বুদ্ধির চর্চা করতে গিয়ে হৃদয় হারাচ্ছি না তো : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

দেশে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে এবং তাতে অপরাধীর সংখ্যাও যে বাড়বে– এটা তো অবধারিত। একটি দৈনিক পত্রিকা জানাচ্ছে, এক ঢাকা শহরেই বর্তমানে ৬ হাজারের বেশি ছিনতাইকারী সক্রিয়। খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনেই ভয়ংকর (ঠিক কিশোরদের নয়) যুবকদের গ্যাংয়ের তৎপরতার খবর কয়েক দিন আগে প্রকাশ পেয়েছে। নাম ‘প্রলয়’। নামই বলে দিচ্ছে তাদের পরিচয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে একটি চিকিৎসাকেন্দ্র রয়েছে; একাত্তরে আলবদরদের হাতে শহীদ ডা. মোহাম্মদ মোর্তজার নামে যার নামকরণ করা হয়েছে, সেই চিকিৎসাকেন্দ্রের ওপরতলাতে এই গ্যাং নিজেদের সদরদপ্তর প্রতিষ্ঠা করেছে। তাদের কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে রয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। রোববার (৯ জুলাই) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী রচিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

তারা নিজেরা মাদক গ্রহণ করে এবং মাতাল অবস্থায় অন্যদের ওপর আক্রমণ চালায়; ছিনতাই করে। সবকিছু প্রকাশ্যে, অথচ গোপনভাবেই সম্পন্ন হচ্ছিল। ফাঁস হয়ে গেছে একজন সাহসী মায়ের দুঃসাহসিক হস্তক্ষেপে। ছেলের ওপর ‘প্রলয় গ্যাং’-এর নিপীড়নের ঘটনা তার সহ্য হয়নি। তাই কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ পেশ করেছেন। তাতে কিছুটা কাজ হয়েছে। প্রলয়ওয়ালারা আপাতত ছত্রভঙ্গ হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। তা তারা আপাতত না হয় দমল, তাদের লালনভূমির কী হবে? লালনভূমি তো হতাশা, সৃষ্টিশীল কর্মের অভাব, সাংস্কৃতিকভাবে উন্নত হওয়ার সুযোগহীনতা। সে অভাব ঘুচবে কি? কবে? কীভাবে? ফুঁ দিয়ে কি প্রলয়শিখা নেভানো যাবে?

শিশুদের জন্য তাদের বাবা-মা ছাড়া অন্য অনেকেই যে ভাবেন, এমন প্রমাণ বিরল নয়। এর উল্টো প্রমাণ যত্রতত্র। বাংলাদেশ টেলিভিশনে এক সময়ে শিশুদের জন্য নানা ধরনের অনুষ্ঠান হতো। শিশুরা অংশ নিত, উপভোগ করত, শিখত। এখন অনেক টেলিভিশন চ্যানেল এসেছে, ব্যতিক্রম বাদে কোনো চ্যানেলেই শিশুদের জন্য অনুষ্ঠান দেখা যায় না। তবে টেলিভিশনে শিশুরা যে অনুপস্থিত থাকে, তা নয়। তারা আসে ভোগ্যপণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচারের বাহন হিসেবে। আদরের ছলে নিষ্ঠুরভাবে ব্যবহৃত হয়। মুনাফা যেখানে একমাত্র বিবেচনা, শিশুদের শৈশব সেখানে অবশ্যই তুচ্ছ।

আরিফুর মিয়া এবং রায়হান মিয়া দুই ভাই। একজনের বয়স ৮, আরেকজনের ১০। ঢাকার ডেমরা এলাকায় বসবাস। বাবা ভ্যানগাড়ি চালান, মা কাজ করেন কারখানায়। দুই ভাই খেলছিল। খেলবে আর কোথায়? গেছে প্রতিবেশীর আমতলায়। ফাঁকা পেয়ে। আমগাছ নিয়ে প্রতিবেশী নিশ্চয় বিপদে ছিলেন, নইলে গাছের ডালে ডালে ইলেকট্রিক তার ঝুলিয়ে রাখবেন কেন? তাও আবার সচল অবস্থায়? খেলতে খেলতে ছেলে দুটি ইলেকট্রিক তার ছুঁয়েছে এবং প্রাণ হারিয়েছে। খবর পেয়ে গাছের মালিক বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন। প্রতিবেশীরা আমগাছের মালিকের বাড়িতে ইটপাটকেল ছুড়েছে।

