অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় ভরসা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

মনজুর এলাহী |

জেলায় জেলায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করছে সরকার। প্রত্যন্ত এলাকায়ও আছে বেসরকারি অনেক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এরপরও আর্থসামাজিক ও ভৌগোলিক নানা প্রতিকূলতায় আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে নির্ভর করতে হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়াধীন কলেজগুলোর ওপরও। 

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থীরই পারিবারিক আয় ১০ হাজার টাকার নিচে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এ হার মাত্র ৯ শতাংশ। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে তা যৎসামান্যই। অর্থাৎ দেশে আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় এখনো বড় ভরসা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।

শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য শুরু হয়। অর্থাভাবে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ হয় না নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদের। পরিবার খরচ চালাতে না পারায় যাওয়া হয় না কোচিং কিংবা প্রাইভেট টিউশনে। এ কারণে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাটাই দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। তাই শেষ পর্যায়ে দরিদ্র পরিবারের খুব কম শিক্ষার্থীরই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ মেলে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলোর ওপর নির্ভর করতে হয় উচ্চশিক্ষা প্রত্যাশীদের।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কলেজ এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (সিইডিপি) প্রকল্পের আওতায় দেশের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজ ও সেখানকার শিক্ষার মান নিয়ে একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। ওই গবেষণায় উঠে আসা চিত্র ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরে ‘ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান ফর হায়ার এডুকেশন কলেজেস ইন বাংলাদেশ: ২০২৩-২০৩১’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থীই দরিদ্র পরিবারের। তাদের পরিবারের মাসিক আয় ১০ হাজার টাকার কম। আর ১০ থেকে ৪০ হাজার টাকা মাসিক আয়—এমন পরিবারের শিক্ষার্থী রয়েছেন ৪৯ শতাংশ। সে হিসেবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থীর পরিবারের মাসিক আয় ৪০ হাজার টাকার কম। ৬ শতাংশ শিক্ষার্থীর পরিবারের আয় ৪১ থেকে ৬০ হাজার টাকা। আর ৬০ হাজার টাকার বেশি আয় রয়েছে—জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন পরিবারের শিক্ষার্থী রয়েছেন মাত্র ২ শতাংশ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অধ্যক্ষ পরিষদ সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, ‘শিক্ষা ব্যবস্থায় ধনী-গরিব, শহর-গ্রাম, পাহাড়-সমতল—এমন নানা বৈষম্য বিরাজ করছে অনেক আগে থেকে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অসুস্থ কিছু প্রতিযোগিতা এ অসমতা আরো বহুগুণ বাড়িয়েছে। বৈষম্যের শিকার হয়ে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা যেমন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসছেন। কলেজে গিয়ে তারা আরো বৈষম্যের মুখোমুখি হচ্ছেন। কারণ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলোতে উচ্চশিক্ষার ন্যূনতম মানদণ্ডও অনুসরণ করা হয় না।’

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক আবদুস সালাম হাওলাদার দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা শেণিবিভাজনমুক্ত নয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলোতে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থী বেশি—এটাই বাস্তবতা। কারণ তারা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুযোগ পাচ্ছেন না। তবে শুধু সমস্যা নিয়ে আলোচনা না করে সমাধানের পথ খুঁজতে হয়। আমরা সেটাই করেছি।’

প্রতিবেদনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর বিষয়ভিত্তিক শিক্ষার্থীর নানা তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সরকারি কলেজে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর মধ্যে গণিত বিভাগে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হন। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে সরকারি কলেজগুলোতে স্নাতকে ভর্তি হওয়া বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীর ২৫ শতাংশই গণিত বিভাগে ভর্তি হয়েছেন। ২০ শতাংশ করে ভর্তি হয়েছেন উদ্ভিদবিদ্যা ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগে। এছাড়া পদার্থবিজ্ঞানে ১৮ শতাংশ ও রসায়নে ১৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন। মূলত চাকরিতে গণিতের ক্ষেত্র ব্যাপক হওয়ায় শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ের দিকে ঝুঁকছেন বলে প্রতিবেদনে উঠে আসে। আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বেসরকারি কলেজে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে পছন্দের বিষয় হলো প্রাণিবিদ্যা। স্নাতকে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর ২১ শতাংশই এ বিভাগে ভর্তি হয়েছেন। এছাড়া ২৯ শতাংশ গণিতে, ২৪ শতাংশ উদ্ভিদবিদ্যা, ৮ শতাংশ রসায়নে ও পদার্থবিজ্ঞানে ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন।

