নড়াইলের সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা দেওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে কলেজ শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল দায়ী। এছাড়া সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আক্তার হোসেনের ভূমিকাও ছিল রহস্যজনক। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এমন সব তথ্য উঠে এসেছে। রোববার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এদিকে আইন ও সালিশকেন্দ্রের এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
জানা যায়, ১৩ জুলাই মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক শাহেদুল খবির চৌধুরী স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পাঠানো হয়। সরেজমিন তদন্ত এবং সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য ও ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে তদন্ত কমিটি। এতে ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা পরানোর বিষয়টির সত্যতা উঠে এসেছে। এছাড়া তদন্তে চারটি বিষয় আসে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়-প্রথমত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আরেকটু সতর্ক হলে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো যেত। দ্বিতীয়ত, কলেজের অধ্যক্ষ পদটি দীর্ঘদিন ধরে শূন্য থাকায় কলেজের কতিপয় শিক্ষকের মধ্যে পদটি দখলের প্রতিযোগিতা চলছে। তৃতীয়ত, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন-পরবর্তী সময় বহিরাগতদের আন্দোলনে পরিণত হওয়া এবং অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা দেওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে কলেজের শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল দায়ী। চতুর্থত, সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য ও ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক ও সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আক্তার হোসেনের ভূমিকা রহস্যজনক ও প্রশ্নবিদ্ধ ছিল।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়-মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র রাহুল দেব রায় তার ফেসবুক আইডিতে ১৭ জুন রাতে একটি বিতর্কিত পোস্ট দেন। পরদিন সকালে রাহুল কলেজে এলে অন্য ছাত্ররা তাকে পোস্টটি মুছে ফেলতে বলেন। কিন্তু তা মুছে না ফেলায় ছাত্ররা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের কাছে রাহুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানান। অধ্যক্ষ তখন রাহুলকে আটকে রেখে পুলিশে খবর দেন। পুলিশ এসে তাকে নিয়ে যেতে চাইলে ছাত্ররা বাধা দেয়। কিন্তু এর আগেই এলাকায় খবরটি ছড়িয়ে পড়লে ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ করে। পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করলে প্রশাসন অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করে এবং উত্তেজনা কমাতে কয়েক রাউন্ড টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। এরই মধ্যে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা পরানো হয়। এদিকে পরিস্থিতি খারাপ হলে কলেজ বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।
বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ : এদিকে অধ্যক্ষ শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরানোর ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আইন ও সালিশকেন্দ্রের করা এক রিট আবেদনের শুনানি শেষে বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী ও বিচারপতি এসএম মনিরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ সোমবার রুলসহ এ আদেশ দেন। আগামী ছয় সপ্তাহের মধ্যে নড়াইলের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমকে শিক্ষক লাঞ্ছনার তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে আদেশে।
নড়াইলের ঘটনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রশাসন ও পুলিশের উপস্থিতিতে ‘জনতার বিচার’ বন্ধে এবং লাঞ্ছনার শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষায় বিবাদীদের ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না-তা জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে। স্বরাষ্ট্র সচিব, নড়াইল জেলা প্রশাসক, পুলিশের মহাপরিদর্শক, নড়াইল পুলিশ সুপার, নড়াইল সদর থানার ওসিকে রুলের জবাব দিতে বলেছেন হাইকোর্ট।
আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী জেড আই খান পান্না ও আইনজীবী অনীক আর হক। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সমরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস। শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরানোর ঘটনার তদন্ত চেয়ে ৪ জুলাই এ রিট আবেদনটি করা হয়েছিল।
ওই সময় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে কলেজের ছাত্র ও স্থানীয়রা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেয়। ওই ঘটনার কিছু ছবি ও ভিডিও ফেসবুকে আসে, যাতে পুলিশের উপস্থিতিও দেখা যায়।
হামলার ঘটনা তদন্ত ও জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা চেয়ে সোমবার হাইকোর্টে আরেকটি সম্পূরক আবেদন করে আইন ও সালিশকেন্দ্র। তবে এ আবেদন গ্রহণ না করে ফেরত দিয়েছেন আদালত।