আমগাছের পলাতক মালিক বলবেন, তাঁর দোষটা কোথায়? আমগাছগুলো তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি। আদর-যত্ন করে বড় করেছেন, রক্ষা করেছেন। কিন্তু আমগাছে আম ধরলে আর রক্ষা নেই, চুরি হওয়া শুরু হয়। থামানোর অনেক রকম চেষ্টাই তিনি করেছেন। সফল হননি। তাই নিতান্ত অনিচ্ছায়, একান্তই বাধ্য হয়ে, টাকা খরচ করে ইলেকট্রিক তার দিয়ে গাছগুলোকে ঘিরে দিয়েছেন। প্রতিবেশীর শিশুদের খেলার জন্য জায়গা করে দেওয়া তো তাঁর দায়িত্ব নয়। তাঁর বাড়িতে যারা ইটপাটকেল ছুড়েছে; শিশুদের জন্য খেলার জায়গা ব্যবস্থা করার দায়িত্ব কি তারাও পালন করেছে– এমন প্রশ্ন তো তিনি তাদের করতে পারেন, যদি সুযোগ পান।

আসল সমস্যা কিন্তু সম্পত্তির ওই ব্যক্তিগত মালিকানা ঘিরেই। নতুন কোনো প্রশ্ন নয়; হাজার হাজার বছরের পুরোনো প্রশ্ন। কিন্তু আজকের পৃথিবীতে, পুঁজিবাদের অন্তিম অবস্থাতে ওই প্রশ্ন যতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে; আগের কোনোকালে ততটা গুরুত্ব পায়নি।

পুঁজিবাদী উন্নতি মানুষের জন্য সুখ বৃদ্ধি করছে, বাড়িয়ে তুলছে অস্তিত্বের সংকট। বুঝতে কোনো অসুবিধা নেই যে, উন্নতির এক নতুন স্তর হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উদ্ভাবন। উদ্ভাবন অবশ্য ইতোমধ্যে ঘটে গেছে, আগামীতে তার আরও উন্নতি ঘটবে। তখন অনেক কাজই মানুষকে আর নিজের মাথা খাটিয়ে, হাত লাগিয়ে করতে হবে না; যন্ত্রই করে দেবে। কিন্তু মানুষ তো কেবল বুদ্ধিমান প্রাণী নয়, হৃদয়বান প্রাণীও। সেই হৃদয়ের কী হবে? যান্ত্রিক বুদ্ধি কি মানুষের হৃদয়কে ছাড় দেবে? নাকি পিষে মারবে? এই নতুন উদ্ভাবন বিজ্ঞানী ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের উদ্ভাবিত দানবটির চেয়েও ভয়ংকর হয়ে উঠবে না তো? দানবেরা কি হৃদয়বান হয়? যে দানবের ভেতর হৃদয় বলে কোনো কিছুর অস্তিত্বই থাকবে না, তাকে বিশ্বাস করা কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে যারা কাজ করেছেন, তার উন্নতিতে শ্রম ও মেধা নিয়োগ করেছেন; তাদের কারও কারও মাঝে ইতোমধ্যে দেখছি দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে।

দুয়েকজনকে অনুশোচনায় পর্যন্ত পেয়েছে। কিছু না হোক, যেসব মানুষ বেকার হয়ে যাবে, তাদের ভাগ্যে কী ঘটবে? তাদের সংখ্যা তো দাঁড়াবে বেশুমার। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মালিকানা তো হবে ব্যক্তিগত। সেই ব্যক্তিরা কি সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের ভালোমন্দ নিয়ে চিন্তাভাবনা করবে? করাটা কি তাদের জন্য স্বাভাবিক হবে? টুইটারের মালিকানা কিনে নেওয়ার পর ইলন মাস্ক তো শুনলাম বাহুল্য বোধে শতকরা ৮০ জন কর্মীকে ছাঁটাই করার মতলব আঁটছেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পারমাণবিক বোমার মতোই ভয়ংকর এক উদ্ভাবন হয়ে দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। হাত ব্যবহারের স্বাধীনতা পেয়ে আদিম মানুষ এক সময় নিজেকে মুক্ত করেছিল। হাতের ব্যবহার ভুলে মানুষ আবার ফিরে যাবে হামাগুড়ির অস্তিত্বে, নাকি পরিণত হবে দু’পেয়ে দানবে?

