এককথায় উচ্চশিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের লক্ষ্যে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি ও বিতরণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসন দরকার। কেননা নিজেদের প্রয়োজন ও চাহিদামাফিক শিক্ষক নিয়োগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ অন্যান্য শিক্ষা আনুষঙ্গিক বিষয় নিজেদের মতো পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করতে না পারলে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এখানেই স্বায়ত্তশাসনের মহত্ত্ব লুকায়িত। আর যদি এ কাজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ করতে না পারে, তাহলে স্বায়ত্তশাসনের মূল্য কোথায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের মূলে থাকেন উপাচার্য, যাঁকে অনেক স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। তিনি নির্দিষ্ট নিয়ম-নীতির মধ্য দিয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিকল্পনামাফিক সুন্দরভাবে পরিচালনা করবেন বলে ধারণা করা হয়। বুধবার(১০ মার্চ) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে এবং যেহেতু প্রতিষ্ঠান সরকারি, সেহেতু আর্থিক জবাবদিহি থাকতে হয় এবং এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অন্যান্য কাজ শিক্ষকদের মতামত ও প্রয়োজনের স্বার্থে এবং সঠিকভাবে করা চাই। এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় কর্ণধারের দেওয়া কাম্য নয়। তবেই স্বায়ত্তশাসন পরিপূর্ণ হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মানের দিক দিয়ে এগিয়ে যাবে। কিন্তু যিনি কর্ণধার তাঁর বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ ওঠে, তাহলে আমাদের করার কী-ই বা আছে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজ নিজ আইনে পরিচালিত, তবে আমার জানা মতে, উপাচার্য এবং ক্ষেত্রবিশেষে উপ-উপাচার্য আইন ও সংবিধির বলে বিভিন্ন বডি ও কমিটিতে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এখানেই প্রশ্ন সততা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির। কমিটি ও বডিতে অন্য অনেক ক্যাটাগরির শিক্ষকসহ বাইরের অনেক প্রতিনিধি থাকেন, যাঁদের সবাইকে নিয়ে কাজটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়। কিন্তু কর্ণধার যদি নিয়ম-নীতির মধ্যে থাকেন, তখন অন্যদের ভিন্ন ইচ্ছা থাকলেও প্রকাশ করা সহজ হয় না। দীর্ঘদিনের আমার শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। উপাচার্য শক্ত হলে এখানে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ থাকে না বললেই চলে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে গুণগত শিক্ষার মান নির্ভর করে মোটাদাগে দুটি বিষয়ের ওপর। এক. মেধাবী ও অভিজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগ। দুই. শিক্ষাসংশ্লিষ্ট অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও আনুষঙ্গিক শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুটি কাজই সরকার করে। প্রতিষ্ঠানের করার সুযোগ নেই বললেই চলে। বিসিএস ও অন্যান্য নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন শিক্ষা প্রকৌশল বিভাগের দায়িত্ব। এখানে প্রতিষ্ঠানপ্রধানের ছাড়পত্রের প্রয়োজন পড়ে; কিন্তু নিজস্ব প্রকল্প প্রণয়নের সুযোগ থাকে না, হয়তো প্রয়োজনও পড়ে না। এখানে যাবতীয় কাজে প্রভাব বিস্তার করা যতটা সহজ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ততটা সহজ নয়। আমাদের পত্রিকাগুলো সংবাদ প্রকাশ করে কাজ না করে বিল পরিশোধ, প্রকৌশলীকে মারধর কিংবা প্রতিষ্ঠানপ্রধানকে হুমকি দিয়ে বিলে স্বাক্ষর আদায় ইত্যাদি। কিন্তু আমার বিশ্বাস, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে এমন কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না। কোনো ঠিকাদার সাহস করবে না বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো প্রকৌশলীকে মারধর করতে কিংবা জোর করে স্বাক্ষর আদায় করতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ণধার যদি সৎ ও সাহসী হন, এখানে কারো ক্ষমতা নেই দুর্নীতি ও অনিয়মের মধ্যে চলা।
অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও শিক্ষা আনুষঙ্গিক উপকরণ সরবরাহের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি দপ্তর রয়েছে। পরিকল্পনা ও উন্নয়ন এবং প্রকৌশল দপ্তর। এদের কাজ ডিপিপি তৈরি করা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত যাবতীয় কাজের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন, নকশা তৈরি ও কাজের দেখভাল করা। এ কাজে যুক্তদের খুব দক্ষ হতে হয়। প্রকল্পের ব্যয় সময়ের তারতম্যে বাড়তে পারে; কিন্তু পরিকল্পনার মধ্যে কোনো পরিবর্তন আনার সুযোগ নেই। হলে একনেক কর্তৃক পাস করা প্রকল্পের ব্যত্যয় হবে। যেমন—বেতনভুক পরামর্শকের বিধান যদি থাকে, তাহলে কথা নেই; কিন্তু না থাকলে নতুন করে পরামর্শক নিয়োগের সুযোগ নেই। আমরা উন্নয়নশীল দেশের কাতারে ২০১৮ সালে শামিল হই এবং আশা করি ২০২৬ সালে এর চূড়ান্ত রূপ পাব। বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য এক দশক আগেও সেখানে ৫০ কিংবা ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হতো, সেখানে বর্তমানে এক হাজার এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুই হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। আমাদের সামর্থ্য আছে বিধায় তা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু সেই অর্থকে সঠিকভাবে ব্যবহার করার সক্ষমতা যদি আমাদের না থাকে কিংবা ব্যবহার করতে না পারি, তাহলে উন্নয়ন হবে কিভাবে। কর্তৃপক্ষ যদি কঠোর হয়, তাহলে কোনোভাবেই অর্থের ব্যবহার নিয়ে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
স্বচ্ছ পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমে মেধার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আরো বেশি জরুরি। এর ব্যত্যয় ঘটলে কোনোভাবেই একটি বিশ্ববিদ্যালয় সামনের দিকে এগোবে না। এমনিতেই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেশি, তারপর যেসব মেধাবী শিক্ষক হতে চান, তাঁদের সেই সুযোগ না দিলে কিভাবে ভালো শিক্ষা মিলবে। পদ্ধতি ভিন্ন হলে মেধাবীরা নিজেদের গুটিয়ে নেবেন। এমন অনেক মেধাবী আছেন, যাঁরা শিক্ষক হতে চান না। আমাদের দুর্ভাগ্য, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়মের চিত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ইউজিসি তদন্ত করে অভিযোগ প্রমাণ করে। কিন্তু শাস্তির বিষয়টি অধরাই রয়ে যায়। কেননা ইউজিসি তদন্ত করে অভিযোগ প্রমাণ এবং ক্ষেত্রবিশেষে শাস্তির সুপারিশ করতে পারে। বাকি কাজটি সরকারকেই করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকে শাস্তির আওতায় আসছেন না।
এখনকার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য প্রচুর অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তা যদি যথাযথভাবে না হয় এবং দুর্নীতির অভিযোগের তীর এর কর্ণধারের দিকে যায়, তাহলে তা আমাদের জন্য লজ্জার এবং কোনোভাবেই কাম্য নয়। অতি সম্প্রতি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ, নিকট-অতীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ ও উন্নয়ন প্রকল্পের আর্থিক দুর্নীতি বিষয়ে অভিযোগ আমরা আর পত্রিকার পাতায় দেখতে চাই না। একটি ছোট ইতিবাচক খবর দিয়ে লেখাটি শেষ করছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ১২ হাজার কোটি টাকার অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ চলছে। এখানে একটি ভবনের জন্য সংশ্লিষ্ট স্কুলের ডিনের সমন্বয়ে শিক্ষকদের নিয়ে একটি পর্যবেক্ষণ কমিটি করে দেওয়া হয়েছে এবং আমার জানামতে, তাঁরা তদারকির কাজটি করছেন। তাঁরা যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন, আমার বিশ্বাস এখানে অনিয়ম হওয়ার সুযোগ থাকবে না। আমি এটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং সব কাজের জন্য যদি এমন তদারকির ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে একটি প্রচ্ছন্ন ভয় ঠিকাদারকে তাড়িয়ে বেড়াবে।
লেখক : ড. নিয়াজ আহম্মেদ, অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়