পার্কে ছাত্রীকে শাসন করার দায়িত্ব কি সাংসদের?

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বাংলাদেশের নোয়াখালীতে একজন সংসদ সদস্য পার্কে সময় কাটাতে থাকা কলেজ পড়ুয়া যুগলদের ভর্ৎসনা করে তাদের ছবি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করার পর তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা চলছে।

নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী মঙ্গলবার নোয়াখালী শহরের একটি পার্কে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইউনিফর্ম পরা দু'টি যুগলকে গালমন্দ করেন এবং ছবি তুলে ফেসবুকে পাতায় আফলোড করেন।বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) বিবিসিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন নাগিব বাহার।

আরও পড়ুন: পার্ক থেকে শিক্ষার্থীদের পুলিশে দিলেন এমপি

ঐ ঘটনা নিয়ে তিনি বলেন, "ঘটনাক্রমে ঐদিন পার্কটির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় স্কুল বা কলেজের পোশাক পরা অবস্থায় দু'টি যুগলকে দৃষ্টিকটু ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখলে সেখানে গিয়ে তাদের ভর্ৎসনা করি এবং সেখান থেকে চলে যেতে বলি। আর সাবধান করার জন্যই দ্বিতীয় যুগলটির ছবি ফেসবুকে পোস্ট করি।"

ঐ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে যেখানে দেখা যায় একরামুল করিম চৌধুরী কয়েকজন পুলিশ সদস্য নিয়ে পার্কে অবস্থানরত কয়েকটি যুগলকে বকাঝকা করছেন।

একপর্যায়ে কলেজ ইউনিফর্ম পরা এক কিশোরীর বাবার ফোন নম্বর জানতে চেয়ে ঐ কিশোরীকে হুমকি দেন যে ফোন নম্বর না দিলে তাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হবে।

তিনি বলেন, ঐ কিশোরীকে 'ভয় দেখানোর' জন্য ঐ হুমকি দিয়েছিলেন তিনি।

পুলিশ সাথে করে পার্কে বসা যুগলদের সতর্ক করা একজন জনপ্রতিনিধির দায়িত্বের মধ্যে পড়ে কিনা - এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং সংগঠক হিসেবে এলাকার নৈতিক অবক্ষয় রোধে ঐ ধরণের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি।

"আমার সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে সেদিন সেখানে উপস্থিত কিশোর-কিশোরীদের সতর্ক করেছিলাম।"

আর আইন অনুযায়ী এরকম পদক্ষেপ তিনি নিতে পারেন কিনা - সে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে সেখানে উপস্থিত কিশোর-কিশোরীদের সতর্ক করেছেন।

সাথে পুলিশ কেন নিয়ে গিয়েছিলেন - এ প্রশ্ন কর হলে একরামুল করিম চৌধুরী বলেন, নিরাপত্তার স্বার্থে ঐসময় তার সাথে পুলিশ ছিল, তিনি আলাদাভাবে পুলিশ নিয়ে সেখানে অভিযানে যাননি।

তবে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে যে বিষয়টি নিয়ে, তা হলো সেদিন পার্কে থাকা কয়েকজনের ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া।

জোরপূর্বক কিশোর কিশোরীদের ছবি তুলে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করা আইনগত-ভাবে অপরাধ হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, "আমি কোনো অপরাধ করিনি।" তিনি মন্তব্য করেন, ফেসবুকে ছবি পোস্ট করার মাধ্যমে তিনি নোয়াখালীর মানুষের প্রতি একটি বার্তা পাঠাতে চেয়েছেন।

একরামুল করিম চৌধুরীর ফেসবুক পাতায় পার্কের ঐ ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়নি, তবে গত ৬ই জুলাই তার ফেসবুকে পোস্ট করা একটি ছবিতে দেখা যায় 'মেয়েদের উত্যক্ত' করার অভিযোগে তিনি একটি রাস্তায় জনসমক্ষে দুই কিশোরকে কান ধরে ওঠবস করাচ্ছেন।

একজন এমপির অধিকারের সীমা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক সামিনা লুৎফার মতে, পার্কে সময় কাটানো কিশোর কিশোরীদের ভর্ৎসনা করে সাংসদ একরামুল করিম চৌধুরী ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেছেন।

