অনুসন্ধানের যোগ্য নয় দুদকে জমা পড়া লাখো অভিযোগ

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

দুর্নীতি ও অনিয়মের হাজার অভিযোগ প্রতিবছর জমা পড়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। কিন্তু অনুসন্ধানের জন্য সংস্থাটি আমলে নেয় ৫ শতাংশ অভিযোগ। বাকি অভিযোগের মধ্যে ১৩ শতাংশ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো এবং ৮২ শতাংশ শুধু নথিভুক্ত করে রাখা হয়। গত ছয় বছরে অভিযোগ বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। দুদক বলছে, বেশির ভাগ অভিযোগই আমলযোগ্য বা দুদকের কর্মতালিকার (তফসিল) অন্তর্ভুক্ত নয়।

দুদক সূত্র জানায়, গত ছয় বছরে সংস্থাটিতে ১ লাখ ৮ হাজার ৫৪৬টি অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে মাত্র ৬ হাজার ১৬৮টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করে সংস্থাটি, শতকরা হিসাবে যার পরিমাণ ৫ শতাংশের কিছু বেশি। বাকি অভিযোগগুলোর মধ্যে ৮২ শতাংশ তথা ৮৮ হাজার ৪৬০টি অভিযোগ শুধু নথিভুক্ত করে রাখা হয়েছে, যা আমলে নেওয়া হয়নি। অবশিষ্ট প্রায় ১৩ শতাংশ তথা ১৩ হাজার ৮৯৮টি অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও দপ্তরে পাঠানো হয়।

৮২ শতাংশ অভিযোগ অনুসন্ধানের আওতায় না আসার বেশ কিছু কারণ জানিয়েছে দুদক। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, ব্যক্তিগত বিরোধ, পারিবারিক ও ব্যবসায়িক বিরোধ, জমি দখল, মারামারি, প্রতিবেশীর সঙ্গে বিরোধ, সহকর্মীর সঙ্গে ব্যক্তিগত বিরোধ, কর্মস্থল বদলি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে অভিযোগ, অভিযোগের অস্পষ্টতা, অভিযোগে তথ্য বিভ্রাট, অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম-ঠিকানা না থাকা এবং অভিযোগের সুনির্দিষ্ট তথ্য উল্লেখ না থাকা। এগুলোকে মোটাদাগের কারণ বলছে দুদক।

বড় অংশ অনুসন্ধানের বাইরে থাকার বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেন, কোনো অভিযোগে যদি নাম-ঠিাকানা নাও থাকে, এমনকি সাদা কাগজ হলেও তা ফেলে দেওয়া হয় না। সেগুলো নম্বর দিয়ে রাখা হয়। সেজন্য এই সংখ্যাটি এত বড়। কিছু মানদ- বিবেচনা করে অভিযোগ অনুসন্ধানে নেওয়া হয়। মানদ-ের বাইরে অভিযোগ অনুসন্ধান করে কাক্সিক্ষত ফল আসে না।

একই কথা বলেছেন ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দুদকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করা ও কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। দুদকের এই সাবেক চেয়ারম্যান বলেন, ‘অনেকেই বেহুদা অভিযোগ করে, যেগুলো দুদকের আইনে পড়ে না। আমার সময়ে আড়াই থেকে তিন শতাংশ অভিযোগ গ্রহণ করা হতো। অনেকেই অযথা বিষয়ে অভিযোগ করে বসে থাকে। ভাইয়ে ভাইয়ে ঠেলাঠেলি, ওইটাও দুদকে অভিযোগ করে দিল! হয়রানিমূলক অনেক অভিযোগ আসে। যে কারণে সব অভিযোগ অনুসন্ধানে নেওয়া সম্ভব না।’ 

তবে দুদকের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়াতে এসব অনুসন্ধান ‘অযোগ্য’ অভিযোগগুলোর বিষয়ে যথাযথ কারণ উল্লেখ করে তা অভিযোগকারীদের জানানোর পরামর্শ দিয়েছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘মানুষের আস্থা বৃদ্ধির জন্য দুদকের যা করা উচিত তা হলো- তাদের বিবেচনায় যেগুলো অনুসন্ধানের আওতায়ভুক্ত হলো না বা নথিভুক্ত করা হয়েছে, সেগুলো কোন বিবেচনায় করা হয়েছে তা ব্যাখ্যাসহ দুদকের ওয়েবসাইটে প্রকাশের পাশাপাশি অভিযোগকারীকে জানানো উচিত বলে মনে করি। এর ফলে মানুষ মনে করবে তাদের অভিযোগ পেয়ে দুদক যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে দুদককে যে আস্থার সংকট আছে বলে বলা হয়, তা অনেকটা দূর হবে।’

দুদকে গত ছয় বছর দুর্নীতি ও অনিয়ম সংক্রান্ত জমা পড়া অভিযোগের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সর্বশেষ গত বছর (২০২২ সাল) দুদকে মোট ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ জমা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৯০১টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করা হলেও ১৫ হাজার ২৮৫টি অভিযোগ নথিভুক্ত করা হয়। বাকি ৩ হাজার ১৫২টি অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও দপ্তরে সুপারিশ করা হয়েছে।

