আর কে চৌধুরী কলেজ : পর্ব ১অবৈধ অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের দুর্নীতিতে ডুবছে কলেজ

দৈনিকশিক্ষা প্রতিবেদক |

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর আর কে চৌধুরী কলেজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। নানা দুর্নীতিতে জর্জরিত প্রতিষ্ঠানটি পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী পাচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক-কর্মচারীরা বলছেন, অবৈধ নিয়োগ পাওয়া অধ্যক্ষ মো. ইসতারুল হক মোল্লার অনিয়ম ও উপাধ্যক্ষ রায়হানুল ইসলামের দুর্নীতি প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ করায় তিনজন শিক্ষককে অবৈধভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। 

শিক্ষকরা ইতোমধ্যে এসবের প্রতিকার চেয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে আবেদন জানিয়েছেন। সে পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তদন্ত করেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)। সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে সংস্থাটি। অধ্যক্ষের অবৈধ নিয়োগ ও উপাধ্যাক্ষের দুর্নীতিসহ ৩২টি অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে তদন্তে। অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ক্ষমতা অপব্যবহার করে দুর্নীতি ও নিয়োগ জালিয়াতি, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা নিয়ে দুর্নীতি, অবৈধভাবে ক্যাম্পাস পরিচালনা, যাতায়াত ভাতার নামে ভুয়া বিলে টাকা উত্তোলন, শিক্ষার্থীদের টাকা আত্মসাৎসহ বিভিন্ন অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। সহকারী শিক্ষা পরিদর্শক সোহেল আহমেদ ও অডিট অফিসার মো. ফিরোজ হোসেন অভিযোগ তদন্ত করেছেন।

গত ১৯ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া ডিআইএর তদন্ত প্রতিবেদনের কপি দৈনিক আমাদের বার্তার হাতে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকদের অভিযোগ ছিলো, অধ্যক্ষ ইসতারুল হক অবৈধভাবে নিয়োগ পেয়েছেন। তিনি উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগের আবেদন করলেও অবৈধভাবে তাকে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তিনি এর আগে সাভার মডেল কলেজে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রতিষ্ঠানটিতে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পাওয়ার সময় ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দের এমপিও নীতিমালা বহাল ছিলো। সে নীতিমালা অনুসারে, অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পেতে উপাধ্যক্ষ, সহকারী অধ্যাপক বা উচ্চমাধ্যমিক কলেজের অধ্যক্ষ পদে তিন বছরের অভিজ্ঞতা থাকার কথা থাকলেও তা ছিলো না তার। 

অধ্যক্ষ পদে নিয়োগের সময় ইসতারুল হক মোল্লার পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা ছিলো না বলে প্রমাণ পেয়েছে ডিআইএ। তদন্ত প্রতিবেদনে ডিআইএ বলছে, প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা না থাকায় তার নিয়োগ বিধিসম্মত হয়নি। অধ্যক্ষ তদন্ত কর্মকর্তাদের পর্যাপ্ত তথ্য দেননি। ডিআইএ বলছে, তদন্ত কাজে অসহযোগিতা অভিযোগের সত্যতা নির্দেশ করে। 
   
শিক্ষকদের অভিযোগ বর্তমান উপাধ্যক্ষ মো. রায়হানুল ইসলাম জ্যেষ্ঠ শিক্ষক না হলেও ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অবৈধভাবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। তার সময় এক শিক্ষককের অবৈধভাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আর পরে অধ্যক্ষ ইসতারুল হক মোল্লা তাকে প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে পদোন্নতি দিয়েছেন। মোস্তফা সিরা রোজদী নামের ওই প্রদর্শক ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে যোগদান করলেও তার নিয়োগ অনুমোদন হয়েছে ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে।
 
তদন্ত প্রতিবেদনে ডিআইএ বলছে,  মোস্তফা সিরা রোজদীর নিয়োগ যথাযথ হয়নি। জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালায় প্রদর্শকদের পদোন্নতির সুযোগ না থাকলেও তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। প্রদর্শক মোস্তফা সিরা রোজদীকে সহাযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগ দিয়ে ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার করেছেন অধ্যক্ষ ইসতারুল হক মোল্লা।  

এছাড়াও তদন্ত প্রতিবেদনে প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকার অমীমাংসিত রাখা, প্রভিডেন্ট ফান্ড বাবদ শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে কাটা টাকা ফেরত না দেয়ার অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে। ডিআইএ বলেছে, প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সপ্তাহে ছয় কর্মদিবসের মধে দুই দিন কলেজে উপস্থিতির বিষয়ে লিখিত বেআইনি আদেশ দিয়েছেন অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ।এ আদেশ দেয়া উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। অনুমোদন না থাকলেও রাজধানীর জুরাইনে একটি অবৈধ ক্যাম্পাস পরিচালনা করছেন তারা। সেখানে একজন প্রদর্শক ইনচার্জের দায়িত্ব আছেন। নিবন্ধনহীন শিক্ষককে বিধি লঙ্ঘন করে ফুল টাইম শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন অধ্যক্ষ। প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকলে কোন ব্যক্তিকে শর্তাধীনে নিয়োগ দেয়ার জন্য প্যানেল তৈরি বা নিয়োগ দেয়া নিয়োগ বিধি পরিপন্থি বলছে ডিআইএ। 

