সুতোয় টান রাখুন

হোসনে আরা বেগম |

আনাচে-কানাচে ভুঁইফোঁড়ের মতো ব্যাচের পর ব্যাচ গজাচ্ছে। বর্তমানে ব্যাচে পড়ানো যেন একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কে শিক্ষক, কে অশিক্ষক—ওসব বাছ-বিচার না করেই সন্তানকে ব্যাচে পাঠানো হচ্ছে। ব্যাচে শুধু পরীক্ষায় আসবে—এমন সব প্রশ্নের উত্তরই বেছে বেছে শেখানো হচ্ছে। প্রকৃত সৃজনশীলতা এখন মুখ থুবড়ে পড়ছে। অথচ আগে শিক্ষকদের কাছে ইমপর্টেন্ট প্রশ্ন জানতে চাইলে বলতেন, বইয়ে লেখা সব কালো অক্ষরই ইমপর্টেন্ট।

মেয়েদের স্কুলে আবার ছোট ছোট মেয়েদের সেলাই শেখানো হয়। যে-সব বাচ্চার মুখে মা খাবারের গ্রাস তুলে দিচ্ছেন, সে-সব বাচ্চার হাতে সুঁই-সুতো তুলে দিয়েই শিক্ষক ক্ষান্ত হচ্ছেন না, তাদেরকেও কোনো কোনো শিক্ষক ব্যাচে সেলাই শেখাতে বাধ্য করছেন। কোনো কোনো অভিভাবকের কাছ থেকে এমন অভিযোগও ওঠে, ব্যাচে সেলাই না শেখালে বাচ্চাকে ফেল করিয়ে দেওয়া হয় এবং অনেক মেধাবী ছাত্রীকে মেধাতালিকা থেকে পিছিয়ে দেওয়া হয়। আমরা ‘বালিশের কভারে’ ফুল তোলার দিন অনেক আগেই ছেড়ে দিয়ে এসেছি। তাহলে ছোট ছোট মেয়েদের সেলাইয়ের মতো এমন একটা বিষয়ের উপর প্রাইভেট পড়াতে হবে কেন?

আমি যখন ভিকারুননিসার অধ্যক্ষ ছিলাম, তখন অভিভাবকদের অনুরোধে সেলাই, ড্রইং, খেলাধুলায় নম্বর দেওয়ার পদ্ধতি বাদ দিয়ে গ্রেড পয়েন্ট দেওয়ার নিয়ম করে দিলাম এবং একই সঙ্গে এ সমস্ত বিষয়ের কোনো নম্বর রেজাল্ট কার্ডে যোগ না দেওয়ার নির্দেশনা দিলাম।

সেদিন সকালে পত্রিকা হাতে নিতেই এক চাররঙা চৌকস লিফলেট বেরিয়ে এলো। বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিক্যালের কিছু সংখ্যক মেধাবী ছাত্রের সমন্বয়ে একটি ব্যাচের বিজ্ঞপ্তি হকারের মাধ্যমে পত্রিকার ভাঁজে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের আকর্ষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। নবম শ্রেণির বিজ্ঞান শাখার ছাত্র-ছাত্রীদের সব বিষয় পড়ানো হবে। প্রথম মাসে কোনো টাকা-পয়সা নেওয়া হবে না। পরের মাস থেকেই ছাত্র-ছাত্রীদের তিন হাজার পাঁচশ’ টাকা করে দিতে হবে। সপ্তাহের সাতদিনই ক্লাস হবে এবং প্রতি সপ্তাহে একদিন পরীক্ষা নেওয়া হবে। এক ব্যাচে সর্বোচ্চ ৩০ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে ক্লাস নেওয়া হবে এবং প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীকে পৃথকভাবে ফলোআপ করা হবে।

বিজ্ঞপ্তিটি পড়ে মনে হলো, যারা এখনো নিজেদের দায়িত্বই নিতে শেখেনি, তারা কী করে এত এত ছেলে-মেয়ের দায়িত্ব নেবে? তারা শতভাগ এ+ পাওয়ার আশ্বাস দিচ্ছে। বিভ্রান্ত অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন তাদের দ্বারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত শিক্ষকরা এসব তরুণ তথাকথিত স্মার্ট শিক্ষকদের কাছে ম্লান হয়ে যাচ্ছেন। বহু শিক্ষার্থীকে দেখা যায়, প্রাতিষ্ঠানিক ক্লাসে অনুপস্থিত থেকে ছুটে যাচ্ছে ওই সমস্ত ক্লাসে। এসব শিক্ষক এদের কাছে ভাই-বন্ধু হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ ক্লাসকে প্রাণবন্ত করার জন্যে উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের সমন্বয়ে ক্লাস সাজাচ্ছে। এতে ছেলে-মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছে—ওমুক ভাইয়ার কাছে না পড়লে যে জীবনই বৃথা!

