অভিযুক্তই পরীক্ষা কমিটির প্রধান : শিক্ষা অধিদপ্তরে নিয়োগ

নিজস্ব প্রতিবেদক |

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) অফিস সহকারী-কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে নিয়োগ কমিটির প্রধান অধ্যাপক মো. শাহেদুল খবির চৌধুরীর বিরুদ্ধে নিয়োগ-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আগে থেকেই আছে। মাউশি অধিদপ্তরের এ পরিচালকের (কলেজ ও প্রশাসন) বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তে নেমে একপর্যায়ে পিছু হটে  শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরকে তদন্তের দায়িত্ব দিয়েও তা স্থগিত করে। তবে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) এখনো তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত চলছে।

নিয়োগ-বাণিজ্যসহ মাউশির বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ থাকার পরও আবার নিয়োগ পরীক্ষার কমিটিতে শাহেদুল খবিরের থাকার বিষয়টি নিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) যাদের গ্রেপ্তার করেছে, তাদের মধ্যে দুজন মাউশির কর্মচারী ও একজন ৩৪তম বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক। এ ছাড়া মাউশির উচ্চমান সহকারীদের একটি চক্র রয়েছে, যাদের নিয়ে শাহেদুল খবির বিভিন্ন সময় প্রশ্ন প্রণয়ন ও বিতরণ করেছেন এমন তথ্যও উঠে এসেছে পুলিশের তদন্তে। ওই সব শিক্ষা ক্যাডার সদস্য ও উচ্চমান সহকারীর কয়েকজনকে নজরদারিতে রেখেছে পুলিশ।

নাম প্রকাশ না করে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেছেন, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন থেকে বিতরণ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে গলদের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়ার পরই জড়িত সবাইকেই আইনের আওতায় আনা হবে বলে ডিবির ওই কর্মকর্তা জানান।

ডিবি তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. শাহাদত হোসেন সুমা সাংবাদিকদের বলেন, ‘পরীক্ষা কমিটির সদস্যদের আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে আমরা দ্রুতই বসব। তাদের সঙ্গে কথা বলব।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৩ মে অনুষ্ঠিত মাউশির অফিস সহকারী-কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পরীক্ষা কমিটির প্রধান ছিলন অধ্যাপক মো. শাহেদুল খবির চৌধুরী। এ ছাড়া কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন মাউশির উপপরিচালক (সাধারণ প্রশাসন) বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস। কমিটির সদস্য ছিলেন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের একজন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন ও মাউশির উচ্চশিক্ষা বিভাগের একজন।

তাদের মধ্যে শাহেদুল খবির চৌধুরীর বিরুদ্ধে গত বছর মাউশির অধীন সরকারি কলেজের দশটি বিষয়ে পাঁচ শতাধিক প্রদর্শক নিয়োগে মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেনের অভিযোগ ওঠে। ওই নিয়োগ পরীক্ষাও এখনো ঝুলে আছে। ওই সময় শাহেদুল খবির চৌধুরী নিয়ন্ত্রিত সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রতি প্রার্থীর কাছ থেকে ১০ থেকে ১২ লাখ করে টাকা তোলা হচ্ছিলএমন অভিযোগ ওঠে। এ ছাড়া তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে নিয়োগে ঘুষ-বাণিজ্য, দ্বিতীয় শ্রেণির পদকে তৃতীয় শ্রেণি দেখিয়ে শুধু এমসিকিউ পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরুসহ অসংখ্য অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।

এসব অভিযোগের ভিত্তিতে গত বছরের ২৩ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব চৌধুরী সামিয়া ইয়াসমীন স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে পরিদর্শক ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) পরিচালক অধ্যাপক অলিউল্লাহ্ মো. আজমগীরকে শাহেদুল খবিরের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। অভিযোগের বিস্তারিত ওই আদেশের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২ ডিসেম্বের ডিআইএর পরিচালক অধ্যাপক অলিউল্লাহ্ মো. আজমগীর স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে শাহেদুল খবিরের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্তে গঠন করা হয় পাঁচ সদস্যের কমিটি। এরপর ৭ ডিসেম্বর থেকে কমিটি তদন্তকাজ শুরু করে। ওই দিন শাহেদুল খবিরকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। কিন্তু এক দিন পরই ৮ ডিসেম্বর তদন্ত বন্ধের নির্দেশ দেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব চৌধুরী সামিয়া ইয়াসমীন। তার স্বাক্ষরিত এক আদেশে শাহেদুল খবিরের বিরুদ্ধে আনীত বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্তের নির্দেশটি প্রত্যাহারও করা হয়। 

