সদ্য প্রয়াত নেত্রকোনা সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক সুভাষ চন্দ্র রায়ের দান করা কর্নিয়ায় আলো ফিরে পেয়েছেন দুজন। এই শিক্ষক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) মরণোত্তর দেহদান করেন। এরপর তার দুটি কর্নিয়া দুজনের চোখে প্রতিস্থাপন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসকরা।
আজ বুধবার (২৪ জানুয়ারি) সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের এনাটমি বিভাগের প্লাস্টিনেশন ল্যাবে এই মরণোত্তর দেহ গ্রহণ করেন বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসকরা জানান, সুভাষ চন্দ্র রায় সিভিয়ার এ্যানিমিয়া স্ট্রোক ইরোসিভ গ্যাসট্রাইটিস সমস্যায় ভুগছিলেন। গত ১৯ জানুয়ারি স্বজনরা তাকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করান। পরদিন মারা যান তিনি। মৃত্যুর আগেই মানুষের কল্যাণে নিজের দুটি কর্নিয়া ও আইবলসহ মরণোত্তর দেহদান করেছিলেন এই শিক্ষক। মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্য তার দুটি কর্নিয়া সংরক্ষণ করেন।
পরদিন ২১ জানুয়ারি বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদের তত্ত্বাবধানে বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসকরা কর্নিয়া দুটি দুই রোগীর চোখে সফলভাবে প্রতিস্থাপন করেন। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিটি অপথালমোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শীষ রহমান নেত্রকোনার ৬২ বছর বয়সী সুবের আলী নামের এক রোগীর চোখে একটি ও চক্ষু বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রাজশ্রী দাস পটুয়াখালীর ৫২ বছরের জাহাঙ্গীর আলম নামের আরেক রোগীর ডান চোখে প্রতিস্থাপন করেন।
মরণোত্তর দেহদানের সময় উপাচার্য এই মহৎ উদ্যোগের প্রশংসা এবং মরণোত্তর দেহ দানকারি সুভাষ চন্দ্র রায়ের বড় ছেলে তিতাস রায় এবং ছোট ছেলে পিয়াস রায়সহ পরিবারের সকলের প্রতি এই ত্যাগের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
উপাচার্য বলেন, নেত্রকোনার সরকারি কলেজের সাবেক প্রিন্সিপাল অধ্যাপক সুভাষ চন্দ্র রায় সচেতন নাগরিক ছিলেন। তাই তিনি মরণোত্তর দেহদান করে গেছেন। তাদের মতো মানুষ সচেতন হলে ভবিষ্যতে অঙ্গসংযোজনের সমস্যা থাকবে না।
এ ব্যাপারে সুভাষ চন্দ্র রায়ের ছোট ছেলে পিয়াস রায় বলেন, বাবার দেহদানের বিষয়টির অনুভুতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। কারণ প্রথাগতভাবে একজন মানুষের মৃত্যুর পর ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে যা যা করার বিধান আছে, সে সবই করা হয়। কিন্তু আমরা ও আমাদের বাবা এ ব্যাপারে সহমত ছিলাম যে মরণোত্তর দেহদান করা হবে। সেটাই হয়েছে।
পিয়াস রায় আরও বলেন, বাবা বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন। হেমিওপ্যাথির চিকিৎসক ছিলেন। তার ওই চিন্তা ছিল যে, শুধু চোখ কেন, আর কোনো অঙ্গও যদি মানুষের জীবন বাঁচানোর ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা যায়, উনি সেটা করে যাবেন। সৌভাগ্য ক্রমেই সেই ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। দুজনের চোখে দুটি কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। রেটিনাসহ চোখের আরও কিছু অংশ আরও কিছু মানুষের দেহে প্রতিস্থাপন করা হবে।
সুভাষ চন্দ্র রায়ের দুই সন্তান। বড় ছেলে তিতাস রায় ঢাকায় ব্রাক ব্যাংকে ও ছোট ছেলে পিয়াস রায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে কর্মরত। বাবা, মা ও নিজের দেহদানের কাগজপত্র গত নভেম্বরের শুরুতেই সম্পন্ন করেন পিয়াস রায়। বাবার বয়স ছিল ৮১ বছর। মা দেবি রায় গৃহিনী।
সুভাষ চন্দ্র রায় ও মা দেবি রায় ঢাকায় ছেলেদের কাছেই থাকতেন। ১৯ জানুয়ারি সকালে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন সুভাষ চন্দ্র রায়। তাকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর সেদিন দিবাগত রাত ২টা ৪৫ মিনিটে মারা যান।
পিয়াস রায় বলেন, আজ (গতকাল) অফিসিয়ালি মরদেহ গ্রহণ করেছে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ। ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে সৎকার কাজ ছাড়া শ্রাদ্ধসহ বাবার আত্মার শান্তির জন্য সবকিছু করা হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এনাটমি বিভাগে মরণোত্তর দেহদানকালে মরণোত্তর দেহদানকারি সুভাষ চন্দ্র রায়ের বড় ছেলে তিতাস রায় এবং ছোট ছেলে পিয়াস রায়সহ পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
পরে সুভাষ চন্দ্র রায়ের মরদেহটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনাটমি বিভাগে সংরক্ষণ করা হয়। এটি শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ ও গবেষণার কাজে ব্যবহার করা হবে। মরণোত্তর দেহদানের অনুমতিপত্র এনাটমি বিভাগের চেয়ারম্যানের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। মরদেহের এমবামিং প্রক্রিয়ার শুরুর সময় মরদেহের যথোচিত সম্মান ও পবিত্রতা রক্ষার জন্য শপথ গ্রহণ করা হয়।
সুভাষ চন্দ্র রায়ের জন্ম ৩১ ডিসেম্বর ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি ছিলেন বাংলাদেশী স্থায়ী নাগরিক। মৃত্যুর আগে ঢাকায় বাংলাদেশ নোটারী পাবলিক কার্যালয়ে স্বজ্ঞানে ও কারো প্ররোচনা ছাড়াই পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করেন। সুভাষ চন্দ্র রায়ের পরিবারের অপর চার সদস্যের মধ্যে স্ত্রী দেবি রায় ও ছোট ছেলে পিয়াস রায় ইতোমধ্যেই মরণোত্তর দেহদান করেছেন। বড় ছেলে তিতাস রায়ও ভবিষ্যতে দেহদান করবেন বলে জানান পিয়াস রায়।