পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে অসমতা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

দেশে বেশকিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে বিগত কয়েক বছরে। অনেক জেলায় একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। মফস্বল এলাকায়ও কিছু বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। আবার অনেক জেলায় একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ও নেই। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে যে বিশ্ববিদ্যালয় হতে হবে এমন কথাও নেই। আসলে দরকার উচ্চশিক্ষার সুযোগ, মানসম্মত সুযোগ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে অসমতা রয়েছে এ কথা যেমন ঠিক তেমনি উচ্চশিক্ষার বিস্তারে সক্ষম ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার মানসিকতাও দৃশ্যমান নয়। সারকথা হলো উচ্চশিক্ষায় হ-য-ব-র-ল দশা বিদ্যমান। শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) দেশ রুপান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শরীফুল আলম সুমন।

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি পূরণে অনেক জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। যেসব এলাকায় প্রভাবশালী রাজনীতিক রয়েছেন, সেখানে তো বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছেই। অনেক এলাকা যে অবহেলিত থেকে যাচ্ছে, সেদিকে খুব একটা নজর আছে বলে মনে হয় না। ফলে অঞ্চলভেদে শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষায় বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। অনেক দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন না। 

এই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, “যে আইনে ইউজিসি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেই আইন ‘ইউজিসি অর্ডিন্যান্স ১৯৭৩’-এর ‘প্রেসিডেন্ট অর্ডার ১০’-এ বলা হয়েছে, নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরকার ইউজিসির পরামর্শ নেবে। কিন্তু সবক্ষেত্রে ইউজিসির পরামর্শ নেওয়া হয় না, মাঝেমধ্যে নেওয়া হয়। কোথায়, কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয় হবে, তার ব্যাপারে ইউজিসির পরামর্শ নেওয়া হলে অসমতা তৈরির সুযোগ থাকত না।”

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর আরও বলেন, ‘সরকারকেও অনেক সময় রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হয়। বর্তমান সরকার সব জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া চলছে এখনো।’   

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৫৮টি। এসবের মধ্যে ৫টি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসকদের স্নাতকোত্তর ও উচ্চতর ডিগ্রি দেওয়া হয়। সাধারণ, কৃষি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কয়েকটির শিক্ষা কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। এই ৫৮টি বিশ্ববিদ্যালয় ৩৪ জেলায় অবস্থিত। বাকি ৩০ জেলায় কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই।

সূত্র জানায়, ৭ জেলায় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া চলছে। জেলাগুলো হলো সাতক্ষীরা, শরীয়তপুর, নারায়ণগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, পিরোজপুর, ঠাকুরগাঁও ও নাটোর। এসব জেলায় নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের লক্ষ্যে আইনের খসড়া ইতিমধ্যে ইউজিসি থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে একাধিক নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হলেও অনেক জেলা বৈষম্যের শিকার। বৃহত্তর ফরিদপুরের পাঁচ জেলা ফরিদপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ীতে মাত্র একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে  গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশের ৮ বিভাগের প্রত্যেক বিভাগীয় শহরে এক বা একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়  রয়েছে। আরও নতুন দুটি বিভাগ গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। এগুলো হচ্ছে কুমিল্লা অঞ্চলে ‘ময়নামতি বিভাগ’ আর ফরিদপুর অঞ্চলে ‘পদ্মা বিভাগ’। নতুন প্রক্রিয়াধীন দুটি বিভাগের একটির সদরে ‘কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়’ রয়েছে। প্রস্তাবিত পদ্মা বিভাগের বিভাগীয় সদরে অর্থাৎ ফরিদপুরে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই। ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও আকারে-আয়তনে বড় এবং মানেও অনেক ভালো। এই কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা ফরিদপুরবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি। কিন্তু এ ব্যাপারে তেমন উদ্যোগ নেই সরকারের।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যার হিসাবে সবচেয়ে এগিয়ে আছে ঢাকা জেলা, এখানে বিশ্ববিদ্যালয় ১০টি। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে গাজীপুর বিশ্ববিদ্যালয় ৫টি। তৃতীয় অবস্থানে আছে চট্টগ্রাম ও খুলনা জেলা ৪টি করে বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। তবে যেসব বিভাগীয় শহরে বিশ্ববিদ্যালয় বেশি, ওই বিভাগের অন্যান্য জেলায় আবার বিশ্ববিদ্যালয় কম। 