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) পরিচালক অধ্যাপক অলিউল্লাহ্ মো. আজমগীর গতকাল বলেন, ‘মন্ত্রণালয় আমাদের দপ্তরকে তদন্ত করার নির্দেশে দিয়েছিল। আমরা তদন্ত করতে গিয়ে শাহেদুল খবিরকে আনুষ্ঠানিক নোটিস দিয়ে জানাই। আমরা একদিন ওনার কাছে গিয়েছিলাম। আমাদের তদন্তে প্রয়োজনীয় বিষয় আমরা তার কাছে চেয়েছিলাম। কিন্তু তার পরদিনই মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের বলা হয়, তদন্ত নিয়ে আর আগানোর দরকার নেই। ওনারা (মন্ত্রণালয়) একটা অফিশিয়াল চিঠি দিয়ে তদন্তের আদেশ প্রত্যাহার করে। ফলে আমরা আর তদন্ত করিনি। ওটা ওখানেই স্টপ হয়ে গেছে।’ তবে বিশেষ কিছু নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে অভিযোগ উঠলেও সে সব পরীক্ষার প্রক্রিয়া এখনো চলমান আছে বলে তিনি জানান।

এদিকে ডিআইএ তদন্ত না করলেও দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত অব্যাহত রেখেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের সংশ্লিষ্ট উপপরিচালক শাহীন আরা মমতাজ বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে এখনো অনুসন্ধান চলমান আছে।’

নাম প্রকাশ না করে দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, শাহেদুল খবির চৌধুরীর কাছে কিছু কাগজ চাওয়া হয়েছে। তবে তিনি এখনো দেননি।

মাউশি সূত্রে জানা গেছে, শাহেদুল খবির মাউশির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদে থাকায় তার অনিয়ম এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ভিকারুননিসার অধ্যক্ষ নিয়োগে ৩৫ লাখ টাকা ঘুষ-বাণিজ্যের অভিযোগও রয়েছে। এ ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাকে আজীবনের জন্য নিয়োগ বোর্ডে থাকা নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। কিন্তু তিনি উচ্চমহলকে ম্যানেজ করে ওই নিষেধাজ্ঞার প্রজ্ঞাপনটি বাতিল করান। নিয়মিত বদলি-বাণিজ্য, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সচিব থাকাকালে ‘জিপিএ বিক্রির’ অভিযোগও উঠেছিল তার বিরুদ্ধে।

অধ্যাপক শাহেদুল খবির চৌধুরীর বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে তার সঙ্গে গত দুদিন মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি ফোন ধরেননি।

তবে নাম প্রকাশ না করে মাউশির এক উপপরিচালক  বলেন, ‘পদাধিকার বলেই শাহেদুল খবির চৌধুরী নিয়োগ কমিটির প্রধান হন।’

প্রশ্নপত্র বিতরণ প্রক্রিয়ায় ছিল গলদ : মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) অফিস সহকারী-কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় গত বৃহস্পতিবার পরীক্ষাটি বাতিল করে মাউশি। ওই পরীক্ষা কমিটির এক সদস্যের নেতৃত্বে সব কটি কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র বিতরণ করা হয়। পরীক্ষা বিকেল ৩টায় শুরু হলেও বেলা ১১টায় প্রশ্নপত্র কেন্দ্রে কেন্দ্রে পাঠানোর বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিতরণ প্রক্রিয়ায় গলদ ছিল বলে তথ্য পেয়েছে ডিবি।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0023701190948486