একাদশ জাতীয় সংসদের অধিকাংশ সংসদীয় কমিটি কার্যকর নয়। কমিটিগুলোর বৈঠক সময়মতো হয় না। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কমিটি বছরে ২-৩টি বৈঠকও করেনি। যদিও জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী, প্রতিটি সংসদীয় কমিটির মাসে অন্তত একটি বৈঠক করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, কমিটির অনুমতি ছাড়া কোনো সদস্য পরপর দুটি বা তার চেয়ে বেশি বৈঠকে অনুপস্থিত থাকলে ওই সদস্যকে কমিটি থেকে পদচ্যুত করার জন্য সংসদে প্রস্তাব আনা যেতে পারে।
কমিটির বৈঠক পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদের চার বছর অতিবাহিত হয়েছে, সে হিসেবে প্রতিটি সংসদীয় কমিটির ৪৮-৫০টি বৈঠক করার কথা থাকলেও মাত্র দুটি কমিটি ৫০টির অধিক বৈঠক করেছে। তার একটি ‘সরকারি হিসাব সম্পর্কিত কমিটি’ ১০৩টি বৈঠক করেছে এবং নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি ৫৩টি বৈঠক করেছে। আর সর্বনি¤œ ৫টি বৈঠক করেছে লাইব্রেরি কমিটি। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি খন্দকার মোশাররফ হোসেন ১০ মাস আগে বিদেশে চলে যাওয়ায় এ কমিটির কোনো বৈঠকই হয়নি। আবার অর্থ, খাদ্য, ডাক ও টেলিযোগাযোগ, বেসরকারি সদস্য বিল ও সিদ্ধান্ত প্রস্তাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিসহ ৭-৮টি কমিটি ১০টি বা তার কম বৈঠক করেছে।
২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি বর্তমান সংসদ যাত্রা শুরুর মাত্র ১০ কার্যদিবসের মধ্যে ৫০টি সংসদীয় স্থায়ী কমিটি করা হয়। এসব কমিটির মধ্যে ৩৯টি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত। বাকি ১১টি কমিটি বিষয়ভিত্তিক। দ্রুততার সঙ্গে কমিটি গঠন করা হলেও বেশির ভাগ কমিটির তেমন তৎপরতা দেখা যায়নি। মাসে অন্তত একটি বৈঠক করার নিয়ম থাকলেও দুয়েকটি কমিটি ছাড়া কোনো কমিটি প্রতি মাসে বৈঠক করে না। আবার অনেক সময় মাত্র তিনজন সদস্য উপস্থিত না থাকায় কোরাম সংকটে কমিটির বৈঠক বাতিল হয়েছে।
সংসদ সচিবালয় সূত্র জানায়, বিগত চার বছরে বেশির ভাগ সংসদীয় কমিটিই নিয়ম অনুযায়ী বৈঠক করেনি। মন্ত্রণালয়ভিত্তিক মাত্র ২টি সংসদীয় কমিটি ৫০টি বা তার বেশি বৈঠক করেছে। ১০টিরও কম বৈঠক করেছে ৮টি কমিটি। ১০ থেকে ১৯টির মধ্যে বৈঠক করেছে ২৫টি কমিটি। তার মধ্যে সবচেয়ে কম বৈঠক করেছে- লাইব্রেরি কমিটি (৫টি), বেসরকারি সদস্য বিল ও সিদ্ধান্ত প্রস্তাব সম্পর্কিত কমিটি (৮), খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি (৯টি), ডাক ও টেলিযোগাযোগ সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি (১০টি), অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি (১০টি), শিল্প মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটি (১৩টি), বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি (১৩), স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি (১৩),পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক সংসদীয় কমিটি (১৪), জনপ্রশাসন সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি (১৫), ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটি (১৫) বৈঠক করেছে। এছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি, শ্রম মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, ধর্ম মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, সরকারি প্রতিশ্রæতি সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি, সংসদবিষয়ক কমিটি, পিটিশন কমিটি ও কার্যপ্রণালি বিধি কমিটি ১৯টির কম বৈঠক করেছে। অথচ এসব কমিটির গত চার বছরে ৫০টির বেশি বৈঠক করার কথা ছিল।
