রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. তাহের আহমেদ হত্যা মামলার দুই ফাঁসি দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সঙ্গে শেষ দেখা করেছেন স্বজনরা। মঙ্গলবার (২৫ জুলাই) দুই পরিবারের স্বজনরা কারাগারে গিয়ে আলাদাভাবে আসামিদের সঙ্গে দেখা করেছেন।
এর আগে, সাক্ষাতের জন্য গত রবিবার রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ পরিবার দুটিকে চিঠি দেয়। মঙ্গলবার তারা এসেছেন।
রাজশাহী কারাগারের একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রস্তুত রাখা হয়েছে মঞ্চ, পাঁচ জল্লাদ ও লাশবাহী গাড়ি। মঙ্গলবার ফাঁসি নাহলেও কয়েকদিনের মধ্যে তা কার্যকর করা হবে।
কারাগারের ওই সূত্র জানিয়েছে, কিছু জটিলতা থাকার কারণে কয়েকদিনের মধ্যে ফাঁসি কার্যকর করা হবে। তাদের পছন্দের খাবার এখনও দেওয়া হয়নি। দুয়েকদিনের মধ্যে জেনে তাদের পছন্দের খাবার দেওয়া হবে।
এদিকে, স্বজনদের এভাবে ডেকে সাক্ষাতের সুযোগ করে দেওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে, যেকোনও সময় অধ্যাপক তাহের হত্যা মামলার দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর হতে পারে।
জানা গেছে, আজ সকাল ১১টার দিকে রাবির একই বিভাগের বরখাস্ত হওয়া সহযোগী অধ্যাপক দণ্ডপ্রাপ্ত মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের স্বজনেরা সাক্ষাৎ করেন। অনেকটা গোপনে একটি কালো মাইক্রোবাসে করে তারা কারাগারের প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেন। সাক্ষাৎ শেষে দুপুরে তারা আবার মাইক্রোবাসে চড়েই চলে যান।
দুপুর ১২টার দিকে অপর আসামি ড. তাহেরের বাসার তত্ত্বাবধায়ক জাহাঙ্গীর আলমের স্বজনরা আসেন। দুপুর পৌনে ১টার দিকে তারা ভেতরে প্রবেশ করেন। হুইল চেয়ারে বসে এসেছিলেন জাহাঙ্গীরের প্যারালাইজড বাবা আজিম উদ্দিনও। ছিলেন বড় ভাই সোহরাব আলী, ছোট ভাই মিজানুর রহমানসহ প্রায় ৪০ জন। বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে তাদের কারাগারের পেছনের ফটক দিয়ে বের করা হয়।
জাহাঙ্গীর আলমের ছোট ভাই মিজানুর রহমান বলেন, ‘ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে। তিনি সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন। পরিবারের সব সদস্যের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। সবাইকে ধৈর্য ধারণ করতে বলেছেন।
বিচার নিয়ে তিনি কোনও মন্তব্য করেননি।’
এই আসামির বাবা আজিম উদ্দিন বলেন, ‘ছেলের সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছে। মাঝখানে তারকাটা ছিল। ছেলেকে ছুঁয়ে দেখতে পারিনি। ছেলে দোয়া চেয়েছে।’
কারাগারের সামনে উপস্থিত স্বজনদের সূত্রে জানা গেছে, গত রবিবার তাদের চিঠি দিয়ে সাক্ষাতের জন্য ডাকা হয়। ভেতরে ঢোকানোর সময় তাদের সবার জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি নেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ মঙ্গলবার সকালে চূড়ান্ত রায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামি জাহাঙ্গীরের ফাঁসি কার্যকরের প্রক্রিয়া স্থগিত চেয়ে করা আবেদন খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ।
কারাগার সূত্র জানায়, সাধারণত মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সময় যে কর্মকর্তাদের উপস্থিত থাকার কথা তারা কারাগারে এক বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক আবদুল জলিল ফোন ধরেননি। রাজশাহী সিভিল সার্জন আবু সাঈদ মো. ফারুককে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কেটে দেন।
মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন তার ছোট ভাই রাবির মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক নির্ঝর রহমান। মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে মানসিক অবস্থার কারণে তিনি কথা বলতে চাননি।
রাজশাহী জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, ‘রায় কখন কার্যকর করা হবে সে বিষয়ে আমি এখনও কিছু জানি না। এ তথ্যও আমার কাছে নেই।’
প্রসঙ্গত, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টার থেকে ২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নিখোঁজ হন অধ্যাপক তাহের আহমেদ। ২ ফেব্রুয়ারি তার লাশ বাসার পেছনের ম্যানহোল থেকে উদ্ধার হয়। এই হত্যা মামলার তদন্তে উঠে আসে, পদোন্নতি না পাওয়ার ক্ষোভে অধ্যাপক তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন একই বিভাগের শিক্ষক মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। এ মামলার বিচার শেষে ২০০৮ সালের ২২ মে রাজশাহীর দ্রুত বিচার আদালতের বিচারক চার জনকে ফাঁসির আদেশ দেন। এ ছাড়া দুজনকে খালাস দেন আদালত।
পরে সাজাপ্রাপ্তরা উচ্চ আদালতে আপিল করেন। আপিল বিভাগ মিয়া মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীর আলমের রায় বহাল রাখলেও আসামি নাজমুল আলম ও তার স্ত্রীর ভাই আব্দুস সালামের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন দেন। আপিলে সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন হওয়া দুই আসামির দণ্ড বৃদ্ধি চেয়ে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। শুনানি শেষে ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের রায়ই বহাল রাখেন। অন্যদিকে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামির স্বজনরাও দণ্ড কমাতে একের পর এক আইনগত প্রক্রিয়া চালিয়ে যান।
তবে, সবখানেই দুজনের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। সবশেষ জাহাঙ্গীরের ভাই সোহরাব জাহাঙ্গীরের আটকের বৈধতা নিয়ে একটি রিট করেছিলেন। শুনানি শেষে গত ১৭ জুলাই বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী ও বিচারপতি মো. আলী রেজার হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রিট খারিজ করে দেন। পরে আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করে ফাঁসি কার্যকরের প্রক্রিয়া স্থগিত চাওয়া হয়। সেই আবেদন মঙ্গলবার সকালে খারিজ করে দেওয়া হয়। প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে আপিল বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এর আগে আসামির প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করেছেন রাষ্ট্রপতি।