"আমি মনে করি মি, চৌধুরীকে বাংলাদেশের আইন এই বৈধতা দেয়নি যে তিনি পার্কে গিয়ে ছেলেমেয়েদের হুমকি দেবেন। ছেলেমেয়েরা পার্কে কখন বা কার সাথে যাবে, সেবিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অধিকার একজন সাংসদের নেই। এক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে পারে শুধুমাত্র তাদের পরিবার।"

মিজ. লুৎফার মতে, সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেও সাংসদের উচিত হয়নি পার্কে থাকা কিশোর কিশোরীদের হেনস্থা করা।

"আমাদের সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও কিছু সীমানা রয়েছে। আমরা নিশ্চয়ই চাইলেই আমাদের প্রতিবেশীর সন্তানকে বকা দিতে পারি না। সেই দায়িত্ব শুধুমাত্র বাবা মা'র এবং আইনগত-ভাবে সিদ্ধ অভিভাবকদের।"

"আর কলেজের পোশাক পরা অবস্থায় তারা পার্কে গিয়ে থাকলে কলেজের শিক্ষক বা প্রশাসনের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে তাদের সতর্ক করা, সাংসদের নয়।"


আর সামাজিক মাধ্যমে ছবি পোস্ট করে তিনি শুধু নৈতিকভাবে নয়, আইনগত-ভাবেও অপরাধ করেছেন বলে মনে করেন সামিনা লুৎফা।

মিজ. লুৎফা মনে করেন ছবি তুলে বিনা অনুমতিতে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে অপরাধ করেছেন সংসদ সদস্য একরামুল করিম।

"অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের ছবি পোস্ট করে তিনি যে তাদের সামাজিকভাবে হেনস্থা করলেন, এরপর যদি তারা নিজেদের নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগে বা আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে - যা এই বয়সী কিশোর কিশোরীদের জন্য স্বাভাবিক - তাহলে কি তাদের দায়িত্ব তিনি নিবেন?"

সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী কলেজ-পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ক্লাস বাদ দিয়ে পার্কে সময় কাটানোকে যে পদ্ধতিতে নিরুৎসাহিত করেছেন, তার সমালোচনা করলেও ফেসবুকে ছবি পোস্ট করায় কোনো সমস্যা দেখছেন না আইনজীবী নূর জান্নাতুল কারার।

"একজন জনপ্রতিনিধি কিন্তু তার এলাকার অনেক রকম দায়িত্বই পালন করতে পারেন। সামাজিক বা নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে এ ধরণের দায়িত্ব পালন করতেই পারেন তিনি। এটি আইনের লঙ্ঘন নয়, তবে আমি মনে করি তার পদ্ধতিটিও সঠিক নয়।"

মিজ. কারার বলেন, "এই বয়সে কিশোররা স্বাভাবিকভাবেই অনেক ভুল করে, কিন্তু এভাবে অপমান করে বা সামাজিক মাধ্যমে তাদের ছবি ছড়িয়ে দিয়ে তাদের ভুল শোধরানো সম্ভব নয়।"

বিষয়টি এভাবে প্রচার না করে এমপি মি চৌধুরী কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে সতর্ক করে তাদের অভিভাবকদের কাছে হস্তান্তর করতে পারতেন - যেটি তাদের সংশোধনের ক্ষেত্রে আরো কার্যকর ভূমিকা পালন করতো বলে মনে করেন মিজ. কারার।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কিরগিজস্তানে বাংলাদেশি ১২শ’ শিক্ষার্থীর আতঙ্কে দিন কাটছে - dainik shiksha কিরগিজস্তানে বাংলাদেশি ১২শ’ শিক্ষার্থীর আতঙ্কে দিন কাটছে বিলেত সফরে শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha বিলেত সফরে শিক্ষামন্ত্রী ডলার সংকটে কঠিন হচ্ছে বিদেশে উচ্চশিক্ষা - dainik shiksha ডলার সংকটে কঠিন হচ্ছে বিদেশে উচ্চশিক্ষা সুপাড়ি চুরির সন্দেহে দুই ছাত্রকে নির্যা*তন - dainik shiksha সুপাড়ি চুরির সন্দেহে দুই ছাত্রকে নির্যা*তন ডক্টরেট ডিগ্রি পেলো বিড়াল - dainik shiksha ডক্টরেট ডিগ্রি পেলো বিড়াল নামী স্কুলগুলোর ফলে পিছিয়ে পড়ার নেপথ্যে - dainik shiksha নামী স্কুলগুলোর ফলে পিছিয়ে পড়ার নেপথ্যে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0044269561767578