প্রায় অর্ধেক শিক্ষকই সৃজনশীলে দক্ষ নন

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতি চালু হলে শিক্ষার্থীরা চিন্তাশক্তি দিয়ে বুঝে শিখবে, মুখস্থবিদ্যা এবং নোট-গাইড থাকবে না—এমন নানা আশার কথা শোনানো হলেও বাস্তবে এখনো এই শিক্ষার চর্চা ঠিকমতো হচ্ছে না। আর হবেই–বা কীভাবে; প্রায় অর্ধেক শিক্ষকই তো এখনো এ বিষয়ে দক্ষ নন। আরও আশঙ্কার কথা হলো, সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির চর্চার দিনে দিনে যেখানে উন্নতি হওয়ার কথা ছিল, সেখানে অবনতি হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১২ নভেম্বর) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন মোশতাক আহমেদ। 

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) সর্বশেষ তদারকি প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ৪৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক এখনো ঠিকভাবে সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন করতে পারছেন না। এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা অন্যান্য বিদ্যালয়ের সহায়তায় কিংবা বাইরে থেকে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করেন। এই পদ্ধতিতে শিক্ষকদের সঠিকভাবে প্রশ্ন প্রণয়ন করার হার দেড় বছরের ব্যবধানে প্রায় ৩ শতাংশ কমেছে।

মাউশির মহাপরিচালক সৈয়দ গোলাম ফারুক বলেন, এই সমস্যার বড় কারণ সব শিক্ষক পর্যাপ্ত যোগ্য নন। সবাই বিএড কোর্সও করতে পারছেন না। আবার সৃজনশীলের প্রশিক্ষণও সবাইকে দেওয়া যায়নি। আরেকটি বিষয় হলো, বিষয়টিও একটু কঠিন। এ জন্য পদ্ধতিটি পরিমার্জন করে আরও সহজ করার বিষয়ে আলোচনা চলছে।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে গত ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছুটি চলছে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে দেশের ৯ হাজার ৯৩০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় তদারক করে সর্বশেষ ‘একাডেমিক সুপারভিশন প্রতিবেদন’ তৈরি করে মাউশি। বর্তমানে দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে ১৮ হাজার ৫৯৮টি। মোট বিদ্যালয়ের ৫৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ তদারক করা হয়।

দেশে ২০০৮ সালে মাধ্যমিক পর্যায়ে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়। পরে ২০১২ সালে প্রাথমিক স্তরেও যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্ন (সৃজনশীল) পদ্ধতি চালু হয়। নীতিনির্ধারকেরা বলেছিলেন, এই পদ্ধতি চালু হলে মুখস্থবিদ্যা কমবে এবং শিক্ষার্থীদের বুঝে শেখার দক্ষতা বাড়বে। কিন্তু শুরু থেকেই এই পদ্ধতির প্রয়োগ নিয়ে বিতর্ক চলছে। এখন অভিভাবক এবং একাধিক শিক্ষাবিদ বলছেন, শিক্ষকেরাই ঠিকমতো এই পদ্ধতি রপ্ত করতে না পারায় শিক্ষার্থীদের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

সৃজনশীল পদ্ধতিতে একটি বিষয়কে চার ভাগে ভাগ করে প্রশ্ন করা হয়। বর্তমানে পরীক্ষায় প্রতিটি বিষয়ে মোট নম্বরের মধ্যে ৭০ শতাংশ নম্বরের প্রশ্ন সৃজনশীলে এবং ৩০ নম্বরের প্রশ্ন করা হয় বহুনির্বাচনী প্রশ্নে।

মাউশির সর্বশেষ তদারকি প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২৯ দশমিক ৬২ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক অন্য বিদ্যালয়ের সহায়তায় সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন করেন। আর বাইরে থেকে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করেন এমন বিদ্যালয়ের হার ১৫ দশমিক ১৪ শতাংশ। এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা মূলত গাইড বা স্থানীয় শিক্ষক সমিতির কাছ থেকে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করেন। এখন ৫৫ দশমিক ২৫ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিজেরাই প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারেন।

অথচ দেড় বছর আগে ২০১৮ সালের জুলাই মাসের তদারকি প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, তখন পর্যন্ত ৫৮ দশমিক ১২ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিজেরা প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারতেন। তুলনামূলক চিত্র বলছে, অন্য বিদ্যালয়ের সহায়তায় প্রশ্ন করার হার বেড়েছে। বাইরে থেকে প্রশ্নপত্র সংগ্রহের হারও প্রায় একই আছে।

ব্যানবেইসের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে মাধ্যমিক স্তরে ১ কোটি ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৩২৩ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এই স্তরে শিক্ষক প্রায় আড়াই লাখ। মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর বিনিয়োগ কর্মসূচির (সেসিপ) অধীনে সৃজনশীল শিক্ষার বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিন্তু এই প্রশিক্ষণ হয় নামমাত্র।

বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি ঢাকার গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. আবু সাঈদ ভূঁইয়া বলেন, অনেক শিক্ষকই প্রশিক্ষণ থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা ঠিকমতো চর্চা করেন না। এ পদ্ধতির চর্চার জন্য তদারকি বাড়াতে হবে।

তদারকি প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, এই পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র তৈরির ক্ষেত্রে খুলনা অঞ্চলের শিক্ষকেরা এগিয়ে আছেন। এই অঞ্চলের ৬৬ দশমিক ৪২ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিজেরাই প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারেন। এর আগে দেখা গিয়েছিল, চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এই পদ্ধতিতে প্রশ্ন প্রণয়নে এগিয়ে। আগের মতো এবারও উঠে এসেছে, বরিশাল অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকেরা এই পদ্ধতিতে কম প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারেন। এখানকার ৩৬ শতাংশের কিছু বেশি বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিজেরা প্রশ্ন করতে পারেন। তবে তা আগের চেয়ে প্রায় ৬ শতাংশ বেশি। বাইরে থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করার ক্ষেত্রেও শীর্ষে এই এলাকার বিদ্যালয়গুলো।

অন্য বিদ্যালয়ের সহায়তায় প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলো এগিয়ে। ওই এলাকার ৪৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা অন্য বিদ্যালয়ের সহায়তায় প্রশ্ন করেন। তবে বাইরে থেকে সবচেয়ে কম প্রশ্ন সংগ্রহ করে এই অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলো। আর অন্য বিদ্যালয়ের কম সহায়তা নেন সিলেট অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলো, প্রায় ২৩ শতাংশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের ঠিকমতো সৃজনশীল শিক্ষার চর্চা না করিয়ে পরীক্ষার প্রশ্নের ওপর জোর দেওয়ায় নানা সমস্যা তৈরি হয়েছে। আর কাজটি করার জন্য সবার আগে শিক্ষকদের তৈরি করা দরকার, কিন্তু সেটি করা যায়নি।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী - dainik shiksha গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট - dainik shiksha জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ - dainik shiksha আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.00341796875