অপরাধ নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন বলিষ্ঠ সামাজিক বলয়

মাছুম বিল্লাহশুভাশিস ব্যানার্জি শুভ |

দেশে প্রতিনিয়ত বিকৃত যৌনাচারসহ নানান ধরনের বীভৎস অপরাধের ঘটনা ঘটছে। মিডিয়ার কল্যাণে এসব ঘটনার কিছু প্রকাশ পেলেও এর বেশির ভাগই গোপন থাকছে। বিশেষ করে বিকৃত যৌনাচারের ঘটনা খুবই সামান্য প্রকাশ পাচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, সামাজিক মূল্যবোধ, নৈতিক অবক্ষয়, পারিবারিক বন্ধন ঢিলে হয়ে যাওয়া, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, বিষণ্নতা-হতাশা, মাদকের ক্ষতিকর প্রভাব আর বিচারহীন সংস্কৃতির কারণে বিকৃত নৃশংস অপরাধের সংখ্যা বাড়ছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ইদানীং খুনি শুধু খুন করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না। ভিকটিমকে নির্মম যন্ত্রণা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারার পর বিভিন্ন অঙ্গহানি করছেন। ধর্ষণের পর খুনের ঘটনাগুলো আরও বীভৎস। কখনো কখনো ধর্ষিতার মুখমণ্ডল বা গোপনাঙ্গ বিকৃত করে দেয়া হচ্ছে। মানুষ নামের এ দানবদের নির্মমতা শিশুদের ক্ষেত্রেও দেখা দিয়েছে। খুনের ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, স্বামীর হাতে স্ত্রী, স্ত্রীর হাতে স্বামী, বাবা-মায়ের হাতে সন্তান, সন্তানের হাতে বাবা-মা, প্রেমিকের হাতে প্রেমিকা, প্রেমিকার হাতে প্রেমিক, চাচার হাতে ভাতিজা, ভাইয়ের হাতে ভাই অহরহ খুন হচ্ছে।

শুধু তাই নয়, লাশ যাতে সহজেই শনাক্ত করা না যায় এজন্য খুনিরা লাশের মুখমণ্ডল অ্যাসিড ঢেলে দিয়ে কিংবা আগুন ধরিয়ে দিয়ে তা বিকৃত করে দিচ্ছে। এসব লাশ খুনির শয়নকক্ষ, বাড়ির পাশে ঝোপঝাড়, ডাস্টবিন, বাসার পানির ট্যাঙ্কি, খাল-ডোবা, নদী থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে। সহিংসতা থেকে বাদ যাচ্ছে না শিশুরাও। জার্মানভিত্তিক বাংলা গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে গত বছরের প্রথম ৯ মাসে ৩৩২ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। এর আগের বছর হত্যা করা হয়েছে ৫২১ শিশুকে। আইন ও শালিস কেন্দ্রের (আসক) হিসাব বলছে শিশু হত্যা ক্রমাগত বাড়ছে। আসকের এক হিসাব অনুযায়ী ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৩১২টি। এক বছর আগেও এই ধরণের সহিংসতার সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১১টি। বিভিন্ন বেসরকারি জরিপে দেখা যায়, ৫ থেকে ১২ বছরের শিশুরাই সবচেয়ে বেশি হত্যা ও সহিংসতার শিকার। হত্যা ছাড়াও শিশুরা ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন, যৌন হয়রানি, এসিড সন্ত্রাস ও অপহরণের শিকার হয়। এছাড়া শিশু গৃহকর্মীরাও ব্যাপক হারে বিকৃত নির্যাতনের শিকার হয়।

