বিচারকাজের বাইরে থাকা হাইকোর্টের ১৫ বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মসহ পেশাগত অসদাচরণের অভিযোগে তদন্ত শুরু করেছে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। এর মধ্যে গত ১৭ অক্টোবর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের দাবির মুখে বিচারকাজের বাইরে রাখা ১২ বিচারপতিও আছেন। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত এই কাউন্সিলের অপর দুই সদস্য হলেন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ২০ অক্টোবর আপিল বিভাগের বিচারপতি অপসারণ নিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত রায়ের পর সংবিধানের ৯৬ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হয়। এই কাউন্সিল ইতোমধ্যে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ২২ আগস্ট বিচারিক দায়িত্ব থেকে ‘সাময়িক অব্যাহতি’ পাওয়া হাইকোর্টের তিন বিচারপতির কাছে তাদের অভিযোগের বিষয়ে পৃথকভাবে বক্তব্য গ্রহণ করেছে। এই তিনজন হলেন– বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি একেএম জহিরুল হক। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গত ৭ নভেম্বর সর্বশেষ তাদের বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য গ্রহণ করেন।
জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট কারও বক্তব্য সন্তোষজনক না হলে তার বিষয়ে অধিকতর তদন্তের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশসহ প্রস্তাব পাঠানো হবে। রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পাওয়ার পর তদন্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে এবং রাষ্ট্রপতির কাছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাঠাবে কাউন্সিল। এ ছাড়া গত মাসে যে ১২ বিচারপতিকে বিচারিক দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখা হয়েছে, সেই বিচারপতিদের বিরুদ্ধেও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ লিপিবদ্ধ করার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। শিগগির তাদের অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য (আত্মপক্ষ সমর্থন) গ্রহণ করা হবে।
১২ বিচারপতি হলেন– বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খান, বিচারপতি নাঈমা হায়দার, বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ, বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার, বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাস, বিচারপতি খিজির হায়াত, বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামান, বিচারপতি খোন্দকার দিলিরুজ্জামান, বিচারপতি শাহেদ নূর উদ্দিন, বিচারপতি মো. আখতারুজ্জামান, বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলাম ও বিচারপতি এসএম মাসুদ হোসোইন দোলন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমেদ ভূঞা বলেন, ‘সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল-সংক্রান্ত রায়ের পর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে। এই কাউন্সিল কয়েকজন বিচারপতি সংক্রান্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করছে। তবে তাদের বিষয়ে এখনও রাষ্ট্রপতির কাছে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থেকে কোনো অভিযোগ পাঠানো হয়নি।’
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কার্যক্রম প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল অভিযুক্ত বিচারপতির কাছে অভিযোগের বিষয়ে জবাব চাইবেন। পরে প্রয়োজনে তাদের সাক্ষাৎকারও গ্রহণ করবেন। এর আলোকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল যদি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগের বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে মতামত পাঠাবেন। এরপর রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত কার্যকর করবেন।
এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘অভিযোগ প্রমাণিত হলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সংশ্লিষ্ট বিচারপতিকে অপসারণ বা ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সুপারিশ অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।’
যে সব অভিযোগ
দুর্নীতি ও গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ ওঠার পর ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ২২ আগস্ট হাইকোর্টের তিন বিচারপতিকে বিচারকাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। তৎকালীন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পরামর্শক্রমে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এই সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্ত অবহিত করার পর ওই তিন বিচারপতি প্রধান বিচারপতির কাছে ছুটি চেয়ে আবেদন করেন। ছুটি শেষ হলেও গত ৫ বছর ধরে তারা বিচারকাজের বাইরে রয়েছেন। জানা গেছে, বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি একেএম জহুরুল হক সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের বিরুদ্ধে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ মে নিয়মবহির্ভূতভাবে অধস্তন আদালতের মামলায় হস্তক্ষেপ করে ডিক্রি পালটে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বিচারপতি কাজী রেজা-উল হকের বিরুদ্ধেও রায় পাল্টে দেওয়াসহ বেশ কিছু অভিযোগ করা হয়েছে।
এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের দাবির মুখে গত মাসে ১২ বিচারপতিকে বিচারকাজের দায়িত্ব থেকে বিরত রাখা হয়। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়ম, দলপ্রীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে। তবে অভিযোগগুলো এখনও সুনির্দিষ্টভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি।
উচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণ-সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলা আপিল বিভাগে বিচারাধীন থাকায় এই ১৫ বিচারপতির বিরুদ্ধে তদন্ত কার্যক্রম বন্ধ ছিল। গত ২০ অক্টোবর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল-সংক্রান্ত রায় আপিল বিভাগে বহাল রাখা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৫ বিচারপতির বিরুদ্ধে তদন্ত সম্পন্ন করতে প্রধান বিচারপতি সংবিধান অনুযায়ী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করেন।