বাউল সাধক ফকির লালন শাহের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

আমাদের বার্তা ডেস্ক |

লালন ফকির ছিলেন একাধারে একজন আধ্যাত্মিক বাউল সাধক, মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক ও দার্শনিক। তার গানের মধ্যে সন্ধান পাওয়া যায় এক বিরল মানব দর্শনের।

লালন শাহ, যিনি লালন ফকির বা লালন সাঁই নামেও পরিচিত, তিনি মৃত্যুর ১২৯ বছর পর আজও বেঁচে আছেন তার গানের মধ্যে। তার লেখা গানের কোনো পাণ্ডুলিপি ছিলো না, কিন্তু গ্রাম বাংলায় আধ্যাত্মিক ভাবধারায় তার রচিত গান ছড়িয়ে পড়ে লোকের মুখে মুখে।

লালন ফকিরকে ‘বাউল-সম্রাট’ বা ‘বাউল গুরু’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। তার গানের মাধ্যমেই উনিশ শতকে বাউল গান বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তিনি প্রায় দু হাজার গান রচনা করেছিলেন বলে লালন গবেষকরা বলেন।

লালন ফকিরের সঠিক জন্ম ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কোনো কোনো লালন গবেষক মনে করেন তেরশ' চুয়াত্তর সালে বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি উপজেলার ভাড়ারা গ্রামে লালন জন্মগ্রহণ করেছিলেন সম্ভ্রান্ত এক হিন্দু কায়স্থ পরিবারে। বাবা মাধব কর ও মা পদ্মাবতীর একমাত্র সন্তান ছিলেন তিনি।
কিন্তু এ বিষয়ে দ্বিমতও আছে। কেউ বলেন তার জন্ম ঝিনাইদহে, কেউ বলেন যশোরে।

কথিত আছে শৈশবে পিতৃবিয়োগ হওয়ায় অল্প বয়সেই তার ওপর সংসারের দায়িত্ব এসে পড়েছিলো। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের সুযোগ তার হয়নি।
কোনো কোনো গবেষকের বিবরণ অনুযায়ী প্রতিবেশী বাউলদাস ও অন্যান্য সঙ্গীদের নিয়ে ‘পুণ্যস্নান’ বা তীর্থভ্রমণ সেরে ঘরে ফেরার পথে লালন বসন্তরোগে গুরুতরভাবে আক্রান্ত হন।

রোগ বৃদ্ধি পেলে অচৈতন্য লালনকে মৃত মনে করে সঙ্গীরা কোনরকমে তার মুখাগ্নি করে তাকে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। এক মুসলমান রমণী নদীকূল থেকে লালনের সংজ্ঞাহীন দেহ উদ্ধার করে সেবাশুশ্রূষা করে তাকে সুস্থ করে তোলেন। কিন্তু তার একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়।

এই গবেষণার তথ্যমতে, এরপর বাড়ি ফিরে গেলে সমাজপতি ও আত্মীয়স্বজন মুসলমানের গৃহে অন্নজল গ্রহণ করার অপরাধে তাকে সমাজে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। ব্যথিত লালন চিরতরে গৃহত্যাগ করেন।

বলা হয় এই ঘটনা সমাজ-সংসার, শাস্ত্র আচার এবং জাতধর্ম সম্পর্কে তাকে বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। এবং এখান থেকেই হয় তার নতুন জন্ম। বাউল গুরু সিরাজ সাঁইয়ের কাছে দীক্ষা নেয়ার পর কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়া গ্রামে আখড়া স্থাপন করে তার প্রকৃত সাধক জীবনের সূচনা হয়।

‘যা আছে ভাণ্ডে, তাই আছে ব্রহ্মাণ্ডে’ - এই ছিলো লালনের দর্শন। বৈষ্ণব সহজিয়া, বৌদ্ধ সহজিয়া ও সুফিবাদের সংমিশ্রণে মানবগুরুর ভজনা, দেহ-কেন্দ্রিক সাধনাই লালন প্রদর্শিত বাউল ধর্মের মূলমন্ত্র।

লালন ফকির বিশ্বাস করতেন সব মানুষের মধ্যেই বাস করে এক ‘মনের মানুষ’। আর সেই মনের মানুষের সন্ধান পাওয়া যায় আত্মসাধনার মাধ্যমে। দেহের ভেতরেই সেই মনের মানুষ বা যাকে তিনি ‘অচিন পাখি’ বলেছেন, তার বাস।

