্ভাবনাই উজ্জ্বল বেশি। এখন ফার্স্ট, সেকেন্ড হওয়া মেধাবীরা বিশেষ পাত্তা পায় না। পাত্তা পাওয়ার হিসাবটা অন্য। ’
আমি মনে করি, কঠিন সত্যটি বলে ফেলেছেন অধ্যাপক বন্ধু। কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহকর্মী দুঃখ করে বলছিলেন, বিশেষ প্রয়োজনে উপাচার্য মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলে বেশ বিব্রত হতে হয়। তাঁর অফিস রুমে গিয়ে দেখতে হয় আগে থেকেই চেয়ার দখল করে ছাত্রলীগের নেতারা চায়ের কাপে ধোঁয়া ওড়াচ্ছে। আমার মনে পড়ে গেল, আমার ছাত্রজীবন ও শিক্ষকজীবনের প্রথম দিকটার কথা। তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্বের সামনে আমরা অবনত থাকতাম। প্রাক-অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করার প্রশ্নই ছিল না। ছাত্রনেতাদেরও সময়ে-অসময়ে অনুমতি ছাড়া উপাচার্যের অফিসে যাওয়া তো ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। বিষয়টি অনেকে অনেকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন। তবে আমি মনে করি, ন্যায়ানুগভাবে প্রশাসন পরিচালনা করতে প্রয়োজনীয় বিধিবিধান ও আচরণ মানার দরকার আছে।
সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে এখন আমাদের উজ্জ্বল মেধাবী শিক্ষার্থীরা। শাণিত মেধার শিক্ষার্থীরাই তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে। সে স্বপ্ন নিয়েই তো নিজেকে প্রস্তুত করে অনেকে। কিন্তু খুবই কষ্টের মুখোমুখি হই যখন আমার তেমন ঝকঝকে ছাত্র-ছাত্রী অথবা কারো রেফারেন্সে অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেধাবী ফলাফল করে আসা ছাত্র-ছাত্রীটি বলে, ‘স্যার অমুক বিভাগে প্রভাষক নিয়োগের বিজ্ঞাপন দিয়েছে, আমি আবেদন করেছি। ’ সঙ্গে যখন এ কথাটিও বলে, ‘যতটুকু জেনেছি আবেদনকারীদের মধ্যে শিক্ষা পর্যায়ের সব ফলাফল ও গবেষণার বিচারে আমি এগিয়ে আছি’ তখন আরো বেশি বিপন্ন বোধ করি। আমি খুব সতর্কভাবে জানার চেষ্টা করি ছাত্রজীবনে ওরা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল কি না; যদিও জানি এমন মেধাবীরা আজকাল ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকে না। এ ক্ষেত্রেও না বোধক উত্তর আসে। জানার চেষ্টা করি উপাচার্য বা প্রশাসনঘনিষ্ঠ রাজনীতি করা শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে কি না। সেখানেও যদি না বোধক উত্তর আসে তখন শেষবারের মতো জানতে চেষ্টা করি কোনো ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতা বা ডাকসাইটে মন্ত্রীকে দিয়ে তদবির করাতে পারবে কি না—সেখানেও যদি উজ্জ্বল মেধাবী শিক্ষার্থীরা মাথা নিচু করে নিজেদের অক্ষমতা প্রকাশ করে তখন আমি ওদের অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা ভেবে ভীষণ বিষণ্ন বোধ করি।
সাম্প্রতিক দু-একটি উদাহরণ দিতে চাই। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চলের সবার কাছে এটি জানা ছবি। আমার চেনা কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র এসএসসি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ঝকঝকে ফলাফল করেছে। শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে পড়াশোনা করেছে ও। প্রায় চার বছর আগে স্নাতকোত্তর পাস করেছে। বসে থাকেনি। গবেষণায় নিজেকে যুক্ত রেখেছে। এর মধ্যে দেশি-বিদেশি জার্নালে বেশ কয়েকটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। একক ও যুগ্ম লেখক হিসেবে ওর পাঁচ-ছয়টি বই বাজারে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রেফারেন্স বই হিসেবে পড়ে। ওর পছন্দ নয় জীবিকার প্রয়োজনে তেমন চাকরি করছে এখন। আমার এক অধ্যাপক বন্ধুর মন্তব্য দুটি কারণে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ওর শিক্ষক হওয়ার সুযোগ নেই। প্রথমটি ওর রাজনৈতিক পরিচয় স্পষ্ট নয়। দ্বিতীয়টি ও ‘ওভার কোয়ালিফাইড’। কোনো কোনো ক্ষমতাশালী শিক্ষক এই মেধাবী গবেষক সহকর্মী পাশে থাকলে স্বস্তি পাবেন না। অন্য এক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদের জন্য পাঁচবার মৌখিক পরীক্ষায় গিয়েও বিদায় নিতে হয়েছে শূন্য হাতে। সনদে-কাগজপত্রে ওর চেয়ে তালিকায় অনেক নিচের দিকের প্রার্থীরা নিয়োগ পেয়েছে। শেষবার এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছে ছাত্রটি। বলেছে, ক্ষমতাসীন দলের দুই ছাত্রনেতা যোগাযোগ করেছে ওর সঙ্গে। নিয়োগ পেতে হলে একটি বড় অঙ্কের খরচ নাকি করতে হবে ওকে। কিন্তু সেই সাধ্য ওর নেই।
