পিএসসির বাড়তি মুনাফার প্রয়োজন কেন

ইসহাক খান |

আজকাল সরকারি-বেসরকারি যেখানেই চাকরির বিজ্ঞাপন দেওয়া হোক, সেখানে বিশেষভাবে উল্লেখ থাকে পে-অর্ডার বা ট্রেজারি চালানের সংযুক্তি। না হলে আবেদনপত্র গ্রহণযোগ্য হবে না। বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যারা লোক নেবে ১০ জন। বিজ্ঞাপনে বড় বড় করে জানান দিয়ে চাওয়া হয় পে-অর্ডারসহ দরখাস্ত। দরখাস্ত জমা পড়ে কয়েক লাখ। যে ১০ জন কর্মচারী নিয়োগ করা হলো তাদের বেতন সেই পে-অর্ডারের টাকায় চলল কয়েক বছর। খুব মুনাফাধারী ব্যবসা। এমন সহজ লাভজনক ব্যবসা লাখ লাখ বেকারের দেশ এই বাংলাদেশেই সম্ভব। নির্বিঘ্নে সবাই যার যার মতো ব্যবসা করে যাচ্ছে। কেউ দেখার নেই। বাধা দেওয়ারও কেউ নেই। কিছুদিন আগে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো ভর্তি ফি হিসেবে বাড়তি টাকা নিলে এ নিয়ে ব্যাপক লেখালেখি হয়। তখন শিক্ষামন্ত্রী কড়া ভাষায় হুঙ্কার দিয়ে বললেন, বাড়তি টাকা ফেরত দিতে হবে। না হলে চরম ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু মন্ত্রী মহোদয়ের এই কড়া হুঙ্কারে কোনো কাজ হয়নি। যারা ভর্তির বাড়তি ফি নিয়েছে তারা কেউ একটি টাকাও ফেরত দেয়নি। তাদের ভাবখানা যে এমন হুঙ্কার কত দেখলাম। তারাও জানে যত গর্জে তত বর্ষে না।

এবার আসা যাক পিএসসির ভূমিকা নিয়ে। পিএসসি শুধু বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেওয়া প্রার্থীদের কাছ থেকেই সংস্থাটি আদায় করে নিচ্ছে খরচের তিন গুণ টাকা, যা চূড়ান্ত হিসেবে সংস্থাটির মুনাফা যোগ হচ্ছে সরকারের কোষাগারে।বিপুল এই মুনাফার ফলে পরীক্ষার আবেদনপত্র বাছাই, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, উত্তরপত্র মূল্যায়ন, পুনরোত্তরপত্র পরীক্ষণ, স্ক্রুটিনাইজার, মৌখিক পরীক্ষায় বিশেষজ্ঞদের সম্মানী, পরীক্ষা হলের পরিদর্শক, অফিস সহায়ক, পরীক্ষার সময় নিরাপত্তায় নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, গার্ডদের সম্মানী বাড়িয়ে দ্বিগুণ করতে ২৩ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন [বিপিএসসি]। এ জন্য বিসিএস পরীক্ষার্থীদের ফি বাড়ানো হয়েছে। ৩৪তম বিসিএস পর্যন্ত আবেদনকারীদের কাছ থেকে ৫০০ টাকা ফি নিত বিপিএসসি। তাতেও সব খরচ শেষে মুনাফা হতো সংস্থাটির। তা সত্ত্বেও ৩৫তম বিসিএসের বিজ্ঞাপনে আবেদনকারীদের কাছ থেকে ৭০০ টাকা করে ফি নেওয়ার সিদ্ধান্ত কার্যকর করে সংস্থাটি। ফলে পরীক্ষা নেওয়ার সব কার্যক্রমের খরচ ওই ফি থেকে বহন করার পরও ৩৪তম বিসিএসের তুলনায় ৩৫তম বিসিএসে মুনাফা তিন গুণ বেড়েছে। আর ২০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি পরীক্ষাতেই ৯০ শতাংশ প্রার্থী বাতিল করায় লিখিত পরীক্ষায় বিপিএসসির খরচ অনেক কমে গেছে। ফলে ৩৩তম ও ৩৪তম বিসিএসের তুলনায় ৩৫তম বিসিএস সম্পন্ন করতে প্রতিষ্ঠানটির খরচ কম হয়েছে। ৩৫তম বিসিএসে দুই লাখ ৪৪ হাজার ১০৭ জন প্রার্থী আবেদন করেন।

২০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা শেষে ২০ হাজার ৩৯১ জনকে টেকানো হয়। অর্থাৎ প্রতি ১০০ জন আবেদনকারীর মধ্যে ৯২ জন ৭০০ টাকা করে ফি দিয়ে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা শেষেই বাদ হয়ে যান। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ছয় হাজার ৮৮ জন। যেখান থেকে দুই হাজার ১৫৮ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করে বিপিএসসি। মোট ১৩ ক্যাটগিরিতে সংশ্লিষ্টদের সম্মানী বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর পেছনে যুক্তি দেখানো হয়েছে, নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন মডারেশনের কাজে অবসরপ্রাপ্ত সচিবরা এ কাজ করে থাকেন। তাঁরা কোনো টিএ-ডিএ পান না। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ এ ধরনের স্পর্শকাতর কাজ সম্পাদনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের ধার্য করা পারিতোষিক বর্তমান বাজার মূল্যে অপ্রতুল হওয়ায় এই অপ্রতুল অর্থ প্রাপ্তিতেও দীর্ঘসূত্রতা থাকায় উচ্চপদস্থ, অভিজ্ঞ, খ্যাতিমান বিশেষজ্ঞরা এ ধরনের কাজে অনীহা প্রকাশ করে আসছেন। খুবই অকাট্য যুক্তি।

