অর্থনীতবিদ অমর্ত্য সেনের জন্মদিন আজ। তিনি ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে শান্তিনিকেতনে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়ে বাঙালিদের মন জয় করেছিলেন অমর্ত্য সেন। দারিদ্র্য এবং দুর্ভিক্ষ নিয়ে গবেষণার জন্য পৃথিবী জুড়েই তিনি শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন। অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক অমর্ত্য সেন নিজেকে ঢাকা এবং কলকাতা দুই শহরেরই সন্তান হিসেবে গণ্য করেন।
অমর্ত্য সেন নোবেল ওয়েবসাইটে তার আত্মজীবনী শুরু করেছিলেন এই বলে যে ‘আমার জন্ম একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। এবং সারা জীবনই আমি ঘুরে বেড়িয়েছি এক ক্যাম্পাস থেকে আরেক ক্যাম্পাসে।’ শিক্ষাঙ্গনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে জীবন। কর্মসূত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ক্যাম্পাসের সঙ্গে তার জীবন জড়িয়ে গেলেও, তিনি বলেছেন শিকড়ের টান তিনি সবসময়ই অনুভব করেছেন।
ওয়েবসাইটে তিনি আরো লিখেছেন ‘আমার পৈত্রিক বাড়ি হচ্ছে পুরনো ঢাকার ওয়ারি অঞ্চলে- রমনায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কাছেই। আমার বাবা আশুতোষ সেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিস্ট্রি পড়াতেন। আমার জন্ম অবশ্য শান্তিনিকেতনে- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীর ক্যাম্পাসে। আমার মাতামহ সেখানে অধ্যাপক ছিলেন।’
শান্তিনিকেতনের আচার্য অধ্যাপক ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের একজন পণ্ডিত এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহযোগী। পৌত্র অমর্ত্য সেনের প্রথম স্কুল ছিলো ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিস্। তারপর লেখাপড়া শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে।
অমর্ত্য সেন তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘শান্তিনিকেতনে প্রধানত রবীন্দ্রনাথের স্কুলেই শিক্ষার ব্যাপারে আমার দৃষ্টিভঙ্গি প্রথম একটা রূপ লাভ করে। সেখানে ছেলে মেয়ে একসঙ্গে পড়তো, শিক্ষার পরিবেশ ছিলো অনেক উদার। প্রতিযোগিতার মনোভাব তৈরি করা বা কে কাকে টপকে যাবে সে ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দেয়ার বদলে তাদের মনে কৌতূহল জাগিয়ে তোলাটাই ছিলো সেখানে শিক্ষাদানের মূল আদর্শ। পরীক্ষায় ভাল করা বা ভাল নম্বর পাওয়ার ব্যাপারে কখনই উৎসাহ দেয়া হতো না।’
বাবা আশুতোষ সেন ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে পরিবার নিয়ে পাকাপাকিভাবে চলে গিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গে। শান্তিনিকেতনে লেখাপড়া শেষ করে অমর্ত্য সেন পড়তে যান কলকাতায়। অমর্ত্য সেন লিখেছেন ‘ছেলেবয়স থেকে কলকাতা যাওয়ার তো সবারই খুব উৎসাহ থাকে। আমারও খুব উৎসাহ ছিলো’ । ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে আইএসসি পরীক্ষায় প্রথম হয়ে তিনি ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। এবং তারপর অর্থনীতি নিয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন ইংল্যাণ্ডে কেম্ব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে।
তার মেধা ও নিজস্বতায় অমর্ত্য সেন কলকাতার মন জয় করেছিলেন সেই ছাত্রাবস্থাতেই। প্রেসিডেন্সি কলেজে তার সহপাঠী ঐতিহাসিক বরুণ দে বলেছিলেন, ‘অমর্ত্য সেন একজন অন্যধরনের মানুষ ছিলেন।’