মানুষের এহেন সহিংসতার পেছনে বিষন্নতাও একটা নিয়ামক বিষয় বলে মনে করছেন মনোবিজ্ঞানীরা। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটিরও বেশি মানুষ বিষন্নতায় ভুগছেন। আর বাংলাদেশে বিষণ্নতায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৪ দশমিক ৬ শতাংশ অর্থাৎ ৭৪ লাখেরও বেশি। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, বিষণ্নতা থেকেও মানুষ সহিংস হয়ে উঠতে পারে। এদিকে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা অনেকেই মনে করেন, পারিবারিক খুনাখুনি বেশিরভাগের জন্য পরকীয়াই দায়ী। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, সামগ্রিকভাবে সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ মূল্যবোধ তথা মানুষের নৈতিক অবক্ষয়। পাশাপাশি পারিবারিক বন্ধন ঢিলে হয়ে যাওয়া এবং অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টিও উল্লেখ করেছেন তারা। সম্প্রতি সারাদেশে কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের ব্যাপক হারে বিকৃত অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করছেন সমাজবিজ্ঞানীরা। তাদের ভাষ্য, সম্প্রতি নৃশংস খুন ও বিকৃত ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোররা।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, যেসব কিশোর অপরাধে জড়াচ্ছে, সেসব কিশোরের পারিবারিক বন্ধন এবং পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ নেই। বাবা-মা সন্তানের ঠিকমতো খোঁজখবর রাখেন না। কার সঙ্গে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, ঠিকমতো স্কুল-কলেজে যাচ্ছে কিনা তা-ও তারা জানেন না। ফলে তারা একের পর এক অপরাধ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে হিংস্র হয়ে উঠছে। অভিভাবকরা সচেতন না হলে রাষ্ট্র কিংবা পুলিশ কেউই এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, কৈশোর থেকে সদ্য তারুণ্যে পা দেয়ার বয়সটিতে ক্ষমতা প্রদর্শনের এক ধরনের মানসিকতা কাজ করে। এ বয়সে নীতি-নৈতিকতার শিক্ষায় তরুণদের পরিপক্ব হওয়ার কথা থাকলেও তাদের বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় ত্রুটি থাকায় তারা বিকৃতভাবে ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে। তরুণরা যে নারীর ওপর কেবল যৌন নির্যাতন করছে বিষয়টা, তা নয়। এখানে তাদের ক্ষমতা প্রদর্শনের বিষয়টি জড়িত রয়েছে। এ কারণে অনেক সময় দেখা যায়, তরুণরা গণধর্ষণের পর এর ভিডিও ধারণ করছে। এটিকে তারা তাদের ক্ষমতা দেখানোর প্রমাণ হিসেবে দেখছে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সায়মা হক বিদিশা মনে করেন, অপরাধীরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, মাদকচক্র, প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর ছত্রছায়ায় থাকার কারণে তারা বারবার অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছে। ফলে তারা ক্রমে হিংস্র হয়ে উঠছে। নারীর প্রতি একের পর এক সহিংস ঘটনার পেছনে বড় কারণ হিসেবে বিচারহীনতার সংস্কৃতি, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এবং সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে না ওঠাকে চিহ্নিত করেছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞ ফারজানা রহমান। এক সময়ে বাংলাদেশে এসিড সন্ত্রাস নির্মূলে সরকার কঠোর পদক্ষেপ নেয়ায় এবং দ্রম্নত রায় কার্যকর করায় এসিড সহিংসতার ঘটনা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা গেছে বলে মনে করেন তিনি। মনসতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, ক্ষুধার মতো যৌনাকাঙ্ক্ষা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি।