শুধু ছেলে-মেয়েদের কথা বলছি কেন, অভিভাবকরাও প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক ছাউনিতে বসে একে অপরকে বিভিন্ন ব্যাচে ছেলে-মেয়েদের পড়ানোর জন্যে আগ্রহান্বিত করে তোলেন। কেউ কেউ এর গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে বলেন, ‘হায়, হায়! আপনার বাচ্চাকে ওমুক স্যারের কাছে দেননি?’ কেউবা বলেন, ‘আরে ভাই, ওমুক স্যারের মতো এমনভাবে কেউ পড়াতে পারে না কি?’ এ ধরনের মন্তব্যে অভিভাবকরা এক স্যারকে ছেড়ে অন্য স্যারের কাছে ছোটেন। কেউ কেউ শুধু এক স্যারের কাছে পড়িয়েই তৃপ্ত নন—এক শিক্ষার্থীকে একাধিক স্যারের কাছে পড়াচ্ছেন। এ রোগ ছড়িয়ে পড়ছে শহর থেকে শহরতলিতে। শহরের তুলনায় গ্রামের ছেলে-মেয়েরা এখনো এতটা বহির্মুখো হয়নি। তা বলে গ্রামের ছেলে-মেয়েরা লেখা-পড়ায় শহুরে ছেলে-মেয়েদের থেকে পিছিয়ে আছে, এ কথা বলা যাবে না।

যুগ যুগ ধরে ছেলে-মেয়েরা গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ছে। তবে আগে সাধারণত বিদেশি ভাষা হিসেবে ইংরেজি আর কঠিন বিষয় হিসেবে গণিতের উপর জোর দেওয়া হতো। বর্তমানেও ছাত্র-ছাত্রীরা গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ছে। তবে একজন পড়ছে কয়েকজন শিক্ষকের কাছে। এক বিষয় নয়—বহু বিষয়। একথা অবশ্য জোর দিয়ে বলা যায়, ছেলে-মেয়েদেরকে যদি শিক্ষিত মা-বাবা নিজে যত্ন করে পড়ান, তাহলে পড়াটা যেমন সার্থক হবে, তেমনি সন্তানও মা-বাবার কাছাকাছি থাকবে। বর্তমানে বহু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রফেসরের মতো উচ্চশিক্ষিত মা-বাবাও হুজুগে পড়ে তাদের সন্তানকে অন্যত্র পড়তে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। ছেলে-মেয়ের পড়াশুনার তত্ত্বাবধান করার জন্যে মা-বাবাকে যে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে, এমন কথা নেই। একজন নিরক্ষর সচেতন মা-ও পারেন তার সন্তানের পড়শোনার দেখভাল করতে। আজিমপুর গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজে একবার একটা মজার ঘটনা ঘটেছে। এক মা হন্তদন্ত হয়ে অভিযোগ করতে এসেছেন। তাঁর অভিযোগের বিষয় হলো—‘আমার মাইয়া আর উই মাইয়া একলগে আহে, আর একলগে যায়। উই মাইয়ার রেজাল্ট কার্ডে লাল দাগ নাই। আমার মাইয়াডারে মাস্টারনি লাল দাগ দিছে ক্যান?’ এই যে একজন নিরক্ষর মায়ের অভিযোগ, এ অভিযোগের ভেতর দিয়ে বুঝতে পারলাম, মা তার সন্তানের প্রতি সচেতন হচ্ছেন। অভিভাবকদের এই সচেতনতা এবং চেষ্টা থাকলে সন্তান মানুষ হবেই। অভিভাবকদের প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে, আপনার সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কী পড়ছে, কার সঙ্গে মিশছে—এসব দিকে লক্ষ্য রাখুন। সময় থাকতে সুতোয় টান রাখুন। আর নয়ত আপনি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সে সঙ্গে দেশও পিছিয়ে যাবে।

লেখক: প্রাক্তন অধ্যক্ষ, আজিমপুর গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাক্তন অধ্যক্ষ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সাড়ে ৪ মাসে ১৮৮ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, বিশেষজ্ঞরা যেসব বিষয়কে দায়ী করছেন - dainik shiksha সাড়ে ৪ মাসে ১৮৮ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, বিশেষজ্ঞরা যেসব বিষয়কে দায়ী করছেন শতভাগ ফেল স্কুল-মাদরাসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থার উদ্যোগ - dainik shiksha শতভাগ ফেল স্কুল-মাদরাসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থার উদ্যোগ দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত শিক্ষা কর্মকর্তা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে শ্রীপুরে গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর ভাইয়ের প্রার্থিতা বাতিল - dainik shiksha শ্রীপুরে গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর ভাইয়ের প্রার্থিতা বাতিল এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বিএনপি-জামায়াত মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ করে দেয় : প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha বিএনপি-জামায়াত মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ করে দেয় : প্রধানমন্ত্রী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0052740573883057