ভয়ে, অপমানে বা লজ্জায় মানুষ যখন কাঁদে সেই কান্নার দৃশ্য কখনোই ভালো লাগে না। কোনো কোনো কান্না বেদনা জাগায়, কোনো কান্নায় বিক্ষোভ তৈরি করে, কোনো কান্নায় আবার বিরক্তি আসে, কোনো কান্নায় আনে লজ্জা আবার কোনো কান্না করে অপমানিত। কান্নারত মানুষকে দেখে যে অনুভূতিই হোক না কেন কেউ আবার কাঁদিয়ে বীরত্ব দেখাতে ভালোবাসে। কিন্তু ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মাকে জড়িয়ে ধরে ছোট মেয়ের কান্নার ছবি পত্রিকায় দেখে যে অনুভূতি হলো তা তো কোনোভাবেই ভাষায় প্রকাশ করা যাচ্ছে না। শিশুর সবচেয়ে বড় আশ্রয় তার মা। সেই মা যখন নিজেই বিপন্ন, সন্তানও আক্রান্ত তখন তার মর্মযাতনা কি কেউ বুঝবে না? ছবির মা একজন বেসরকারি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষয়িত্রী, মেয়ের বয়সী ছাত্রছাত্রীদের পড়ান। মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন দীর্ঘদিনের বঞ্চনার অবসান চাইতে। এসেছিলেন স্কুল জাতীয়করণের আন্দোলনে। সমাবেশে পুলিশ মারধর করে। ভয়ে মেয়ে মাকে জড়িয়ে মারের হাত থেকে বাঁচতে চাইছে আর মা আতঙ্কে কাঁদছে। মা-মেয়ের এই পরস্পর জড়িয়ে কান্নার ছবি অনেক গোপন বেদনার ছবি প্রকাশ্য করে দিল। দেখিয়ে দিল শিক্ষা ক্ষেত্রে কত বৈষম্য, শিক্ষকদের কষ্ট আর বঞ্চনার চিত্র। প্রাথমিক শিক্ষা হলো শিক্ষার প্রধান ভিত্তি। সেই ভিত্তি নির্মাণের কারিগর যারা তারা যে কত অবহেলিত, উপেক্ষিত আর অপমানিত হয়ে থাকেন তা বুঝতে এই ছবিই যথেষ্ট। কিন্তু কেন শত শত প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক ঢাকায় এলেন তার কারণ কী এবং তাদের সমস্যা দূর করার পদক্ষেপ কি নেওয়া হবে তা জানা হলো না এখনো। শনিবার (১৮ জুন) দেশ রুপান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায় বাজেট হয়েছে অনেক বড়। যদিও সংবিধানে বাজেট বলে কোনো কথা নেই, আছে আর্থিক বিবরণী, তবুও সাধারণভাবে বাজেট কথাটাই বহুল প্রচলিত। সমাজে এবং সংবিধানে অনেক কথা প্রচলিত আছে, যার সঠিক তাৎপর্য এখন আর নেই। যেমন, সংবিধানে আছে রাষ্ট্র একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সব বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। কিন্তু ৫০ বছর পরও শিক্ষকদের যখন রাস্তায় দাঁড়াতে হয়, তখন কি এই ধারণা মনে জন্ম নেয় না যে, রাষ্ট্র নিজেই সংবিধানকে এড়িয়ে চলছে? বলা হয়ে থাকে, শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। তাহলে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকরা মানুষ গড়ার প্রাথমিক ভিত্তি তৈরি করে থাকেন। সেই শিক্ষকদের মর্যাদাহানি করে মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ তৈরি হবে কীভাবে? ১০-১৫ বছর শিক্ষকতা করে, সব শর্ত পূরণ করেও যদি চাকরি এবং নিয়মিত বেতনের দাবিতে শিক্ষকদের রাস্তায় আন্দোলন করতে হয়, পুলিশের লাঠিপেটা খেতে হয়, চাকরি স্থায়ী করে দেবে এ কথা বলে অসহায় শিক্ষকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে প্রতারণা করা হয় তাহলে শিক্ষার মান ও শিক্ষকের মর্যাদা কোথায় থাকে?
রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাই সর্বোচ্চ। শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ২৭ মে ২০১২ সালের আগে যথাযথভাবে স্থাপন ও চালুর অনুমতির জন্য আবেদনকৃত বিদ্যালয়সমূহ জাতীয়করণের আওতায় আনা হবে। তিনি আরও বলেছিলেন, আজ থেকে বাংলাদেশে আর কোনো বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকবে না। এ ঘোষণার পর আশায় বুক বেঁধেছিলেন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকরা। এবং ২৬১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ হয়ে যায়। কিন্তু সব শর্ত পূরণ করা সত্ত্বেও কীভাবে যেন ৪১৫৯টি স্কুল বাদ পড়ে যায়। শুরু হয় তাদের দুঃখ-বেদনা ও বঞ্চনার পর্ব। বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় যে পত্র পাঠিয়েছিলেন তার নিষ্পত্তি এখনো হয়নি। শিক্ষকরা দফায় দফায় আসছেন, বিভিন্ন ধরনের প্রলোভনের ফাঁদে পড়ছেন, প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তায় রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে অনশন করে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন, পুলিশের লাঠিপেটা, টিয়ার শেল খাচ্ছেন আর কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না।
সরকার বলছে, বাজেট হয়েছে অনেক বড়। এক নজরে দেখা যাক বাজেট এবং তার প্রধান খাত শিক্ষায় বাজেট এবার কেমন হলো। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেট ৬,৭৮,০৬৪ কোটি ঘোষণা করা হয়েছে। তুলনামূলকভাবে গত (২১-২২) অর্থবছরে যা ছিল ৬,০৩,৬৮১ কোটি টাকা এবং সংশোধিত বাজেট ৫,৯৩,৫০০ কোটি টাকা। এই অর্থবছরে রাজস্ব ব্যয় ৩,৭৩,২৪২ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। বাজেটে উন্নয়নব্যয় ধরা হয়েছে ২,৪৬,০৬৬ কোটি টাকা এবং অন্যান্য ব্যয় ৪৫,২০৫ কোটি টাকা। এবারের বাজেট ঘাটতি হবে ২,৪৫,০৬৪ কোটি টাকা। এই ঘাটতি পূরণ করা হবে ঋণ করে। ঋণ নেওয়া হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১,৪৬, ৩৩৫ কোটি টাকা এর মধ্যে ব্যাংক থেকে নেওয়া হবে ১,০৬,৩৩৪ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক উৎস থেকে ৯৮,৭২৯ কোটি টাকা। এই অর্থবছরে মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪৪ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে ধারণা করা হয়েছিল ৩৯ লাখ ৪৯ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। এই হলো মোট বাজেটের সংক্ষিপ্ত চিত্র। এখন দেখা যাক শিক্ষা খাতে কত বরাদ্দ করা হয়েছে। শিক্ষা খাতে এবারে বরাদ্দ ৮১,৪৪৯ কোটি টাকা, যা বাজেটের ১২.০১% এবং যা জিডিপির মাত্র ১.৮৩ শতাংশ। জিডিপি বৃদ্ধির তুলনায় শিক্ষায় বরাদ্দ কিন্তু কমে গেছে এবারের বাজেটে। গত অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৭১,৯৫৪ কোটি, যা বাজেটের ১১.৯১ শতাংশ ছিল এবং জিডিপি ১.৮০ শতাংশ ছিল। সংশোধিত বাজেটে শিক্ষা বরাদ্দ কমে গেল এবং বছর শেষে তা দাঁড়িয়েছে ৬৯,৬৪১ কোটি টাকা, যা বাজেটের ১১.৭৩ শতাংশ। অর্থাৎ বাজেটে বরাদ্দ কম এবং যা বরাদ্দ হয় তা খরচ করা হয় না। কম খরচ করা হয়েছে ২৩১৩ কোটি টাকা। এমন অবস্থা স্বাস্থ্য বাজেটেও। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ হয়েছে ৩৬,৮৬৩ কোটি টাকা, যা বাজেটের ৫.৪৩ শতাংশ এবং জিডিপির ০.৮২ শতাংশ। গত বছর বরাদ্দ হয়েছিল ৩২,৭৩১ কোটি টাকা, যা ছিল বাজেটের ৫.৪২ শতাংশ এবং জিডিপির ০.৮২ শতাংশ। কিন্তু বছর শেষে সংশোধিত বাজেটে দেখা গেল খরচ হয়েছে ৩২,২৭৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ বরাদ্দের চেয়ে খরচ কম করা হয়েছে ৪৫৭ কোটি টাকা।
বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা করোনাকালে কেমন ছিলেন তার খবর কেউ নেয়নি। বলা হচ্ছে, করোনায় শিক্ষাজীবন বিধ্বস্ত হয়েছে। ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর শিক্ষা স্থগিত হয়েছিল এবং ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী আর শিক্ষাজীবনে ফিরে আসতে পারবে না। দারিদ্র্য তাদের ঠেলে দূর করে দিয়েছে শিক্ষার আঙিনা থেকে। কিন্তু শিক্ষকদের করুণ অবস্থার কথা লেখা হয়নি কোথাও। করোনায় মাথাপিছু আয় বেড়েছে, জিডিপি বেড়েছে, বাজেটের আয়তনও বড় হয়েছে। শিক্ষকরা তাই আবার ঢাকায় এসেছিলেন যদি তাদের বেদনা রাষ্ট্র অনুভব করে তাহলে জীবিকার সঙ্গে একটু মর্যাদাও পাবেন সমাজে। বেতনবিহীন শিক্ষক এই অপবাদ হয়তো ঘুচবে তাদের।
কত টাকা লাগবে শিক্ষার প্রাথমিক ভিত্তি বাদ পড়া প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জাতীয়করণ করতে? ৪১৫৯টি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারীর জন্য বেতন ভাতা বাবদ ৬০০ কোটি টাকা আর অবকাঠামোগত কিছু সংস্কার করতে যদি আরও ৪০০ কোটি টাকা লাগে তাহলে সর্বমোট ১ হাজার কোটি টাকা হলে বেঁচে যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মর্যাদা পায় শিক্ষক আর সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয় শিক্ষার্থীদের। এই টাকা জোগাড় কি অসম্ভব? গত বাজেটে বরাদ্দ করা টাকা খরচ হয়নি শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাত মিলে ২৭৭০ কোটি টাকা কম খরচ হয়েছিল। এখান থেকে ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হলে বৈষম্যের বেদনা দূর করার পদক্ষেপ নিয়ে শিক্ষকের কান্না বন্ধ করা যেত।
আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের গর্ব করছি, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কথা শুনছি, মধ্যম আয়ের দেশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছি কিন্তু শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের উন্নতি ছাড়া মানবসম্পদ উন্নয়ন কি করা যাবে? মানবসম্পদের উন্নতি ছাড়া উন্নয়ন কি স্থায়ী হবে? বৈষম্য থাকলে মানবিক সমাজ কি প্রতিষ্ঠা হবে? এসব প্রশ্নের একটাই উত্তর, না। কারণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা ছাড়া পরিমাণগত ও গুণগত কোনো মানই তো অর্জন করা যাবে না। প্রাথমিক শিক্ষা এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্য এই দুই অধিকারের লড়াই তো আমাদের দীর্ঘদিনের। বাজেটে শিক্ষা খাতে ২৫ শতাংশ বরাদ্দ কর এই দাবিতে ছাত্ররা আন্দোলন করেছে এবং করছে। সমাজে ধনী-গরিবের বৈষম্য আর শিক্ষার বৈষম্য এক দেশে ভিন্ন ভিন্ন নাগরিক তৈরি করে সে কারণেই তো স্বাধীনতা সংগ্রাম আর স্বৈরশাসনবিরোধী সংগ্রামে দাবি ছিল শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াও, শিক্ষায় বৈষম্য কমাও। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পার করে আমরা কি এখনো শিক্ষা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের বিবর্ণ চেহারা দেখব? আমরা তো দেখতে চেয়েছি শিক্ষক গভীর মমতা ও যতেœ শিক্ষার্থীকে ভবিষ্যতের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন। যে পুলিশ সদস্য কোনো শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষার আলো পেয়েছে, তার লাঠির আঘাত থেকে বাঁচতে শিক্ষক আতঙ্কে সন্তানকে জড়িয়ে ধরবেন এই চিত্র তো আমরা দেখতে চাইনি। অভাব আর অপমান থেকে শিক্ষক মুক্তি পাক এটাই হোক বাজেটে গণমানুষের চাওয়া।
লেখক : রাজেকুজ্জামান রতন, রাজনৈতিক সংগঠক ও কলামিস্ট