ঢাকা বিভাগে ১৩টি জেলা। এই বিভাগেই সর্বোচ্চ ১৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সেসবের মধ্যে ৯টি ঢাকা শহরে এবং গাজীপুর শহরে ৫টি। এছাড়া সাভার (ঢাকা), কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গোপালগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বাকি ৭ জেলায় কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই। সেগুলো হলো নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী ও শরিয়তপুর।

চট্টগ্রাম বিভাগে ১১টি জেলা। এই বিভাগে ৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। চট্টগ্রামে ৪টি এবং চাঁদপুর, রাঙ্গামাটি, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও লক্ষ্মীপুরে একটি করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এই বিভাগের ৫ জেলায় কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই। সেগুলো হলো কক্সবাজার, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, ফেনী, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি।

খুলনা বিভাগে ১০টি জেলা। এই বিভাগে ৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। খুলনায় ৪টি এবং যশোর, কুষ্টিয়া ও মেহেরপুরে একটি করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বাকি ৬ জেলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই। সেগুলো হলো বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, নড়াইল, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা।

রাজশাহী বিভাগে ৮টি জেলা। এই বিভাগে ৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। রাজশাহীতে ৩টি এবং পাবনা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও নাটোরে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বাকি ৩ জেলায় কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই। সেগুলো হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট ও নওগাঁ। তবে সম্প্রতি ‘বঙ্গবন্ধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়-নওগাঁ, আইন ২০২২’-এর নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।

বরিশাল বিভাগে ৬টি জেলা। এই বিভাগে ৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এগুলো বরিশাল, পটুয়াখালী ও পিরোজপুরে অবস্থিত। বাকি ৩ জেলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই। সেগুলো হলো ঝালকাঠি, বরগুনা ও ভোলা।

সিলেট বিভাগে ৪টি জেলা। এই বিভাগে ৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ৩টি সিলেটে এবং হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জে একটি করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এই বিভাগের মৌলভীবাজার জেলায় কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই।

রংপুর বিভাগে ৮টি জেলা। এই বিভাগে ৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। রংপুর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বাকি ৪ জেলায় কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই। সেগুলো হলো নীলফামারী, পঞ্চগড়, গাইবান্ধা ও ঠাকুরগাঁও। সম্প্রতি ‘ঠাকুরগাঁও বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০২২’-এর নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। 

ময়মনসিংহ বিভাগে ৪টি জেলা। এই বিভাগে ৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ময়মনসিংহে ২টি এবং নেত্রকোনা ও জামালপুরে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এই বিভাগের শুধু শেরপুর জেলায় কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়  নেই।

এখন দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১০৯টি। ৩০ জেলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় না থাকলেও এসবের অনেকগুলোতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। তবে জেলা পর্যায়ের বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের  মান খুবই খারাপ। নেই প্রয়োজনীয় পরিসর, শিক্ষক, লাইব্রেরি ও ল্যাবরেটরি। অনেকে এসব বিশ্ববিদ্যালয়কে কোচিং সেন্টারের সঙ্গে তুলনা করেন। এসবে আবার উচ্চ টিউশন ফি দিতে হয়। ফলে শিক্ষার্থীরা সেখানে যেতে আগ্রহী নন।  

নতুন অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হলেও তা অগোছালো। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় চলছে ভাড়াবাড়িতে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নেই। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ করতে পারছে না। আবার কোনো বিশ্ববিদ্যালয় স্বল্প পরিসরে অপরিকল্পিতভাবে নিজস্ব ক্যাম্পাসে গেলেও তারা উচ্চশিক্ষার ন্যূনতম সুযোগ ও মান নিশ্চিত করতে পারছে না। বেশকিছু সময় পার হলেও তারা নামেমাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, যা সংশ্লিষ্ট এলাকার শিক্ষার্থীদের তেমন কাজে লাগছে না।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান বলেন, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মানে জনগণের অর্থে তা হচ্ছে। কাজেই এই অর্থ কোথায় খরচ হচ্ছে তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখতে হবে। এখন যেসব পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে, তার বেশিরভাগ রাজনৈতিক কারণে হচ্ছে। আমাদের আর সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের দরকার নেই। প্রয়োজন টেকনিক্যাল ও ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট। এগুলো বিশ্ববিদ্যালয় না হলেও চলবে।’ 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ - dainik shiksha ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত - dainik shiksha টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0059189796447754