‘আয় বুঝে ব্যয় করা’- এটি একটি প্রবাদ। তবে এই প্রবাদটি ব্যক্তি মানুষের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, একইভাবে একটি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু সরকারের ক্ষেত্রে তা নয়- বিপরীত। সরকারকে ব্যয় বুঝে আয় করতে হয়। হিসেবী মানুষেরা কষ্ট করে হলেও সংসার চালিয়ে নিতে চায় কিন্তু ঋণের বোঝা বাড়াতে চায় না। কিছু মানুষ আছেন যারা ঋণ করতে পছন্দ করেন এবং ঋণের টাকায় ঠাট বজায় রাখতে চান। ভারতীয় উপমহাদেশে বহু বছর আগে চার্বাক সম্প্রদায় ছিল। তাদের মূল দর্শন ছিল, ‘ঋণং কৃত্তা ঘিতং পিবেত, যাবত জীবেত সুখং জীবেত।’ অর্থাৎ ঋণ করে হলেও ঘি খাও, যতো দিন বাঁচবে সুখে বাঁচবে। কিন্তু এই আধুনিক যুগে এসে চার্বাক তত্ব যে বড়ই অচল। সেটার বড় প্রমাণ আমরা দেখেছি শ্রীলংকায়। ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে শ্রীলংকার অর্থনীতি মুখ থুবরে পড়েছে। শ্রীলংকা আজ একটি দেউলিয়া রাষ্ট্র। কোন যুদ্ধ নাই, নিজ দেশের ভিতরে তেমন কোন অস্থিরতা নেই, অধিকাংশ মানুষ শিক্ষিত তবুও ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে শ্রীলংকা। এর মূল কারণ হল নিজ দেশের উৎপাদনের দিকে নজর না দিয়ে বিদেশী টাকায় ঠাট বজায় রাখতে চাওয়া।
প্রকান্ড সব অবকাঠামো ঋণ নিয়ে তৈরি করাই যায়, পরিবেশ উন্নত আর ঝকঝকে করে ফেলা যায়, কিন্তু সেগুলি কি আর খাবারের যোগান দেয়? বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। কিন্তু প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে আবাদী জমির পরিমান। এর ফলে আমাদের প্রধান উৎপাদনশীল খাত হুমকিতে পড়ছে। প্রতি বছর বিপুল পরিমান আবাদী জমি কমে যাচ্ছে নদী ভাঙ্গন, বসতি স্থাপন, রাস্তা ও অবকাঠামো নির্মান, ইটের ভাটা নির্মানসহ নানা কারণে। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে জনসংখ্যা দ্রুত গতিতে বাড়ছে এবং এর চাপ সরাসরি পড়ছে আবাদী জমির ওপর। দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ ভাগ এবং মোট শ্রমশক্তির ৬০ ভাগ কৃষিতে নিয়োজিত।
ঢাকা ও বড় বড় শহর ও সেগুলোর আশেপাশের আবাদী জমিতে চলছে ফ্লাট নির্মানের উৎসব। অনুৎপাদনশীল এই ফ্লাট নির্মান কাজে বিনিয়োগ হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। শিল্পায়ন, নগরায়ন, আবাসন, অবকাঠামো নির্মান, নদী ভাঙ্গন সহ বিভিন্ন কারণে প্রতি বছর ৮০ হাজার হেক্টর আবাদী জমি অকৃষিতে রুপান্তিত হচ্ছে। প্রতিদিন হারিয়ে যাচ্ছে প্রায় ২১৯ হেক্টর আবাদী জমি। আর এভাবে চলতে থাকলে উৎপাদনশীল খাত নাজুক হয়ে পড়বে এবং হুমকিতে পড়বে খাদ্য নিরাপত্তা। আজ কৃষি শ্রমিকরা মাঠ ছেড়ে অটো নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছেন। কিন্তু অটো চালানো কোন উৎপাদনশীল কাজ নয়। আপাতত বেকারত্ব হয়তো ঘুচে কিন্তু সেটা মোটেও স্থায়ী সমাধান নয়।