ডিআইএর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিজ্ঞান বিভাগের এমপিওভুক্ত ২জন সহকারী অধ্যাপককে ক্লাস থেকে প্রায় অব্যাহতি দিয়ে তাদের জায়গায় ২ জন প্রক্সি শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে বন্ধুদের পুরস্কৃত করেছেন উপাধ্যক্ষ ও অধ্যক্ষ। যা অমার্জনীয় প্রশাসনিক অপরাধ ও আর্থিক দুর্নীতি বলে মনে করছে ডিআইএ। প্রয়োজন ছাড়া এ ধরনের পার্টটাইম শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডিতে উপাধ্যক্ষের অংশগ্রহণের বিধান না থাকলেও উপাধ্যক্ষ মো. রায়হানু ইসলাম গভর্নিং বডির সভায় অবৈধভাবে যোগদান করেন। মাহফুজা খানম ও ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বৃত্তির টাকা নয়ছয় করে দুর্নীতি করেছেন অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ। অধ্যাপক মাহফুজা খানম-ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ট্রাস্ট থেকে পাওয়া ২ লাখ টাকার মধ্যে ১ লাখ টাকা এফডিআর করার বিষয়ে ডকুমেন্ট নেই। অধ্যাপক মাহফুজা খানমের কাছ থেকে বই কেনার জন্য পাওয়া এক লাখ টাকা আয় বা ব্যয়ের কোনো বিবরণ নেই। বই কেনারও কোনো রেকর্ড দেখানো হয়নি। 

অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ওঠা শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ তহবিলের টাকা আত্মসাতের অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে ডিআইএ। ডিআইএ বলছে, সমিতির সব সদস্যের অনুমোদন না নিয়েই ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা অবৈধভাবে সমিতির তহবিল থেকে তুলে নেয়া হয়েছে। ভুয়া শিক্ষা সফরের নামে আর্থিক দুর্নীতি করেছেন অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ। এছাড়া ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের এইচএসসি পরীক্ষার্থীর বোর্ড ফেরত টাকা এখনো ফেরত দেয়া হয়নি। ফেরত না দেয়ার বিষয়ে অধ্যক্ষ ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। টেন্ডার না দিয়েই বিভিন্ন উন্নয়ন খাতে টাকা ব্যয়ে করা হয়েছে। ভুয়া আপ্যায়ন খাত তৈরি করে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের আট লাখ টাকার বেশি আত্মসাৎ করেছেন। যাতায়াত বাবদ ভুয়া বিলভাউচারের মাধ্যমে কলেজ ফান্ডের টাকাও তোলা হয়েছে।  

ডিআইএ বলছে, প্রতিষ্ঠান প্রধান টেলিফোন নীতিমালা অনুযায়ী ১ হাজার ৫০০ টাকা হারে মোবাইল ভাতা প্রাপ্য হলেও অধ্যক্ষ নিয়েছেন ১ লাখ ৩৩ হাজার টাকার বেশি। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেয়া টাকায় বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন অধ্যক্ষ। ছাপা, মনিহারী, ফটোকপি ও কম্পোজ খাতে আত্মসাৎকৃত প্রচুর অর্থ সমন্বয় করা হয়েছে। ছাপা, মনিহারী, ফটোকপি ও কম্পোজ খাতে তিন বছরে ১০ লাখ ২৯ হাজার টাকা ব্যয়ে দেখানো হয়েছে। 

এসব বিষয়ে মন্তব্য জানতে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ মো. ইসতারুল হকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সম্ভব হয়নি। ক্যান্সার আক্রান্ত অধ্যক্ষ চিকিৎসার জন্য ভারতে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। 

প্রতিষ্ঠানটির উপাধ্যক্ষ মো. রায়হানুল ইসলামও কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তিনি বলেন, ডিআইএ তদন্ত করেছে, তবে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কিনা তা আমরা অফিসিয়ালি কিছু জানি না। তাই মন্তব্য করতে পারছি না। আমাদের অধ্যক্ষ মহোদয় আগামী সপ্তাহে দেশে ফিরবেন বলে আশা করছি। তিনি ফিরে আসলে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে পারবেন।

আর কে চৌধুরী কলেজের আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য নিয়ে শিগগিরই দৈনিক আমাদের বার্তায় আসছে প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্ব। দ্বিতীয় পর্বের জন্য চোখ রাখুন দৈনিক আমাদের বার্তায়।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবি - dainik shiksha শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবি কারিগরি শিক্ষকদের অক্টোবর মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha কারিগরি শিক্ষকদের অক্টোবর মাসের এমপিওর চেক ছাড় সরকারি কর্মচারীদের ৯ দফা নির্দেশনা - dainik shiksha সরকারি কর্মচারীদের ৯ দফা নির্দেশনা স্কুল-কলেজে বেতন ছাড়া সব ফি বেঁধে দিলো সরকার - dainik shiksha স্কুল-কলেজে বেতন ছাড়া সব ফি বেঁধে দিলো সরকার সব শিক্ষকের স্বার্থ সংরক্ষণ করে বদলির নীতিমালা : সাক্ষাৎকারে শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha সব শিক্ষকের স্বার্থ সংরক্ষণ করে বদলির নীতিমালা : সাক্ষাৎকারে শিক্ষা উপদেষ্টা ঢাবিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রেখেই ভর্তি কার্যক্রম - dainik shiksha ঢাবিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রেখেই ভর্তি কার্যক্রম ক্যামব্রিয়ানের বাশারকে গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত - dainik shiksha ক্যামব্রিয়ানের বাশারকে গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: অষ্টম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি - dainik shiksha শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: অষ্টম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা কল্যাণের হবে না: ছাত্রদল সম্পাদক - dainik shiksha ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা কল্যাণের হবে না: ছাত্রদল সম্পাদক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0051159858703613