১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘সিংহলে (বর্তমান শ্রীলঙ্কা) এমএ ডিগ্রি লাভ পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা লাভের সুযোগ পায়। অথচ আমাদের দেশের এমনকি প্রাথমিক শিক্ষালাভের কোন সুযোগ নাই। তাঁর এ বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট, শিক্ষাকে গণমুখী করার পরিকল্পনা বহু বছর ধরে বঙ্গবন্ধুর মাঝে ছিল।
উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার শিক্ষা। বর্তমানেও এ মহাভাবনা অনেকের মাঝে দৃশ্যমান নয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সর্বান্তকরণে উপলব্ধি করেছিলেন, শিক্ষা জাতির উন্নতির চাবিকাঠি। বিশেষ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে সোনার বাংলা গড়ে তোলার পূর্বশর্তই হলো শিক্ষা। বঙ্গবন্ধু শিক্ষাকে সাধারণ মানুষের দোর গোড়ায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। দেশের সর্বস্তরের মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা দান করাই হলো গণমুখী শিক্ষা। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে ভারতে সেকলে ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষায় এরূপ বিস্তারের কথা উল্লেখ করেন। ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লোকশিক্ষার বিষয়ে বলেন, ‘শিক্ষা বিষয় মাত্রই বাংলার সর্বসাধারণের মধ্যে ব্যাপ্ত করে দেয়া ও অধ্যবসায়ের লক্ষ্য। দুর্গম পথে দুরূহ পদ্ধতির অনুসরণ করে বহু ব্যয়সাধ্য ও সময়সাধ্য শিক্ষার সুযোগ অধিকাংশ লোকের ভাগ্যে ঘটে না। তাই বিদ্যার আলো পড়ে দেশের অতি সংকীর্ণ অংশেই।’ বঙ্গবন্ধু শিক্ষাকে সর্বসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার আলোকে পুরো জাতিকে আলোকিত করতে চেয়েছিলেন।
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচির ৯ ও ১০ নম্বর দফায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের শিক্ষানীতি সম্পর্কে বলা হয়েছে।
ক) দেশের সর্বত্র একযোগে প্রাথমিক ও অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তন করা হইবে এবং শিক্ষকদের ন্যায়সংগত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা হইবে।
খ) শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করিয়া শিক্ষাকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে কার্যকরী করিয়া বেসরকারি বিদ্যালয়সমূহের বর্তমান ভেদাভেদ উঠাইয়া দিয়া একই পর্যায়ভুক্ত করিয়া সকল বিদ্যালয়কে সরকারি সাহায্যপুষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হইবে এবং শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা হইবে। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রভৃতি প্রতিক্রিয়াশীল কানুন বাতিল/রহিত করিয়া বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করিয়া উচ্চশিক্ষাকে সস্তা ও সহজলভ্য করা হইবে এবং ছাত্রাবাসের অল্প ব্যয়সাধ্য ও সুবিধাজনক বন্দোবস্ত করা হইবে।
১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ প্রকাশ করেন, ‘সিংহলে এম. এ. ডিগ্রি লাভ পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা লাভের সুযোগ পায়। অথচ আমাদের দেশের এমনকি প্রাথমিক শিক্ষালাভের কোন সুযোগ নাই।
তাঁর এ বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট, শিক্ষাকে গণমুখী করার পরিকল্পনা বহু বছর ধরে বঙ্গবন্ধুর মাঝে ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যমূলক নীতি পশ্চিম পাকিস্তান গ্রহণ করেছিল। তার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি অনুভব করেন, ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তানে প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধু বেতার-টেলিভিশনে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতেই শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। তিনি সেখানে বলেন, ‘সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাখাতে পুঁজি বিনিয়োগের চাইতে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ এর আর কিছু হতে পারে না। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের পর বাংলাদেশে প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার পরিসংখ্যান একটা ভয়াবহ সত্য। আমাদের জনসংখ্যার শতকরা ৮০ জন অক্ষরজ্ঞানহীন। প্রতিবছর ১০ লাখেরও বেশি নিরক্ষর লোক বাড়ছে। জাতির অর্ধেকেরও বেশি শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। শতকরা মাত্র ১৮ জন বালক ও ৬ জন বালিকা প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করছে। জাতীয় উৎপাদনে শতকরা ৪ ভাগ সম্পদ শিক্ষা খাতে ব্যয় হওয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। কলেজ ও স্কুলশিক্ষকদের, বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষকদের, বেতন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করতে হবে। নিরক্ষরতা অবশ্যই দূর করতে হবে। ৫ বছর বয়স্ক শিশুদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্য একটা ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম’ চালু করতে হবে। মাধ্যমিক শিক্ষার দ্বার সকল শ্রেণির জন্য খোলা রাখতে হবে। দ্রুত মেডিক্যাল কলেজ ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়সহ নয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দারিদ্র্য যাতে উচ্চশিক্ষার জন্য মেধাবী ছাত্রদের অভিশাপ না হয়ে দাঁড়ায়, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে জাতিকে এক অনন্য সংবিধান উপহার দেন। এ সংবিধানে শিক্ষাকে গণমুখী করার উদ্যোগ আমরা দেখতে পাই। সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে-
