বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ভারতে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জনরোষে গণভবন লুটপাট হয়। সংসদ ভবন আক্রান্ত হয়। গুটিকয়েক বাদে আক্রান্ত হয় দেশের সব থানা। আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয় অনেকগুলো থানা। আক্রমণে ৪০ এর অধিক পুলিশ সদস্য নিহত হন। নিহত হন হাজারেরও অধিক আন্দোলনকারী।
দেশের ইতিহাসে নজীরবিহীন এ আন্দোলনের পর জনরোষ থেকে বাঁচতে আত্মাগোপনে যান আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগীরা। হেভিওয়েট নেতা থেকে মাঝারি নেতা পাতি নেতা এমনকি আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মীরা আত্মগোপনে চলে যান। আত্মগোপনে চলে যান আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট, মাঝারি ও পাতি আইনজীবী নেতিারা।
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ১৪ আগস্ট প্রথমবারের মতো ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আনা হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে।
সেদিন শতশত বিএনপি জামায়াত আইনজীবী আদালতে উপস্থিত থাকলেও আদালতে আসামির পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না। এমনকি পরবর্তী ১০ দিন অনেক আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও পুলিশ কর্মকর্তা আসামি হয়ে আদালতে এলেও তাদের পক্ষে বলতে গেলে কোনো হাইপ্রোফাইল আইনজীবীকে দেখা যায়নি। জুনিয়র কিংবা অত্যন্ত সাধারণ মানের দু-একজন আইনজীবী কারো কারো পক্ষে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও বিএনপি জামায়াত আইনজীবীদের তোপের মুখে তারা আদালত থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হন।
সরকার পতনের পরপরই আত্মগোপনে চলে যান দেশের প্রধান আইন কর্মকর্তা সুপ্রিমকোর্ট বারের সাবেক সভাপতি এএম আমিন উদ্দিন। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু। ঢাকা আইনজীবী সমিতিতে আওয়ামী লীগের অভিভাবক খ্যাত সৈয়দ রেজাউর রহমান, কাজী নজীবউল্যাহ হিরু, কামরুল ইসলাম, আবু সাঈদ সাগর, মিজানুর রহমান মামুনসহ সকল আইনজীবী নেতা গা ঢাকা দেন।
আওয়ামী লীগের মাঝারি মানের নেতাদের কাউকে কাউকে হঠাৎ হঠাৎ আদালত অঙ্গনে দেখা গেলেও জনরোষের ভয়ে তাদেরকে আদালতে আওয়ামী লীগ নেতাদের মামলার শুনানিতে দেখা যায় না।
হাসিনা সরকারের পতনের পর বৈষম্যবিরোধী গণআন্দোলনে নিহতদের পক্ষে একে একে হত্যা মামলা দায়ের হতে থাকে। সারা দেশে শুধু শেখ হাসিনার নামেই দু,শতাধিক হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। তার সাথে আওয়ামী লীগের শেষ মেয়াদের মন্ত্রী-এমপি, তারও আগের মন্ত্রী-এমপি, জোট নেতৃবৃন্দ, আওয়ামী বুদ্ধিজীবী ও পুলিশ কর্মকর্তারা রয়েছেন।
হত্যা মামলায় আইনজীবী পাওয়া আসামিদের অধিকার। আইনজীবী ছাড়া মামলা করা হলে তা হবে আইন পরিপন্থি ও ক্রটিযুক্ত। কিন্তু জনরোষের ভয়ে আওয়ামী আইনজীবী নেতারা পলাতক থাকায় হত্যা মামলা পরিচালনায় ত্রুটি দেখা দেয়। এমন প্রেক্ষিতে গত ২৯ আগস্ট সুপ্রিমকোর্ট হত্যা মামলায় যে সব আসামির পক্ষে আইনজীবী পাওয়া যাবে না তাদেরকে লিগ্যাল এইডের সহযোগিতার নির্দেশ দেয়া হয়।
সুপ্রিম কোর্টের ঘোষণার পর গর্তে থাকা আওয়ামী আইনজীবী নেতারা বের হয়ে না আসলেও সাহস করে কয়েক সাধারণ আইনজীবী সব আসামির পক্ষে ওকালতনামা দিয়ে স্বল্প পরিসরে শুনানি করতে থাকেন। এমন একজন আইনজীবী হচ্ছেন মোরশেদ হোসেন শাহীন।
তিনি আমাদের বার্তাকে জানান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক নিজেও একজন আইনজীবী। অথচ তিনি আইনি সহায়তা পাচ্ছেন না বিষয়টা তাকে প্রথম ভাবিয়ে তোলো। তিনি তাদের পক্ষে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে ওকালতনামা দিয়ে শুনানি করতে গেলে প্রথম প্রথম তোপের মুখে পড়েন। তাকে এজলাস থেকে বের করে দেয়ার মতোও ঘটনা ঘটে।
আওয়ামী ঘরানার এ আইনজীবী আরো জানান, ছাত্রজীবন থেকেই তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আইন পেশায় আসার পর তেমন সক্রিয় রাজনীতি না করলেও বিবেকের তাড়নায় রাজনৈতিক মামলার সঙ্গে জড়িয়ে যান।
মামলার খরচ চলে কীভাবে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথম প্রথম নিজের টাকা খরচ করে মামলা চালিয়েছেন। তবে এখন আসামিপক্ষে কোন কোন আত্মীয় স্বজন দেখা করে কিছু খরচ দিয়ে যান।
আওয়ামী লীগের ঊর্ধ্বতন কোনো নেতা বা আইনজীবী নেতার পরামর্শে তিনি এ সেবা দিচ্ছেন না বলেও জানান আইনজীবী শাহীন।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির আওয়ামী আইনজীবীদের অভিভাবক খ্যাত সৈয়দ রেজাউর রহমান, কাজী নজীব উল্যাহ হিরু, আব্দুল্লাহ আবু কিংবা মিজানুর রহমান মামুনের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তাদের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর ও ক্রিমিনাল আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট এহসানুল হক সমাজী আমাদের বার্তাকে বলেন, সংবিধানের ২৭ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। এ ছাড়াও ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৪০ (১) ধারার বিধান মতে, ‘ফৌজদারী আদালতে কোনো অপরাধে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তির অথবা এরূপ কোনো আদালতে এই আইন অনুসারেযাব বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হয়েছে কৌঁসুলি দিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার তার থাকবে।’সুতরাং আইনানুসারে সব আসামির অধিকার রয়েছে আইনজীবী নিয়োগের। কেউ উক্ত প্রক্রিয়ায় বাধা দিলে সেক্ষেত্রে আইনের ব্যত্যয় ঘটবে।