আজ কৃষিখাতে শ্রমিক সংকটে সময়মত ফসল কাটা ও মাড়াই করা যায় না। শ্রমিকদের প্রতিদিনের মজুরিও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে কৃষকের উৎপাদন ব্যয়ই মিটে না। কৃষককে যেখানে প্রতিনিয়ত পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার কথা সেখানে সেখানে তারা প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছেন। জমি চাষ, সার প্রয়োগ, বীজ ক্রয়, আগাছা পরিস্কার করা, সেচ দেয়া, ফসল মাড়াই করা সহ যত খরচ হয় সেই টাকা কৃষকের হাতে আসে না। যার ফলে কৃষকেরা কৃষির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। সহজ শর্তে কৃষি লোনের ব্যবস্থা থাকলেও সব কৃষক সেই সুবিধা পান না। মাত্র ২৫ হাজার টাকার ঋনের জন্য কৃষককে যে ভয়ংকর নাজেহাল হতে হয়েছে সেটা আমরা পত্রিকায় দেখেছি।
বিশ্বের বেশ কিছু কৃষিপ্রধান রাষ্ট্রের চিত্র দেখলে কতগুলি বিষয় ফুটে ওঠে। কৃষকের বড় শত্রু আজ মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা। কৃষকরা পণ্যের নায্য মূল্য পায় না তাদের কারনে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় ক্ষেত থেকে যদি ফসল কিনে বড় বড় শহরে আনা যেত তবে কৃষকরা নায্য মূল্য পেত। কিন্তু মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা সব খেয়ে ফেলে। সেই প্রবাদের মতো, ‘ডিম পারে হাঁসে, খায় বাগদাশে’। সারা বিশ্বে আজ অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। ডলার সংকটে মুদ্রাস্থীতি দিন দিন বাড়ছে। উৎপাদন খাতে নজর না দিয়ে আর কোন উপায় নেই।
আমাদের বড় সম্পদ এবং প্রকান্ড আর্শীবাদ হল কৃষি। এমন উর্বর ভূমি বিশ্বে খুব একটা নেই। কিন্তু অবহেলার চাদরে ঢাকা পড়েছে আজ বৃহৎ এই উৎপাদন খাত। কৃষি বিপ্লব ঘটানোর জন্য সরকার চেষ্টা করছে। কিন্তু কৃষি খাত যে শ্রমিক সংকটে পড়ছে সেদিকে নজর না দিলে কোন বিপ্লবই হবে না। আজ পাহাড় কেটে ইটের ভাটা তৈরি হচ্ছে। কৃষি জমিতে ইটের ভাটা তৈরি হচ্ছে। দেখার যেন কেউ নেই। পরিবেশবাদীরা গলা ফাটাচ্ছেন কিন্তু যেই লাউ সেই কদু। ক্ষমতার দাপট চালিয়ে কিছু অসৎ মানুষ আজ উৎপাদন খাতকে নাজুক করে রেখেছেন। প্রতিবার নির্বাচনের আগে কৃষকেরা অনেক প্রতিশ্রুতি পান, কিন্ত্র নির্বাচন পরবর্তী সে সুবিধা পেতে তাদের গলদঘর্ম হতে হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রচুর ফসলহানি হয় আমাদের। কৃষকদের দুর্যোগকালীন সুবিধা আরো বেশি কিভাবে দেয়া যায় সেটাভাবা দরকার।
রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের প্রেরিত সিংহভাগ অর্থই ব্যয় হচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতে। বিদেশ থেকে শ্রমিকেরা যে অর্থ উপার্জন করে তা দিয়ে বড় বড় শহরে বিশেষ করে ঢাকায় ফ্লাট কিনে। এর ফলে ঢাকা শহর আরো ঘিঞ্জি হয়ে উঠছে, সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট। আবাদী জমি নষ্ট করে ফ্লাট নির্মানের যে হিড়িক তৈরি হয়েছে তা কাঙ্থিত নয়। ব্যাংকগুলোও ফ্লাট বা আবাসন ঋণ দিতে খুব আগ্রহী। হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ চলে যাচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতে। ব্যাংক বহির্ভূত নানা বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গুলোও অনুৎপাদনশীল খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে বহু মানুষ নিঃস্ব হয়ে গেছে।