আর ৩০টির বেশি বৈঠক করেছে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ডা. রুস্তম আলী ফরাজীর সভাপতিত্বে সরকারি হিসাব সম্পর্কিত কমিটি (১০৩টি), এর পরে আছে মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম (বীর-উত্তম) এমপির সভাপতিত্বে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি (৫৩টি), বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক সংসদীয় কমিটি (৩৭টি), মহিলা ও শিশুবিষয়ক কমিটি (৩৭টি), পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি (৩৪টি), মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি (৩৩টি), পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি (৩২), সংস্কৃতিবিষয়ক সংসদীয় কমিটি (৩২), দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি (৩১) এবং সরকারি প্রতিশ্রæতি সম্পর্কিত কমিটি ৩১টি বৈঠক করেছে।
কমিটির বৈঠকের গুরুত্ব সম্পর্কে সাবেক হুইপ এবং আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি মো. শহীদুজ্জামান সরকার বলেন, সংসদীয় কমিটিগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। মন্ত্রণালয়গুলো যাতে যথেচ্ছাচার করতে না পারে, তারা যাতে তাদের কাজকর্ম সঠিকভাবে করে, প্রতিটি ক্ষেত্রে যাতে দায়বদ্ধ থাকে সেজন্য সংসদীয় কমিটি মনিটর করে থাকে। সংসদীয় কমিটির কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হয়। তবে সংসদীয় কমিটির নিয়মিত বৈঠক করা বিশেষ জরুরি। কিন্তু দুঃখের বিষয় কোভিড মহামারির কারণে বিগত ২ বছরে নিয়মিত বৈঠক হয়নি। মন্ত্রণালয়গুলো যেসব প্রকল্প নেয় সেগুলো সংসদীয় কমিটি মনিটর করে। আর তার ফলে মন্ত্রণালয়ের কাজকর্মে জবাবদিহিতা থাকে।
কমিটির বৈঠক নিয়মিত হওয়া জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনি বলেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদীয় কমিটির গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা, মন্ত্রণালয়গুলো যে কাজকর্ম করে, যে প্রকল্প গ্রহণ করে তা জবাবদিহিতার মধ্যে আনার জন্য সংসদীয় কমিটি ভূমিকা রাখে। স্পিকার বলেন, বেশির ভাগ কমিটি নিয়মিত বৈঠক করে বলে আমি জানি। বিশেষ কারণে কোনো কমিটি নিয়মিত বৈঠক করতে না পারলে সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে।
মূলত সংসদীয় কমিটির প্রধান কাজ কমিটির আওতাধীন মন্ত্রণালয়ের কাজ পর্যালোচনা, অনিয়ম ও গুরুতর অভিযোগ তদন্ত করা। বিল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দেয়া বা সুপারিশ করাও সংসদীয় কমিটির কাজ। কিন্তু বাস্তবে মন্ত্রণালয়গুলো সংসদীয় কমিটির কোনো সুপারিশ মানে না। আর কমিটি তাদের সুপারিশ না মানলে কোনো কিছু করারও নেই। বরং অনেক কমিটি মন্ত্রণালয় থেকে নানা ধরনের সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সংসদীয় কমিটির কার্যবিবরণী থেকে জানা গেছে, ব্যক্তিগত বিষয় নিয়েও আলোচনা হচ্ছে কমিটিতে। চাইছে মন্ত্রণালয়ের খরচে বিদেশ ভ্রমণে যেতে, হজে যেতে ইত্যাদি।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জাতীয় সংসদকে যেভাবে জবাবদিহিতার ক্ষেত্র হিসেবে পাওয়ার কথা সেভাবে আমরা পাইনি। সরকারি দলের একচ্ছত্র ভুবন হওয়ায় এখানে চেক এন্ড ভ্যালেন্সের কোনো সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, সংসদীয় কমিটির কার্যকারিতা নির্ভর করে সংসদের চরিত্রের ওপর। শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকায় সংসদের প্রতি জনগণ আগ্রহ হারাচ্ছে।
তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়গুলোর কাজকর্ম জবাবদিহিতার মধ্যে আনার জন্য সংসদীয় কমিটির ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু আমাদের সংসদীয় কমিটিগুলো তেমন ভূমিকা পালন করছে বলে মনে হয় না। তাছাড়া মন্ত্রণালয়গুলো কমিটির সুপারিশ খুব বেশি বাস্তবায়ন করে না। এসব কারণে সংসদীয় কমিটিগুলো প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে পারছে না।