কেউ যদি সে চাহিদা যৌক্তিকভাবে মেটাতে না পারে, তখন সে অযৌক্তিকভাবে সেটা অর্জনের চেষ্টা করবে। একজন তার যৌন চাহিদা নিবৃত্ত করতে না পারলে তার ভেতরে পারভার্সন চলে আসে এবং সেটা বিকৃত উপায়ে সে অর্জনের চেষ্টা করে। আর তাই অযৌক্তিকভাবে যৌন চাহিদা মেটানোর এ বিকৃত মানসিকতা দূর করতে ছোটবেলা থেকে সঠিক জেন্ডার শিক্ষা থাকা প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, বাচ্চারা দেখে শেখে। এখন কোনো বাচ্চা যদি দেখে, তার বাবা তার মাকে মারছে, জোরপূর্বক যৌনমিলন করছে। সে কোনো অপরাধ করলে বলছে, ছেলেরা একটু দুষ্টামি করেই। তখন সে ধরেই নেয় এই ধরণের কাজ কোনো অন্যায় বা অপরাধ নয়। এভাবে সে হয়তো পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়। এ কাজগুলো তাকে এসব বিকৃত সহিংসতার কাজ করতে সহায়তা করে। আবার অপরাধীরা যদি ক্ষমতাবানদের দাপট নিয়ে বারবার পার পেতে থাকে তাও তাদের মধ্যে অপরাধ করে যাওয়ার মানসিকতা জাগ্রত করে বলে মনে করেন তারা। অপরদিকে অভিজ্ঞ পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করেন, বিকৃত অপরাধ বৃদ্ধির নেপথ্যে মাদকের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। কারণ কোনো মানুষ যখন মাদকের নেশায় পুরোপুরি আসক্ত থাকে, তখন তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। ফলে শিশু ধর্ষণ এবং পরে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা কিংবা এ ধরনের যে কোনো বীভৎস অপরাধ করতে তার কোনো দ্বিধা হয় না। আবার নেশায় আসক্ত হয়ে বড় কোনো অপরাধ করার পর অনেকের হুঁশ ফিরলে ওই অপরাধ গোপন করতে তারা আরও বিকৃত অপরাধ করে।

ইতিহাস কথা বলে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সকল সমাজব্যবস্থায় শক্তিশালী শক্তিহীনদের দমনপীড়ন-শোষণ-নির্যাতন করেছে। আমরা এখন আধুনিক-গণতান্ত্রিক সভ্যযুগের বাসিন্দা। সভ্যতার বিকাশ, বিজ্ঞানের অগ্রগতি, আধুনিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা অবশ্যই অপরাধ করার সুযোগকে ম্লান করতে সক্ষম। কিন্তু আমরা কি দেখছি? উল্টো ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করার মতো। বিকৃতমনের নির্যাতনকারীদের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বলে দেয় এটি তাদের সংঘটিত প্রথম অপরাধ নয়। জবাবদিহিতার অভাব। সময়, সুযোগ, অর্থপ্রবাহ অপরাধ করতে সাহায্য করছে বার বার। কখনও মনে হয়- এদের কি পরিবার বলে কিছু নেই? আপনি যদি সন্তানকে পরিমাণ মতো সময় দিতে সক্ষম না হন- তাহলে অবরাধ নিয়ন্ত্রণের চিন্তাও বাদ দেয়া বাঞ্ছনীয়। পুলিশের উর্ধতন কর্তৃপক্ষ যাই-ই বলুক না কেন প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, থানায় গেলেই কাজ হয়ে যাবে, সেই পরিবেশ নেই কোথাও। শুধু থানা কেন, মানুষ প্রয়োজনে যখন যার কাছেই যাক না কেন সবাই সাধ্যমতো সর্বেচ্চ ক্ষমতা প্রদর্শন করে। সাধারণের জন্য রেফারেন্স নয়ত হয়রানি ছাড়া কাজ হাসিল দুর্লভ। তবে ব্যতিক্রম যে নেই তা বলা যাবে না। কোন একজন নির্যাতিত নারী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরাধী নন, পরিস্থিতির শিকার মাত্র। আমাদের সকলের উচিত নিজের অবস্থান থেকে সমাজের যে কোনো ধরণের অপরাধ রুখতে সচেষ্ট হওয়া। অপরাধীদের শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হওয়া। মনে রাখতে হবে অপরাধীরা শাস্তি না পেলে অপরাধী নিজে ও অন্যরা অপরাধ করতে উৎসাহবোধ করবে। পরিবার আর সমাজের মানুষকেও এই সত্যটি ধারণ করতে হবে। অসুস্থ সমাজব্যবস্থার মাঝেও ইতিবাচক পথে হাঁটার চেষ্টা অব্যাহত রাখা আজ সময়ের দাবি। 'থেমে যাওয়া মানে মৃত্যু আর বেঁচে থাকা মানে এগিয়ে চলা'-এই প্রতিপাদ্যকে ধারণ করে সকলের জন্য নিরাপদ সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহযোগিতা একান্ত কাম্য। আমরা আশা করি, আমাদের সমাজ হবে সুন্দর ও সুখের।।

 

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.014189004898071