দুই উপাচার্যের দ্বন্দ্ব বনাম সিদ্দিকুরদের ভাগ্যরেখা

কাজী আলিম-উজ-জামান |

তিন বছর বয়সেই বাবাকে হারিয়েছিলেন সিদ্দিকুর রহমান। আর যৌবনে এসে হারালেন চোখ দুটি। জগতের এত আলো, এত রূপ আর দেখবেন না তিনি। সিদ্দিকুর ছিলেন দরিদ্র একটি পরিবারের বেঁচে থাকার আশা, স্বপ্ন দেখার সাহস। স্বপ্ন ফুরাল। রচিত হলো আশার সমাধি।

তিতুমীর কলেজের ছাত্র সিদ্দিকুরকে চাকরি দেবেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। একটি চাকরিই কি সব? চাকরি তো তাঁর চোখের আলো ফিরিয়ে দেবে না। চাকরি কি তাঁর মনের ক্ষত নিরাময়ের মলম? চাকরি কিছুই না, আবার কিছু, হয়তো। অন্তত চোখের আলো হারানো সিদ্দিকুরের জন্য। আর সঠিক তদন্তে দায়ী পুলিশ সদস্যকে চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত না করা গেলে—কী সান্ত্বনা থাকবে যুবকটির?

খুশি হতাম যদি সিদ্দিকুরকে নিয়ে কিছু বলতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই মহান উপাচার্য। সিদ্দিকুর যদি চাকরি করতে চান, তবে সেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন নয়? কিংবা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। সিদ্দিকুর কি প্রকারান্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধের বলি নয়? কিংবা আরও স্পষ্ট করলে দুই উপাচার্যের দ্বন্দ্বের খেসারত রক্ত দিয়ে দৃষ্টি হারিয়ে তাঁকে দিতে হচ্ছে না কি?

একটা বিষয় কিছুতেই মাথায় আসে না, যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজেরই সমস্যার শেষ নেই, এশিয়ার সেরা শত বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নেই, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যখন নিজের চরকায় তেল দিতে বেশি মনোযোগ প্রয়োজন, তখন কেন ঢাকার আরও সাতটি বড় কলেজ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হলো? কী প্রয়োজন ছিল? কার বা কাদের স্বার্থ এখানে আসন গেড়ে বসল? কী সেই স্বার্থ?

একটি বিষয় স্পষ্ট যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এই সাতটি কলেজ ছাড়তে চায়নি। গত ২৪ জুলাই  একটি দৈনিকে খবরে দেখছি, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের তাগিদ ও সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় এ বছর সংশ্লিষ্ট অধ্যক্ষদের সভায় কলেজগুলোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়।’

প্রকৃতপক্ষে এমন এক সময়ে এই সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছে, যখন প্রয়োজন যথেষ্ট ফুরিয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৬ সাল থেকে তিন বছর মেয়াদি ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম’ হাতে নিয়েছিল এবং এতে সেশনজটের বিষফোড়া প্রায় অপসারিত হয়েছিল। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি ও পরীক্ষার ফল প্রকাশে ওয়েবভিত্তিক সেবায় যথেষ্ট দক্ষতা দেখিয়ে যাচ্ছিল। তবে কেন এমন ক্ষতিকর সিদ্ধান্ত?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর অধিভুক্ত কলেজগুলোতে এই মুহূর্তে যত শিক্ষার্থী আছেন, নতুন আসা সাত কলেজের শিক্ষার্থী এর দ্বিগুণ। তাহলে কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে এই বিপুল শিক্ষার্থীর ভার নেওয়া সম্ভব?

সিদ্দিকুরদের আন্দোলনে না নেমে কোনো উপায় প্রকৃতপক্ষে ছিল না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য কলেজের ছেলেমেয়েরা যেখানে মাস্টার্সে ভর্তির অপেক্ষা করছেন, সেখানে এই সাত কলেজের ছেলেমেয়েরা এখনো অনার্সের ফলই পাননি। ৩৮তম বিসিএসে তাঁদের অংশ নেওয়া অনিশ্চিত, যে পরীক্ষার জন্য তাঁরা মুখিয়ে থাকেন সারাটা বছর। আমরা দেখলাম, ফল প্রকাশের জটিলতা নিয়ে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বিস্তর চিঠি চালাচালি হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দোষ চাপাল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর। আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর। এই শিশুসুলভ চাপান-উতোরের মধ্য দিয়ে সময়ের নদী গড়িয়েই চলল। এ অবস্থায় সাত কলেজের ছেলেমেয়েরা কেবল সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কাটাবেন, এটা ভাবা কি বিলাসিতা নয়?

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন একাধিক কলেজের ছাত্রাবাস পরিদর্শন করে দেখেছি, শিক্ষার্থীরা অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে এসব ছাত্রাবাসে থাকেন। যেখানে দুজনের থাকতে কষ্ট হয়, সেখানে থাকেন চারজন। পুষ্টিকর খাবারের বন্দোবস্ত নেই। গোসলের সমস্যা। অথচ শিক্ষায় তাঁদের বিনিয়োগও কম নয়। তাঁরাও স্বপ্ন দেখেন, লেখাপড়া শিখে দেশের কল্যাণে কাজ করবেন।

যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন বা পড়ছেন, তিনি ভাগ্যবান। আর যিনি কলেজে পড়ছেন বা পড়েছেন, প্রথমত সেটা কোনো দোষের নয়। দ্বিতীয়ত, তিনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারেননি, এটা তাঁর ব্যর্থতা নয়। রাষ্ট্রই তাঁকে সংস্থান করে দিতে পারেনি। অনেক ছেলেমেয়ে উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফল করা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারেন না কেবল আর্থিক টানাপোড়েনের কারণে। এটাই বাস্তবতা। এটাই বাংলাদেশ। তাঁদের কষ্ট আমরা ছুঁয়ে দেখতে না পারি, তাঁদের যেন অবহেলা না করি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু সাত কলেজকে অধিভুক্ত করেছে, যদি এই সাত কলেজকে শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দেওয়া না হয়, এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত হবে দ্রুত একটি কাঠামো তৈরি করা। যে কাঠামোর ভেতর দিয়ে এই সাত কলেজের সিলেবাস প্রণয়ন, খাতা মূল্যায়ন, ফল প্রকাশের মতো বিষয়গুলো (যতটা তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়) নির্ধারিত সময়ে শেষ করা যায়। আর অধিভুক্ত কলেজগুলোর দেখভাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঠিকমতো করতে পারছে কি না, তা দেখার জন্য একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করা যায় কি না, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ভেবে দেখতে পারে।

একজন সিদ্দিকুরের চোখের আলো দপ করে নিভে গেছে। এ দেশের লাখো শিক্ষার্থীর স্বপ্নের বাতি যেন দেশজুড়ে নেমে আসা কোনো আঁধারে নিভে না যায়। ক্ষমতাবান কর্মকর্তাদের বিরোধের ‘ক্রসফায়ারে’ তাঁদের ভাগ্যরেখা যেন আর কাটা না পড়ে।

কাজী আলিম-উজ-জামান: সাংবাদিক

সৌজন্যে : প্রথম আলো।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী - dainik shiksha গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট - dainik shiksha জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ - dainik shiksha আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0027601718902588