শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার ডা. মোসলেম উদ্দিন খান ডিগ্রি কলেজের সভাপতি ও অধ্যক্ষের ধারাবাহিক অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে শিক্ষাব্যবস্থায় অচলাবস্থা তৈরি হয়ে ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে এগোচ্ছে কলেজটি। অভিযোগ উঠেছে, সভাপতি ও অধ্যক্ষ কলেজ না এসে বাইরে থেকে হুকুম দিয়ে কলেজ পরিচালনা করছে, শিক্ষকদের মধ্যে হতে জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের বাদ দিয়ে কনিষ্ঠ শিক্ষকদের পদায়ন করেছেন, পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচনে অনিয়ম, টাকা লেনদেনের বিষয়ে কলেজের রশিদ বই ব্যবহার না করে সাদা কাগজে স্লিপের মাধ্যমে তার নিজের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা, নিয়োগ বাণিজ্য। এ নিয়ে কথা বলায় শিক্ষকদের বেতন তালিকায় স্বাক্ষর করছেন না প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি। ফলে কেউ ৪ বছর, কেউ আবার ৬ মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না। গভর্নিং বডি নির্বাচন অধ্যক্ষের বাসায় বসে সম্পন্ন হয়েছে। গত চার বছর ধরে স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি আবদুল আলীম বেপারি একদিনও কলেজে মিটিং করেননি বলে অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষকরা তাদের যৌক্তিক দাবি নিয়ে আদালতের দারস্থ হওয়ায় শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, নামে ডিগ্রি কলেজ হলেও প্রকৃতপক্ষে ডিগ্রির কোনো ছাত্রছাত্রী শ্রেণিকক্ষে নেই। ডিগ্রির শ্রেণিকক্ষে ক্লাস করছে ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারের ১৩ জন ছাত্রী। এর পাশের কক্ষে গিয়ে দেখা যায় ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাসে মাত্র ৫ জন ছাত্রী নিয়ে ক্লাস করাচ্ছেন একজন শিক্ষক। বাকি সব কক্ষ খালি পড়ে আছে। বেশিরভাগ কক্ষগুলোতে ধুলা-ময়লা জমে আছে। কলেজের এ ভগ্নদশার কারণ জানতে চাইলে উঠে আসে কলেজের অধ্যক্ষ দোলোয়ার হোসেন ও সভাপতি আব্দুল আলীম বেপারির দুর্নীতির ফিরিস্তি।
কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য স্থানীয় সমাজসেবক মাওলানা তাজুল ইসলাম সেলিম বলেন, আমাকে একদিন ডেকে বলে, আপনাকে এ কলেজের পরিচালনা কমিটির সদস্য করা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে আমাকে কোনো কাগজপত্র দেয়নি। গত দুই বছরে কলেজ পরিচালনা কমিটির কোনো মিটিং সিটিং হয়নি। তবে মাঝে মাঝে আমাকে বলে খাতায় স্বাক্ষর দেন আমি দিয়ে দেই। কলেজের গাছগুলো বিক্রি করে টাকা নিয়ে গেছে। সেই টাকা কোথায় খরচ করেছে তা আমাকে জানায়নি। আমাদের সভাপতি আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি বিধায় তার বিষয়ে কেউ কোনো কথা বলে না। তিনি ঢাকায় বসে কলেজের সকল কর্মকাণ্ড করেন। গত প্রায় এক মাসেরও বেশি সময় ধরে কলেজের অধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন কলেজে আসেন না। তিনি মাদারীপুরের নিজ বাড়িতে বসে কলেজ পরিচালনা করেন। যার ফলে কলেজের এ নাজুক অবস্থা। দিন দিন ছাত্রছাত্রী কমে যাচ্ছে। কাগজে কলমে ডিগ্রির ছাত্রছাত্রী থাকলেও কেউ কলেজে আসে না। নতুন করে কেউ এ কলেজে ভর্তি হতেও আসে না। আমরা সচেতন এলাকাবাসী এ কলেজটিকে বাঁচাতে চাই। তাই অনতিবিলম্বে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
স্থানীয় আনোয়ার হোসেন খান বলেন, এই কলেজের অধ্যক্ষের মুখ কখনোই দেখতে পাই না। তিনি অফিস করেন মাদারীপুর বসে ও সভাপতি থাকেন সবসময় ঢাকা। তাদের কারণে এই কলেজের আজ অধঃপতন। এই কলেজে তেমন কোনো শিক্ষার্থী নেই, উন্নয়নও নাই। কলেজের অধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন ও গভর্নিংবডির সভাপতি আব্দুল আলিম বেপারি নিয়োগ বাণিজ্য, দুর্নীতি, ঘুষ ও অনিয়মে জড়িত। তাই আমরা তাদের অপসারণ দাবি করছি।
পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচনের জন্য গঠিত সচিব সহকারী প্রভাষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমাকে নামে মাত্র সচিব বানিয়ে রেখেছেন, যা কেবল কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ। তবে কবে, কখন, কোথায় বসে তারা নির্বাচন করেছেন তা আমার জানা নেই। তবে এই কলেজ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে আমার বেতন ১১ বছর বন্ধ ছিল।
স্বর দীপ কুমার রায় দীর্ঘ ২৮ বছর চাকরি করেও জ্যেষ্ঠ প্রভাষক পদন্নোতি না পেয়ে আদালতে মামলা করলে, অধ্যক্ষ ও সভাপতি তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে বিগত ৬ মাস ধরে তার বেতন ভাতার সিটে স্বাক্ষর করে না। যার ফলে তার বেতন-ভাতা উঠাতে পারছেন না তিনি। স্বর দীপ কুমার বলেন, অর্থের অভাবে অতি কষ্টে জীবন পরিচালনা করছি। আমি অসুস্থ মানুষ, প্রতিদিন ওষুধ কিনতে হয়। তাই উপায় না পেয়ে বাবার সম্পত্তি বন্ধক রেখেছি। এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে জীবনযাপন করছি।
কলেজের উপধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পাওয়া হিসাববিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমি বর্তমান সভাপতি আব্দুল আলীম বেপারি ও অধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেনের অনিয়মের বিষয়ে কথা বলায় তারা আমাকে কলেজ থেকে চাকরিচ্যুত করার পাঁয়তারা করেন। এর অংশ হিসেবে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে বিগত চারটি বছর আমার বেতন ভাতার সিটে স্বাক্ষর করেন না। তারা আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেন। সেই মামলা হতে মুক্ত হয়ে সেই কাগজপত্র সাবমিট করলেও আমার বেতন ভাতার সিটে স্বাক্ষর করেননি। ডিজি অফিস হতে তাদেরকে বেতন ভাতার বিলে স্বাক্ষর করতে আদেশ জারি করলেও তা আমলে নেয়নি। আজ চারটি বছর আমার বেতন ভাতা বন্ধ থাকায় আমি পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবতর জীবনযাপন করছি।
তিনি বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট আমার আবেদন, এই দুর্নীতিবাজ অধ্যক্ষ ও সভাপতির হাত থেকে কলেজটিকে মুক্ত করে আমাদের বাঁচার সুযোগ করে দিন। দরকার হলে আমাদের বেতন ভাতার সিটসহ সকল অর্থনৈতিক কাজকর্ম জেলা প্রশাসক অথবা তার প্রতিনিধি হিসেবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হোক।
কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি আব্দুল আলীম বেপারির মোবাইল ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
কলেজের অধ্যক্ষ মো. দেলোয়ার হোসেনে বলেন, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো মিথ্যা ও হয়রানিমূলক। তবে অনিয়মগুলোর বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বিশেষ করে, গভর্নিং বডির অভিভাবক সদস্য নির্বাচন, প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নিয়োগ, নির্বাচনী তপশিল প্রকাশ বা নোটিশ প্রদানের কোনো প্রমাণাদি সাংবাদিকদের দেখাতে পারেননি।
তিনি বলেন, মোস্তাফিজুর রহমান শিবচরের একটি কলেজের অধ্যক্ষ দায়িত্ব পালন করছেন। তাই দুই স্থান থেকে বেতন পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই, তাই তারটা বন্ধ রয়েছে। পদোন্নতি যারা পাওয়ার যোগ্য তারা পেয়েছে। আমি কলেজ মাঝেমধ্যে যাই কারণ কলেজে গ্রুপিং চলে, আমি গেলে আমার ওপরে হামলা হওয়ার ভয়ে কম যাই। হাজিরা খাতা যেখানে সেখানে রাখার জিনিস না তাই আমার সঙ্গেই রাখি। আমার নামে তারা শুধু শুধু আদালতে মিথ্যা মামলা দিছে এবং মিথ্যা অভিযোগ আপনাদের কাছে বলেছে।
জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুল হাসান বলেন, ডা. মোসলেম উদ্দিন খান ডিগ্রি কলেজের নানাবিধ অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকটি দরখাস্ত আমার নিকট এসেছে। আমি সেই দরখাস্তগুলো জেলা প্রশাসকের নিকট পাঠিয়েছি। প্রশাসক স্যার বিষয়টি দেখবেন।