পুঁজিবাদ এখন তার শেষ দশায় পৌঁছে যেসব দানবীয় তৎপরতায় নিযুক্ত হয়েছে তার মধ্যে আছে মাদক ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসা এবং যুদ্ধ। পৃথিবী ভাগ হয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাবান ও ক্ষমতাহীনদের মধ্যে। উদারপন্থিরা হয় কট্টরপন্থি হচ্ছেন, নয়তো নীরব হয়ে পড়ছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ভয়াবহ রকমের দুশ্চরিত্র অপরাধীও তাঁর দেশের অনেক মানুষের কাছে বীর হিসেবে বিরাজ করছেন। যে অস্ত্রটি তিনি ব্যবহার করছেন সেটি হলো ‘দেশপ্রেম’। তিনি বলেছেন, ‘আমার একমাত্র অপরাধ দেশকে যারা ধ্বংস করতে চেয়েছিল; নির্ভীকচিত্তে তাদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে চেয়েছিলাম।’ তাঁর বিরুদ্ধে মামলা চলছে, অভিযোগ ৩৪টি। সবকিছু ঢাকা দিতে চাচ্ছেন ‘দেশপ্রেম’-এর রঙিন চাদর দিয়ে। উন্নত আমেরিকার শ্বেতবর্ণবাদীরাও বিশ্বাস করছেন অশ্বেতাঙ্গদের আগ্রাসন থেকে আমেরিকাকে যদি বাঁচাতে হয়, তাহলে ট্রাম্পই শেষ ভরসা। মানুষটির চরিত্র যা-ই হোক না কেন, তিনি খাঁটি জাতীয়তাবাদী তো বটে।

পুতিনেরও ওই একই আওয়াজ– দেশপ্রেম। পিতৃভূমি অন্যদের দখলে চলে যাবে– এমন আশঙ্কায় পিতৃভূমিকে রক্ষা করা চাই। ইউক্রেনের ভেতর দিয়ে ন্যাটো ঢুকবে; ইউক্রেনকে তাই দাবিয়ে রাখা দরকার; সে জন্যই যুদ্ধ। তাতে দেশের সৈন্যরা যে হাজারে হাজারে মারা পড়ছে; দেশের অর্থনীতির যে ভয়ংকর ক্ষতি হচ্ছে; সারা পৃথিবীর মানুষেরই যে বিপদ ঘটছে– এসবে কিছু আসে যায় না। আমাদের প্রতিবেশী ভারতের নরেন্দ্র মোদি গুজরাটে অপরাধ কিছু কম করেননি। কিন্তু তিনি মোদি-ম্যাজিক তৈরি করেছেন হিন্দুত্ববাদকে প্রতিষ্ঠা করার গলা ফাটানো ‘দেশপ্রেমিক’ রণধ্বনি তুলে। 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ডিআইএর নতুন পরিচালক অধ্যাপক আবু কাইয়ুম - dainik shiksha ডিআইএর নতুন পরিচালক অধ্যাপক আবু কাইয়ুম জাতীয়করণসহ তিন দাবিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরিদের অবস্থান - dainik shiksha জাতীয়করণসহ তিন দাবিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরিদের অবস্থান এমপিওর দাবিতে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় শিক্ষকদের পদযাত্রা - dainik shiksha এমপিওর দাবিতে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় শিক্ষকদের পদযাত্রা কারিগরিতে ৪০ শতাংশ নম্বরে উপবৃত্তি - dainik shiksha কারিগরিতে ৪০ শতাংশ নম্বরে উপবৃত্তি কাউকে হেনস্তা না করার আহ্বান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের - dainik shiksha কাউকে হেনস্তা না করার আহ্বান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের আটকের পর বিজিবিকে যে প্রলোভন দেখান বিচারপতি মানিক - dainik shiksha আটকের পর বিজিবিকে যে প্রলোভন দেখান বিচারপতি মানিক নয় বছরের শিক্ষিকাকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হতে বললেন প্রধান শিক্ষক - dainik shiksha নয় বছরের শিক্ষিকাকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হতে বললেন প্রধান শিক্ষক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0042071342468262