ক) একই প্রদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য
খ) সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছা প্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য,
গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।
বঙ্গবন্ধু একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা কায়েম করার পক্ষপাতী ছিলেন। আমাদের সমাজের মৌলিক প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের সর্বাধিক উন্নতি সম্ভব করে তোলাই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য।
স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধু নিজস্ব উদ্যোগে বাংলাদেশের প্রথমে যে বাজেট প্রণয়ন করা হয় তাতে প্রতিরক্ষা খাতের চেয়ে শিক্ষা খাতে ৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা বেশি বরাদ্দ করা হয়। তিনি দেশের ৩৬,১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন। বঙ্গবন্ধু ১,৫৭,৭৪২ জন শিক্ষকদের বেতন সরকারি কোষাগার থেকে প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু জানতেন, প্রাথমিক শিক্ষা জাতির জন্য কতটা জরুরি। গণমুখী শিক্ষার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারে ও শক্তিশালীকরণে সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।
১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের যুগান্তকারী নির্বাচনের আগে নির্বাচনি প্রতিশ্রুতিতে কলেজে কর্মরত শিক্ষকদের চাকরি স্থায়ীকরণের প্রতিশ্রুতি দান করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও গতিশীল করার জন্য ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ জুলাই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই-খুদাকে সভাপতি করে ১৮ সদস্য বিশিষ্ট একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। ৩৬টি অধ্যায় বিশিষ্ট ৪৩০ পৃষ্ঠার কমিশনার রিপোর্ট ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ মে পেশ করা হয়। ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে যুগান্তকারী এ শিক্ষা কমিশনের উদ্বোধনের সময় বঙ্গবন্ধু বলেন, শিক্ষার নানাবিধ অভাব ও ক্রটি-বিচ্যুতি দূরীকরণ, শিক্ষার মাধ্যমে সুষ্ঠু জাতি গঠনের নির্দেশ দান এবং দেশকে আধুনিক জ্ঞান ও কর্মশক্তিতে বলীয়ান করার পথ নির্দেশের উদ্দেশ্যেই সরকার এই কমিশন নিয়োগ করিয়াছেন।
কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের সুপারিশসমূহ ছিল অনন্য। যেমন: সেখানে এক ধারা শিক্ষা প্রবর্তনের কথা বলা হয়। ইংরেজি মাধ্যম ও মাদরাসা থাকবে না বলা হয়। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষা দান করা হবে, ইংরেজি ভাষা চালু করার কথা বলা হয় ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে। সংবিধানের মূল চারটি নীতি, যথা ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ভিত্তি করে শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য. শিক্ষাক্রম, বিষয়বস্তু প্রণয়ন করা হয়েছিল। বিজ্ঞান, বাণিজ্য, চিকিৎসা, কৃষি, আইন, ললিতকলা প্রভৃতি মূল বিষয়ে শিক্ষার জন্য আলাদা আলাদা পরিকল্পনার রূপরেখা কমিশনের প্রতিবেদনে আনা হয়। সব ধর্মের আলাদা আলাদা ধর্ম শিক্ষার পরিবর্তে সমন্বিত নীতিশিক্ষা নামক পুস্তক প্রবর্তনের নির্দেশনা দেয়া হয়।
প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়- নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির (১৪-১৭ বছর বয়সে) প্রতিবছর সাড়ে ৪ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা ত্যাগ করে। জীবিকা অর্জন করার জন্য নবম শ্রেণি থেকে শিক্ষাক্রমকে বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষা দুই ভাগে বিভক্ত করার কথা বলা হয়। বৃত্তিমূলক ধারার মাধ্যমিক শিক্ষা হবে তিন বছরের।
গণমুখী, সমাজমুখী, বিজ্ঞানভিত্তিক, পরিবেশ ও চাহিদাভিত্তিক কর্মমুখী শিক্ষার যে সুপারিশ করা হয়েছে কুদরত-ই-খুদা কমিশনে, তা বঙ্গবন্ধুরই গণমুখী শিক্ষা ভাবনা। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড গঠন করেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে মাদরাসা শিক্ষার জন্য ১.২৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু বহুমুখী ও জনকল্যাণকামী নানা উদ্যোগ ও ভাবনা নিয়ে বহু লেখালেখি হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করেন বঙ্গবন্ধু স্ব-উদ্যোগে সেখানে গণমুখী শিক্ষার শতভাগ প্রতিফলন পাওয়া যায়। কমিশনের রিপোর্ট জমা হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু বেশ কিছু গণমুখী শিক্ষা উদ্যোগ গ্রহণ করেন। প্রতিরক্ষা খাত অপেক্ষা শিক্ষা খাতকে অধিক বরাদ্দ দেওয়ার মতো জনকল্যাণমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর গণমুখী শিক্ষা ভাবনা তাঁর সারা জীবনের সুচিন্তার ফসল হিসেবেই দেখা হয়।
লেখক : মো. সিদ্দিকুর রহমান, সভাপতি বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ ও সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষাডটকম