শিক্ষকের মর্যাদা সমুন্নত থাকুক, তদন্ত কমিটি বাতিল করা হোক

দৈনিক শিক্ষা ডেস্ক: |

আমরা কিছুটা ভারমুক্ত, তবে শঙ্কামুক্ত নই। আমরা কিছুটা আনন্দিত, তবে তৃপ্ত নই। মাহবুবুল হক ভূঁইয়াকে ছুটিতে পাঠানোর অন্যায় আদেশ প্রত‌্যাহার করা হলেও আমরা পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারছি না।।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রভাষক ও ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান মাহবুবুল হক ভূঁইয়া তারেকের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্লজ্জ, অবিবেচক, শিষ্টাচারবর্জিত এবং অগণতান্ত্রিক আচরণের কথা এতদিনে সচেতন পাঠকমহল কমবেশি অবগত। এহেন আচরণের বিরুদ্ধে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে বাইরে সর্বত্র প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। ‘উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনা করে’ প্রশাসন সেই ছুটি প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

জনমতকে বুঝতে পেরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যে বোধোদয় ঘটেছে, তার জন্য আমরা প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, প্রশাসনের মাথায় ‘ষড়যন্ত্রের ভূত’ এখনও চেপে আছে। কারণ, মাহবুবুলের বিরুদ্ধে যে নাই বিষয়কে বিষয় বানিয়ে অভিযোগ করেছিল ছাত্রলীগ, তার জন্য গঠিত তদন্ত কমিটি এখনও বহাল আছে। শিক্ষার্থীদের সামনে শিক্ষকের অপমান করা এবং প্রকাশ্যে এই শিক্ষকের প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার পরও প্রশাসন কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ঘটনার পর থেকে নানা হুমকি ধামকি, চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে বিভাগের শিক্ষার্থীরা নিরঙ্কুশভাবে তাদের শিক্ষকের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তারা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন। ছাত্রলীগের দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় এখন সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থীরাও আতঙ্কে আছেন।

১৫ আগস্ট শোক দিবসে পরীক্ষার্থী শিক্ষার্থীদের পড়া বুঝিয়ে দেওয়াকে ‘ক্লাস নেওয়ার’ অপবাদ দিয়ে মাহবুবুল হক ভূঁইয়াকে অপদস্থ ও অপমান করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ। কোনো রকম শিষ্টাচার ও ভদ্রতার চিহ্ন না রেখে ছাত্রলীগের কয়েকজন একটি কক্ষে গিয়ে ওই শিক্ষককে হেনস্তা করে। আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করে। শিক্ষার্থীদের হুমকি দেয়। আরও অপদস্থ করার উদ্দেশ্যে ভিডিওচিত্র ধারণ করে এবং তা ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়। এতেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। উপাচার্যকে দিয়ে শিক্ষককে ছুটিতে পাঠিয়ে তবেই শান্ত হয়েছে এসব ছাত্র নামধারী দুষ্কৃতিকারী।

ছাত্রলীগের সম্পূর্ণ অমূলক ও হাস্যকর অভিযোগের ভিত্তিতে শিক্ষককে ছুটিতে পাঠাতে কোনপ্রকার প্রহসনের আশ্রয় নেওয়ার প্রয়োজনও বোধ করেননি উপাচার্য। একনায়কের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনকানুনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েছেন তিনি। শাস্তির নোটিশ আর তদন্ত কমিটি গঠনের দুইটি পৃথক নোটিশ একসাথে জারি করে তাঁর সাধারণ বিবেচনাবোধের দীনতাই প্রকাশ করেছেন মাত্র। আত্মপক্ষ সমর্থনের বিন্দুমাত্র সুযোগ না দিয়ে মাহবুবুলের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করেছেন উপাচার্য। আরো দুঃখের বিষয়, ছাত্রলীগের দাবির অসারতা বিষয়ে ছাত্রছাত্রীর স্মারকলিপি, বঙ্গবন্ধু পরিষদের বিবৃতি প্রভৃতি হাতে নিয়েই তিনি মাহবুবুলের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছেন। ছাত্রলীগের একটি অন্যায় উপাচার্যের সমর্থন পেয়ে আরও অনেক অন্যায়ের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। এমনকি ফৌজদারি অপরাধের মতো অপরাধ পর্যন্ত ঘটেছে। ছাত্রলীগের কয়েকজন ফেসবুকে শিক্ষক মাহবুবুলকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে, তাকে নিয়ে অকথ্য বিষোদগার করেছে।

প্রশাসন ও ছাত্রলীগের এসব অন্যায়, অপবাদের দায় নেবেন না বলে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিকে অক্ষুণ্ন রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যার যার জায়গা থেকে প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে। এখনো সে প্রতিবাদ অব্যাহত আছে। শিক্ষক সমিতির নেতৃত্বে শিক্ষকরা বিক্ষোভ করেছেন, উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করে রেখেছেন। আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অন্যায় ও দুর্নীতির বিচার না করায় উপাচার্যের জবাবদিহিতাও চান তাঁরা। এদিকে বিভিন্ন চাপকে উপেক্ষা করে বিভাগের শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষককে অন্যায় ছুটি দেওয়ার প্রতিবাদ ও তা দ্রুত প্রত্যাহারের দাবিতে পূর্ববনির্ধারিত সকল ক্লাস-পরীক্ষা বয়কট করে। বিভাগের সিংহভাগ শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাহবুবুলের ছবিকে প্রোফাইল ফটো বানিয়ে ঘটনার প্রতিবাদ জানায়। সমাজ সচেতন অনেকেই গণমাধ্যম ও সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টির প্রতিবাদ করে। সারাদেশে মাহবুবুলের পক্ষে এক জনমত গড়ে ওঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ছুটি প্রত্যাহার করে নেয় প্রশাসন।

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলছেন, এখনও শর্ষের ভেতরে ভূত রয়ে গেছে। তাঁদের আশঙ্কা, প্রশাসন ছুটি বাতিল করে প্রতিবাদকে কিছুটা শান্ত করার চেষ্টা করেছে বটে, কিন্তু তদন্ত কমিটির মাধ্যমে প্রশাসন তার হীনস্বার্থ হাসিল করে নেবে। আর তাই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি তদন্ত কমিটি বাতিলসহ বিভিন্ন বিষয়ে সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এখন অন্যায় ও বিশেষ স্বার্থের পিছু না ছুটে বিবেক, যুক্তি আর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সার্বিক কল্যাণের কথা চিন্তা করতে হবে। সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। ছাত্রলীগের অভিযোগ যে অমূলক ও অন্যায় ছিল, তা ছুটি প্রত্যাহার করে প্রশাসন স্বীকার করে নিয়েছে। সূতরাং এর জন্য তদন্ত কমিটি টিকিয়ে রাখার আর কোনো যৌক্তিকতা নেই। আমরা জানতে পেরেছি, বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছে ছাত্রলীগের হাইকমান্ড। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেও এ তদন্ত কমিটি বাতিল করার কথা উঠেছে। তাই আমরা বুঝতে পারছি না, কোন স্বার্থ হাসিলের জন্য প্রশাসন এখনও কমিটি বহাল রেখে দিলেন।

শিক্ষকরা দাবি করেছেন, ভাস্কর্যের দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবাদ করায় মাহবুবুলকে শায়েস্তা করার জন্য এহেন পদক্ষেপ। এ দুর্নীতির নেপথ্যে কারা আছে, তাদের চেহারা আমরা দেখতে চাই। বিচার না হলে সেই দুর্নীতিবাজরা যতদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকবে, ততদিন দুর্নীতি চলতেই থাকবে। শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্ট হবে। শিক্ষককে অপমানিত হতে হবে। এখনই সময় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসব বিষবৃক্ষের মূলোৎপাটন করা। না হলে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়কে এক ভয়ংকর গ্লানি বহন করতে হবে।

প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার পর মাহবুবুল জিডি করেছন। কিন্তু আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, এ অপরাধটির ক্ষেত্রে নীরব ভূমিকা পালন করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পরোক্ষভাবে এহেন কাজে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে। তাই ছুটি প্রত্যাহার হয়েছে বটে, কিন্তু মাহবুবুল নিরাপদে ও স্বস্তিতে আর পড়াতে পারবেন কি না তা আমাদের মধ্যে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।

আমরা সবচেয়ে বেশি উদ্বিঘ্ন শিক্ষার্থীদের নিয়ে। বিভিন্ন হুমকি উপেক্ষা করে তারা মাহবুবুলের ছুটি প্রত্যাহারের দাবিতে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেছিলেন। দুষ্কৃতিকারীরা নিরাপদে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ালে প্রতিবাদী শিক্ষার্থীরা নিজ নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা বোধ করতেই পারেন।

সকল পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমাদের চাওয়া নিম্নরূপ:

১. মাহবুবুলের বিরুদ্ধে গঠিত অনৈতিক তদন্ত কমিটি দ্রুত বাতিল করা হবে।
২. মাহবুবুল যাতে নিরাপদে ও কোনোরকম বাধা ছাড়াই শিক্ষাদান করতে পারে সেই পরিবেশ নিশ্চিত করা হবে।
৩. হত্যার হুমকিদাতাদের বিরুদ্ধে পৃথক পৃথক রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।
৪. যারা শ্রেণিকক্ষে ঢুকে শিক্ষককে অপমান করেছে তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
৫. সুন্দর ও উন্নত শিক্ষাজীবনের স্বার্থে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।

ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে একটি ন্যায়নিষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়। আর এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে কিছু সুন্দর ও সৎ মানুষ দরকার। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মাহবুবুল তেমনি এক নিবেদিতপ্রাণ সৎ শিক্ষক। তাঁর বিরুদ্ধে সব অন্যায়ের প্রতিকার হোক। শিক্ষকের মর্যাদা সমুন্নত থাকুক।

শরিফুল হাসান, নাদিয়া শারমিন, জেসমিন পাপড়ি, রাশেদ নিজাম, নাজমুল হোসেন, শাকিল হাসান, মনিরুল ইসলাম, মানোয়ার হোসেন, খন্দকার হাবীবুর রহমান

লেখকবৃন্দ বিভিন্ন গণমাধ্যমের বর্তমান সাবেক সংবাদকর্মী


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
১৮তম প্রিলির ফল প্রকাশ, উত্তীর্ণ ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৯৮১ - dainik shiksha ১৮তম প্রিলির ফল প্রকাশ, উত্তীর্ণ ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৯৮১ প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ, উত্তীর্ণ ৫ হাজার ৪৫৬ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ, উত্তীর্ণ ৫ হাজার ৪৫৬ সাড়ে ৪ মাসে ১৮৮ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, বিশেষজ্ঞরা যেসব বিষয়কে দায়ী করছেন - dainik shiksha সাড়ে ৪ মাসে ১৮৮ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, বিশেষজ্ঞরা যেসব বিষয়কে দায়ী করছেন শতভাগ ফেল স্কুল-মাদরাসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থার উদ্যোগ - dainik shiksha শতভাগ ফেল স্কুল-মাদরাসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থার উদ্যোগ দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত শিক্ষা কর্মকর্তা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে শ্রীপুরে গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর ভাইয়ের প্রার্থিতা বাতিল - dainik shiksha শ্রীপুরে গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর ভাইয়ের প্রার্থিতা বাতিল এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বিএনপি-জামায়াত মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ করে দেয় : প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha বিএনপি-জামায়াত মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ করে দেয় : প্রধানমন্ত্রী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0048050880432129