তাঁরা অতি মূল্যবান ব্যক্তি। তাঁরা কেন এত কম মূল্যে তাঁদের মেধা বিক্রি করবেন! তাঁদের আরো সম্মানী বাড়িয়ে দেওয়া হোক। তাঁরা যেহেতু একসময় সচিব ছিলেন, তাঁরা বোঝেন তাঁদের কাজের কী মূল্য! তাঁদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হোক। তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। থাকার কথাও নয়। তাঁরাই দেশ চালান। একটি রসাল কথা এখানে উল্লেখ না করে পারছি না। বিপিএসসি প্রস্তাবে বলা হয়েছে অর্থপ্রাপ্তির দীর্ঘসূত্রতার কথা। অর্থাৎ আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। এই আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কারা তৈরি করেন? যাঁরা তৈরি করেন আজ তাঁরাই সেই আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়েছেন। এবং তাঁদের অর্থ ছাড়ের কাজটি করেন আমলারা। তাহলে অর্থপ্রাপ্তির দীর্ঘসূত্রতা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু আগের হাল যেদিকে যায় পেছনের হালও সেদিকে যায়—এ নীতিতে বর্তমান আমলারা কাজ করে যাচ্ছেন। অর্থপ্রাপ্তির দীর্ঘসূত্রতার জন্য কোনো পরীক্ষাপ্রার্থী দায়ী নয়। জনগণকেও দায়ী করার কোনো সুযোগ নেই। তাহলে এ প্রশ্ন উঠছে কেন? নিজেদের কাটা খালে আজ তাঁরা নিজেরাই পড়ে গেছেন। আর তাতেই যত কথা। তাঁদের পারিতোষিক বাড়িয়ে তিন গুণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আমাদের তাতে মোটেও আপত্তি নেই। তাঁদের বরং পাঁচ গুণ পারিতোষিক বাড়ানো হোক। যাতে কাজটি আরো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়।

কিন্তু তার জন্য সাধারণ মানুষকে মাসুল দিতে হবে কেন? মনে রাখতে হবে, বিসিএস পরীক্ষায় কারা অংশ নেয়? কোনো উচ্চবিত্তের সন্তান কিংবা কোনো শিল্পপতির সন্তান এ ধরনের আমলাগিরি করার মানসিকতা রাখে না। এই ক্যাডার সার্ভিস পরীক্ষায় যারা অংশ নেয় তাদের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। তাদের অনেকের পরীক্ষার ফি বাবদ ৭০০ টাকা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ৫০০ টাকা দিতেই অনেকের পরিবারে ঘাম ছুটে যায়। সেখানে আরো ২০০ টাকা বাড়তি দেওয়া মানে বোঝার ওপর শাকের আঁটি। অভিজ্ঞ সাবেক সচিবদের পারিতোষিকের টাকা সরকারি কোষাগার থেকে দিলে তাতে কি সরকার দেউলিয়া হয়ে যাবে? তা না করে নিম্নবিত্তদের ঘাড়ে ফির বোঝা চাপিয়ে তাদের টুঁটি চেপে ধরার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। দেশ আমলারা চালান। তাঁদের যা ইচ্ছা সেভাবে দেশ চালাবেন, সেটা পুরোপুরি কিভাবে আমরা মানব? দেশটা কি শুধু তাঁদের? এই দেশ মুক্তিযুদ্ধের ফসল। অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধার পরিবারে নুন আনতে পান্তা ফুরায়।

তাঁদের ঘাড়ে আর কত বন্দুক রেখে আপনারা ফায়ার করবেন? এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ৩৫তম বিসিএসে ফি থেকে আয় ১৫ কোটি ৯ লাখ দুই হাজার ৭০৩ টাকা। পরীক্ষায় সমুদয় ব্যয় চার কোটি ৫০ লাখ। মুনাফা হয়েছে, ১৯ কোটি ৫৯ লাখ দুই হাজার ৭৩০ টাকা। এই মুনাফার টাকা জমা হচ্ছে সরকারের কোষাগারে। কেন গরিবের ঘাড়ে ফির বোঝা চাপিয়ে সরকার ব্যবসা করবে! বিপিএসসি কি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান? কেন তারা নিম্নমধ্যবিত্তের টাকায় কোষাগার ভরবে? বিপিএসসির এই প্রস্তাব সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। আমরা মনে করি, বিসিএস পরীক্ষার জন্য ফি বাবদ ৫০০ টাকাই অতিরিক্ত। তার ওপর আরো ২০০ টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৭০০ টাকা। এই অযৌক্তিক সিদ্ধান্তে অর্থ মন্ত্রণালয় বিশেষভাবে বিবেচনা করবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করে। আমরাও চাই বিসিএস পরীক্ষার জন্য কোনো পরিবারকে যেন সহায় সম্বল বিক্রি করে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না হয়।

সুত্র: কালের কন্ঠে উপসম্পাদকীয়


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় - dainik shiksha কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির - dainik shiksha বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ - dainik shiksha ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ - dainik shiksha সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ - dainik shiksha নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.002957820892334