দ্বিতীয় উদাহরণটি দেশের বড় এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা এক ছাত্রীর। শিক্ষার সব স্তরের সার্টিফিকেট নজরকাড়া। সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে ওর সঙ্গে পরিচয়। ও একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছিল। আমি ওকে অভিনন্দিত করেছিলাম। সেই সূত্রে সেদিন আমার বিভাগে এলো। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো এক বিভাগে প্রভাষক পদের জন্য আবেদন করেছে। জানাল ওর নিজের কথা। দূরবর্তী এক গ্রাম থেকে অনেক সংগ্রাম করে ঢাকায় পড়তে এসেছে। কৃষক বাবার পুরো সংসার তাকিয়ে আছে ওর দিকে। আমি ভাবলাম, অমন মেধাবী মেয়েটি নিয়োগ পাবে না কেন! পরমুহূর্তে বাস্তবতার দিকে তাকিয়ে বিপন্ন বোধ করলাম। তৃতীয় উদাহরণ এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা এক ছাত্রী। সব ফলাফলে এক নম্বরে আছে। একটি বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা করছে। বিসিএস দিয়ে সব পর্যায় অতিক্রম করে এখন মৌখিক পরীক্ষার অপেক্ষায় আছে। এর মধ্যে ওর বিভাগে প্রভাষক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞাপন হয়েছে। আমাকে টেলিফোনে একটি মজার কথা বলল। বলল, ‘স্যার, একদিকে মেধার লড়াই করতে প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে আর অন্যদিকে নানা ঘাটে দৌড়াদৌড়ি করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যেতে হচ্ছে। ’ আমি একটি দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে রাখলাম।
এসব শুনে আমার এক চাকরিজীবী বন্ধু জানতে চাইলেন নিয়োগ কমিটিতে তো ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সদস্যরা থাকেন, তাহলে তাঁদের ভূমিকা কী? আমি সংকোচের সঙ্গে বললাম, কিছু ব্যতিক্রম উদাহরণ বাদ দিলে দেখবেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ কমিটিতে বেশ ‘কমন’ কয়েকজন শিক্ষককে পাওয়া যাচ্ছে। যাঁদের বর্ণ পরিচয় সুনির্দিষ্ট। নিয়োগকর্তারা নানাভাবে স্বস্তি পাবেন অমন বহিঃস্থ সদস্যদেরই তালিকাভুক্ত করে থাকেন।
কঠিন বাস্তবতার আংশিক ছবি এখানে উপস্থাপন করলাম। এই অঞ্চলের অধিবাসী হয়ে আর কাদা ঘাঁটতে ইচ্ছা করছে না। নষ্ট রাজনীতি কিভাবে যে সব প্রতিষ্ঠান নষ্ট করছে এরই একটি করুণ চিত্র রয়েছে এখানে। এমন বাস্তবতায় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার মান আমরা আশা করতে পারি না। এসব কারণে বিশ্ববিদ্যালয় যে জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টির তপোবন তা কাগুজে মন্তব্যেই আটকে রইল।
সব কিছুর পরও আমি যেহেতু শিক্ষক, তাই ছাত্র-ছাত্রীদের দিকে আমাকে তাকাতেই হয়। অনেক যত্নে যেসব মেধাবী শিক্ষার্থীকে গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছি ওদের বিপন্ন চেহারার দিকে তাকাতে পারি না। ওরা কি আর কখনো কোনো সুস্থ পরিবেশ পাবে না, যেখানে শিক্ষক নিয়োগ শুধু মেধার মূল্যায়নে হবে! যেমন পরিবেশ আমাদের শিক্ষক হওয়ার সময় ছিল। আমি কি আর মনের জোর নিয়ে আমার ছাত্র-ছাত্রীদের বলতে পারব না, লেখাপড়া আর মেধাচর্চার মধ্য দিয়ে নিজেকে যোগ্য করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসো। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তুলতে নিজেকে প্রস্তুত করো। এ সময়ের বাস্তবতায় আমি শুধু বিপন্ন দৃষ্টি নিয়ে এসব দুর্ভাগা শিক্ষার্থীর দিকে তাকিয়ে থাকি। ভাবি, তাহলে এসব মেধাবী যাবে কোথায়!
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়