এর আগের বছর ২০২১ সালে ১৪ হাজার ৭৮৯টি অভিযোগ জমা পড়লেও মাত্র ৫৩৩টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করা হয়। বাকি অভিযোগের মধ্যে ১১ হাজার ৩৬৭টি অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে; এবং ২ হাজার ৮৮৯টি অভিযোগের বিভিন্ন বিভাগ ও দপ্তরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ২০২০ সালে ১৮ হাজার ৪৮৯টি অভিযোগ জমা পড়েছিল। এর মধ্যে ৮২২টি অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়। আরও ১৫ হাজার ১৯৮টি অভিযোগ নথিভুক্ত হয়। ২ হাজার ৪৪৯টি অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও দপ্তরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

২০১৯ সালে ২১ হাজার ৩৭১টি অভিযোগ জমার বিপরীতে অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেওয়া হয় ১ হাজার ৭১০টি অভিযোগ। ১৬ হাজার ৩৪টি অভিযোগ নথিভুক্ত করা হয়। বিভিন্ন দপ্তর ও বিভাগে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আরও ৩ হাজার ৬২৭টি অভিযোগ। ২০১৮ সালে জমা পড়া ১৬ হাজার ৬০৬টি অভিযোগের মধ্যে ১ হাজার ২৬৫টি অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ, ১৩ হাজার ৯৩৭টি নথিভুক্ত করা হয় এবং ১ হাজার ৪০৪টি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ২০১৭ সালে ১৭ হাজার ৯৫৩টি অভিযোগের মধ্যে ৯৩৭টি অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ, ১৬ হাজার ৬৩৯টি নথিভুক্ত এবং ৩৭৭টি দপ্তরে পাঠানো হয়।

দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ  বলেন, ‘সব অভিযোগই আমরা ফাইল (নথিভুক্ত) করে রাখি। পরে এগুলো দেখার জন্য একটি কমিটি আছে। সেখানে দেখা হয়, অভিযোগটি দুর্নীতি ও সরকারি স্বার্থসংশ্লিষ্ট কিনা, অর্থ অপচয়ের ঘটনা আছে কিনা, কারও কোনো ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয়েছে কিনা, সেসব বিষয় দেখে যেগুলো অনুসন্ধানের নেওয়ার মতো, সেগুলো নেওয়া হয়। বাকিগুলো ফাইল করে রাখা হয়।’

যে কোনো অভিযোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে ১০০ নম্বরের একটি মার্কিং করা হয়ে থাকে জানিয়ে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘অভিযোগটি দুর্নীতির অন্তর্ভুক্ত কিনা সেই বিষয়ে বিভিন্ন মানদ- বিবেচনা করে নম্বর দেওয়া হয়। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, এই পদ্ধতিতে যেগুলোতে ৬০ নম্বর পাওয়া না যায়, সেগুলো অনুসন্ধান করেও প্রকৃতপক্ষে কোনো ফল আসে না। আর যেগুলো ৬০ বা তার বেশি নম্বরে আসে সেগুলো অনুসন্ধানে নেওয়া হয়।’ তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগ কীভাবে আবেদন করতে হয় সে বিষয়ে দুদকের ওয়েব সাইটে সুনির্দিষ্টভাবে বলে দেওয়া আছে। দুদক থেকে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক একটি বার্তা প্রকাশ করা হয়, সেখানেও আবেদন সম্পর্কে বলা থাকে।’

প্রসঙ্গত দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগ দায়েরের ক্ষেত্রে দুদক যেসব বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে বলছে, সেগুলো হচ্ছে অভিযোগের বিবরণ ও সময়, অভিযোগের সমর্থনে তথ্য-উপাত্তের বিবরণ, অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম, পদবি ও ঠিকানা, অভিযোগকারীর নাম ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
আগের নিয়মে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগারিক নিয়োগের দাবি - dainik shiksha আগের নিয়মে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগারিক নিয়োগের দাবি শিক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধিদের সাক্ষাৎ - dainik shiksha শিক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধিদের সাক্ষাৎ মাদকের গডফাদারদের ধরার নির্দেশ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার - dainik shiksha মাদকের গডফাদারদের ধরার নির্দেশ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার শিক্ষা প্রশাসনে বদলি আতঙ্কে নাহিদ-দীপু সিন্ডিকেটের ৯২ কর্মকর্তা - dainik shiksha শিক্ষা প্রশাসনে বদলি আতঙ্কে নাহিদ-দীপু সিন্ডিকেটের ৯২ কর্মকর্তা দীপু মনি-রতন সিন্ডিকেটের ফিরোজই শিক্ষা অধিদপ্তরের এ ডি! - dainik shiksha দীপু মনি-রতন সিন্ডিকেটের ফিরোজই শিক্ষা অধিদপ্তরের এ ডি! বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই পক্ষের হাতাহাতি, সভা পণ্ড - dainik shiksha বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই পক্ষের হাতাহাতি, সভা পণ্ড শিক্ষকদের বদলির বিষয়ে সর্বশেষ - dainik shiksha শিক্ষকদের বদলির বিষয়ে সর্বশেষ অগ্রসর সমাজ তৈরির লক্ষ্যই বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন - dainik shiksha অগ্রসর সমাজ তৈরির লক্ষ্যই বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0049819946289062