প্রণোদনার ঋণেরও সঠিক ব্যবহার হওয়া আবশ্যক। দুঃখের বিষয় এই যে কৃষিতে দক্ষ শ্রমিক তৈরি হচ্ছে না। অনিয়ম, দুর্নীতি আর পন্যের নায্য মূল্য না পাওয়ার কারণে কৃষি বিমুখ হয়ে পড়ছে কৃষকেরা। কৃষিতে বিনিয়োগ করে কৃষকেরা তাদের ফিডব্যাক পাচ্ছেন না। কৃষিতে পর্যাপ্ত ভূর্তুকির অভাব রয়েছে। কৃষি ঋণকে আরো সহজ করতে না পারলে এই উৎপাদনশীল খাতটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এখনো আমরা আমদানী নির্ভরতার মাত্রা সহনশীল পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারি নি। এদিকে ঘুষ, দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, জুয়া, মাদক, ফটকা কারবারী, মধ্যস্বত্বভোগী এবং সিন্ডিকেটের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হতে পারি নি।
আমাদের অর্থনীতির চাকা হয়তো এগিয়ে যাচ্ছে। অবকাঠামো আর উন্নয়ন অবশ্যই দরকার, তবে সেটা অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখেই করতে হবে। অপরিকল্পিত নগরায়ন আর অবকাঠামো নির্মান করে অর্থ অপচয়ের কোন মানে হয় না। দেশে বেকারত্বের প্রচন্ড চাপ রয়েছে। সেইভাবে উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে না। উৎপাদনশীল খাতে উদ্যোক্তা তৈরি হওয়াটা জরুরি। দেশের অর্থ পাচার হয়ে যাওয়া অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। আমাদের বড় আশীর্বাদ হল কৃষির মত একটি বৃহৎ উৎপাদনশীল খাত আমাদের রয়েছে। এই খাতের দিকে সর্বোচ্চ নজর দিতে হবে।
দ্রব্য মূল্য যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে আমরা শঙ্কিত। জ্বালানীর মূল্য বৃদ্ধির লাগাম টানতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে পন্যের দাম বাড়লে সেটার প্রভাব দেশের অর্থনীতে পড়বে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরের সিন্ডিকেট আর অসাধু ব্যবসায়ীদের হাতে সব কিছু জিম্মি হতে পারে না। রাজধানীর মানুষগুলি আজ নানা মুখী সমস্যায় জর্জরিত। তীব্র যানজট, গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি, পানি সরবরাহে ঘাটতি, দুষণ আর লোডশেডিং তো লেগেই আছে। উন্নয়ন বলতে শুধু রাস্তা ঘাটের উন্নয়নকে বুঝায় না। একটি মজবুত ও টেকসই অর্থনীতি, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ নির্মান, রাজনৈতিক সম্প্রীতি, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সহ নানা কিছুকে বুঝায়। বিদেশী ঋণের বোঝা না বাড়িয়ে নিজের পায়ে কিভাবে দাঁড়ানো যায় সেদিকেই আমাদের মনোনিবেশ করা উচিত। মাথাপিছু আয় আমাদের এখন ভাল পর্যায়ে আছে। কিন্তু সেটাকে ধরে রাখতে হবে। উৎপাদন খাতকে অবহেলা করার অর্থই হচ্ছে আত্মহনন। যা কখনোই কারো কাম্য হতে পারে না।
লেখক : মাজহার মান্নান, কবি ও কলামিস্ট