সরকারি কলেজগুলোর শিক্ষকস্বল্পতার চিত্রও উঠে এসেছে ওই প্রতিবেদনে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত ধরা হয় ১: ২০। অর্থাৎ প্রতি ২০ জন শিক্ষার্থীর জন্য ন্যূনতম ১ জন শিক্ষক থাকতে হবে। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের ধারে-কাছেও নেই। এসব কলেজে ৯১ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে মাত্র একজন শিক্ষক রয়েছেন। আবার বেসরকারি কলেজগুলোতে গড়ে ২৫ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক রয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ও অঙ্গীভূত কলেজ ও মাদরাসার সংখ্যা ২ হাজার ২৫৭। এসব প্রতিষ্ঠানে মোট শিক্ষার্থী রয়েছেন ২৯ লাখ ৩৪ হাজার ৭১২ জন। এর মধ্যে স্নাতক (পাস) পর্যায়ে ১৩ লাখ ৫৫ হাজার ২১ জন, স্নাতক পর্যায়ে ১৪ লাখ ৩০ হাজার ৬৭৪, স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ১ লাখ ২৯ হাজার ৬৫৪ এবং সার্টিফিকেট/ডিপ্লোমা ও অন্যান্য পর্যায়ে ১৯ হাজার ১৮৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন। আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ও অঙ্গীভুক্ত এসব কলেজ ও মাদরাসায় মোট শিক্ষক রয়েছেন ১ লাখ ১ হাজার ৩৩৬ জন

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
পেছালো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ১ম বর্ষের পরীক্ষা - dainik shiksha পেছালো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ১ম বর্ষের পরীক্ষা প্রশ্নফাঁসের মামলায় ১০ জনের কারাদণ্ড, খালাস ১১৪ - dainik shiksha প্রশ্নফাঁসের মামলায় ১০ জনের কারাদণ্ড, খালাস ১১৪ শিক্ষা ভবনের সেই বিপুলকে বদলি, গ্রেফতার চান এমপিও শিক্ষকরা - dainik shiksha শিক্ষা ভবনের সেই বিপুলকে বদলি, গ্রেফতার চান এমপিও শিক্ষকরা পলাতক ফাহিমার ক্যাশিয়ার কামালকে গ্রেফতারের দাবি - dainik shiksha পলাতক ফাহিমার ক্যাশিয়ার কামালকে গ্রেফতারের দাবি দীপু মনির ক্যাশিয়ার পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সচিব নাজমাকে বদলি - dainik shiksha দীপু মনির ক্যাশিয়ার পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সচিব নাজমাকে বদলি ঢাকা কলেজের নতুন অধ্যক্ষ অধ্যাপক ইলিয়াস - dainik shiksha ঢাকা কলেজের নতুন অধ্যক্ষ অধ্যাপক ইলিয়াস রাষ্ট্র পুনর্গঠনে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা - dainik shiksha রাষ্ট্র পুনর্গঠনে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা শিক্ষা কমিশন কেনো হলো না - dainik shiksha শিক্ষা কমিশন কেনো হলো না ১৫ এলাকায় ৬০ কিলোমিটার বেগে ঝড় হতে পারে - dainik shiksha ১৫ এলাকায় ৬০ কিলোমিটার বেগে ঝড় হতে পারে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ ও সবুজায়নের তথ্য আহ্বান - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ ও সবুজায়নের তথ্য আহ্বান please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0053868293762207