লালন ফকিরের যখন আর্বিভাব ঘটেছিলো সেই সময়টা বাঙালির জীবনের এক ক্রান্তিকাল। পলাশীর যুদ্ধে স্বাধীনতার সূর্য তখন অস্তমিত। গ্রামীণ সমাজ নানাভাবে বিভক্ত। ধর্ম জাত-পাত ইত্যাদি নিয়ে সমাজে ছিলো বিভিন্ন সমস্যা।

লালন এই জাত-পাত ও ধর্ম বর্ণ-বিভেদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন একটি জাত ধর্ম বর্ণ গোত্রহীন সমাজ গড়ে তুলতে। সবকিছুর ওপরে তিনি স্থান দিয়েছিলেন মানবতাবাদকে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় লালনের জীবদ্দশায় তাকে কোনোধরনের ধর্মীয় রীতি-নীতি পালন করতেও দেখা যায়নি। নিজের সাধনা দিয়ে তিনি হিন্দু ধর্ম এবং ইসলাম ধর্ম উভয় শাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। তার রচিত গানে এর প্রচুর নিদর্শন রয়েছে।

তিনি শুধু জাত-পাতের বিরুদ্ধেই সোচ্চার ছিলেন না, সামাজিক অনাচার, বিভেদ বৈষম্য এবং সামন্ত শোষণের বিরুদ্ধেও তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।
‘শিলাইদহের ঠাকুর জমিদাররা যখন প্রজাপীড়ন আরম্ভ করলেন তখন কুমারখালির কাঙাল হরিনাথ তার ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকায় ঠাকুর জমিদারদের বিরুদ্ধে খবর প্রকাশ করেন। এতে ঠাকুর জমিদাররা কাঙাল হরিনাথকে শায়েস্তা করার জন্য গুণ্ডা নিয়োগ করেন। লালন ফকির তখন তার এই বন্ধুকে রক্ষা করার জন্য তার শিষ্যদের নিয়ে জমিদারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন।’

এভাবে লালন ফকির তার সময়ে সমাজে সামন্ত শোষণ, সামাজিক অনাচার ও ভেদ-বিচারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন।

তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় ঠাকুর জমিদারদের পরিবারের অনেকের সঙ্গে লালন ফকিরের ভাল সম্পর্ক ছিলো, যদিও ঠাকুরদের সঙ্গে প্রজা-পীড়নের অভিযোগ নিয়ে লালনের সংঘাত হয়। বলা হয় উনিশ শতকের শিক্ষিত সমাজে লালনের প্রচার ও গ্রহণযোগ্যতার পেছনে ঠাকুর পরিবারের ভূমিকা ছিলো।

লালনের জীবদ্দশায় তার একমাত্র স্কেচটি তৈরি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। লালনের মৃত্যুর বছরখানেক আগে ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ৫ মে পদ্মায় তার বজরায় বসিয়ে তিনি এই পেন্সিল স্কেচটি করেন- যা ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

‘লালন চেয়েছিলেন একটি অখণ্ড মানব-মণ্ডলী গড়ে তুলতে। তার সময়ে তিনি নিজেকে বিকশিত করেছিলেন সমাজ-বিদ্রোহী, ভাব-বিদ্রোহী, মরমী একজন সাধক হিসেবে। 
প্রকৃতপক্ষে লালন ছিলেন মানবতাবাদী। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ। ধর্ম, জাত, কূল, বর্ণ, লিঙ্গ ইত্যাদি অনুসারে মানুষের ভেদাভেদে তিনি বিশ্বাস করতেন না।

কুমারখালির ছেউড়িয়ায় নিজের আখড়ায় ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ অক্টোবর, বাংলা ১২৯৭ বঙ্গাব্দের ১ কার্তিক দেহত্যাগ করেন বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ্‌।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো - dainik shiksha ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দশ দিনে আবেদন প্রায় ৬ লাখ - dainik shiksha সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দশ দিনে আবেদন প্রায় ৬ লাখ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যের কমিটি ঘোষণা - dainik shiksha বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যের কমিটি ঘোষণা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ধারণা বাড়াতেই পাঠ্যক্রমে তথ্য অধিকার আইন বিষয় যুক্ত: এনসিটিবি চেয়ারম্যান - dainik shiksha ধারণা বাড়াতেই পাঠ্যক্রমে তথ্য অধিকার আইন বিষয় যুক্ত: এনসিটিবি চেয়ারম্যান কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: ২১তম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি - dainik shiksha শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: ২১তম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ - dainik shiksha সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ সুইডেনে স্কলারশিপে স্নাতকোত্তরের সুযোগ - dainik shiksha সুইডেনে স্কলারশিপে স্নাতকোত্তরের সুযোগ পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন - dainik shiksha পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0035130977630615