‘কলেজে যখন এলেন দেখতে লম্বা, সুন্দর চেহারা, লোককে মুগ্ধ করার মতন কথাবার্তা বলার ধরনধারণ। অমর্ত্য যেখানে সবাইকে জয় করলেন, সেটা হচ্ছে সকলের সঙ্গে মিশ খেয়ে যাওয়ার তার বিশেষ ক্ষমতা। মেয়েরা তো একেবারে কুপোকাত ছিললো তাকে দেখে।’
বিতর্কে অমর্ত্য সেনের তুখোড় দক্ষতা ছিলো। এমন কি তার প্রথম স্ত্রী নবনীতা দেবসেন বলেছেন তাদের দুজনের প্রথম আলাপও ছিল বিতর্কের সূত্রে।
‘তখন সাহিত্য চর্চ্চাতে তিনি যুক্ত ছিলেন। ডিবেট করতেন। ছাত্র বয়সে বিখ্যাত ডিবেটার ছিলেন। তারপর ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চলে যান ইংল্যাণ্ডে। আবার ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে ফিরে এসে যখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন, তখন তিনি যাদবপুর ডিবেটিং সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি ছিলেন মাস্টার। আমি ডিবেট করতাম। সেভাবেই আমাদের আলাপ।’
অমর্ত্য সেন তার শিক্ষকতা শুরু করেন কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় এবং লণ্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সে অধ্যাপনার মধ্যে দিয়ে তিনি আরোহন করেছেন শিক্ষকতার জগতে একটার পর একটা চূড়ায়। তবে ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারই তাকে বাঙালির হৃদয়ে এক বিশেষ স্থান করে দিয়েছিলো।
অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, ‘নোবেল পুরস্কার যে কারণে আমাকে দিলো সে বিষয়ে নোবেল কমিটির লিখিত বক্তব্যে ছিলো। কাজটা প্রধানত ওয়েলফেয়ার ইকনমিক্স-এর জন্য। এবং সোস্যাল চয়েস। কাজটা আমি প্রধানত করি দিল্লিতে। বিষয়টা তত্ত্বভিত্তিক হলেও নোবেল কমিটি লিখেছিলো যে এই থিয়োরি বাস্তব জগতের নানা সমস্যার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে। তার উদাহরণ দিতে গিয়ে নোবেল কমিটি দুর্ভিক্ষ বিষয়ে আলোচনা করেছে।’
জনকল্যাণ অর্থনীতি এবং গণদারিদ্র্যের অন্তর্নিহিত কার্যকারণ বিষয়ে তার গবেষণার জন্য তিনি অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘জনকল্যাণ অর্থনীতিতে একদিকে রয়েছে অর্থনৈতিক অসমতা ও দারিদ্র্যের বিষয়, আর অন্যদিকে রয়েছে যুক্তিসঙ্গত, সহনীয় ও গণতান্ত্রিক সামাজিক সিদ্ধান্তের সুযোগ ও সম্ভাবনার দিক।
বাংলায় ১৯৪৩-এর মন্বন্তর প্রত্যক্ষ করেছিলেন অমর্ত্য সেন। ওই দুর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতা থেকে তার যে গবেষণার সূত্রপাত, নোবেলজয়ী সেই কাজের পেছনে ছিলো তার দীর্ঘদিনের পরিশ্রম।
অধ্যাপক অমর্ত্য সেন কিন্তু কখনই বিশেষ একটি জায়গার পরিচয়ে আটকে থাকতে চাননি। ‘কলকাতার মানুষ যদি মনে করেন আমি কলকাতার সেটা তারা ঠিকই মনে করবেন। কিন্তু শুধু কলকাতা নয়, শান্তিনিকেতনের সঙ্গেও আমার একই রকম যোগাযোগ আছে। পাশাপাশি ঢাকার সঙ্গেও আমার যোগাযোগ খুবই ঘনিষ্ঠ।’
অমর্ত্য সেন বলেছেন তিনি কোনো একটা শহরের বা একটা দেশের পরিচয়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকতে চান না। তাই বাঙালির গর্ব হয়েও আজ তিনি বিশ্বনাগরিক।
তিনি আরা বলেন, শান্তিনিকেতনের আশেপাশে বাস করা মানুষের আয় কত ছিলো, চালের দাম কত ছিলো, এসব তথ্য শান্তিনিকেতন এবং তার আশপাশের অঞ্চলে সাইকেলে চড়ে ঘুরে ঘুরে আমাকে সংগ্রহ করতে হয়েছে।