ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় জামিন একটি বহুল প্রচলিত পরিভাষা। সাধারণত গ্রেফতার বা আটকের পর আদালতের নির্দেশে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়।
কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছায় আদালতে হাজির হয়েও জামিনের আবেদন করতে পারেন। নির্দিষ্ট সময়ে আদালতে হাজির থাকার শর্তে জামিনদারের জিম্মায় এ ধরনের মুক্তি দেওয়া হয়।
জামিন কী
অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আইনগত হেফাজত থেকে মুক্তি হলো জামিন। পুলিশ বা আদালতের হেফাজত থেকে নির্দিষ্ট সময়ে আদালতে হাজির থাকার শর্তে জামিনদারের জিম্মায় নির্দিষ্ট পরিমাণ জামানত প্রদানের প্রতিশ্রুতি সাপেক্ষে জামিনে মুক্তি প্রদান করা হয়।
চূড়ান্ত বিচারের পূর্বে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অনেক ক্ষেত্রে আইনগত হেফাজতে নেওয়া হয়। তদন্তের স্বার্থে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য, কখনো তদন্ত প্রভাবিত যাতে করতে না পারে সেজন্য আইনগত হেফাজতে নেওয়া হয়।
জামিনযোগ্য অপরাধে জামিন
ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৬(৪) (খ) ধারায় জামিনযোগ্য অপরাধের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- এমন একটি অপরাধ যা (ফৌজদারি কার্যবিধির) দ্বিতীয় তফসিলে জামিনযোগ্য হিসেবে দেখানো হয়েছে অথবা যা বর্তমানে বলবৎ কোনো আইন দ্বারা জামিনযোগ্য করা হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী জামিনযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির জামিন পাওয়া আইনগত অধিকার। এ ধরনের অপরাধে গ্রেফতার ব্যক্তি জামিন চাইলে এবং জামিনদার দিতে প্রস্তুত থাকলে তাকে জামিন দেওয়াটা আদালতের জন্য বাধ্যকর।
জামিন অযোগ্য অপরাধে জামিন
জামিন অযোগ্য অপরাধে জামিন দেওয়া আদালতের বিবেচনামূলক ক্ষমতা। ৪৯৭ ধারা অনযায়ী মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে অপরাধে অপরাধী হওয়ার মতো বিশ্বাসযোগ্য কারণ ব্যতীত আদালত এই বিবেচনা প্রয়োগ করতে পারেন। তবে সবধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে তিনটি কারণে জামিন অযোগ্য অপরাধে জামিন দেওয়ার বিষয় বিবেচনার ক্ষমতা আদালতকে দেওয়া হয়েছে। কারণগুলো হলো- ১৬ বছরের কম বয়স্ক, স্ত্রীলোক ও পীড়িত বা অক্ষম ব্যক্তি।
তদন্তে বিলম্বের কারণে জামিন
জামিন অযোগ্য মামলায় তদন্তে ১২০ দিনের বেশি বিলম্ব হলে আদালত জামিন দিতে পারেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ (৫) ধারার বিধান মতে, অপরাধ সংঘটনের ব্যাপারে সংবাদ পাওয়ার তারিখ হতে অর্থাৎ মামলা দায়ের থেকে অথবা তদন্তের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ পাওয়ার ১২০ দিনের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন না হলে অপরাধটি মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা দশ বছরের বেশি মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হলে দায়রা আদালত এবং অনান্য ক্ষেত্রে অপরাধ আমলে নেওয়ার এখতিয়ার সম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেট স্বীয় সন্তুষ্টি মোতাবেক শর্তে জামিনে মুক্তি দিতে পারেন।
বিচারে বিলম্বের কারণে জামিন
ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৩৯ গ ধারা অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষেত্রে বিচারকার্য সমাপ্ত করার সময় ১৮০ দিন এবং দায়রা আদালত কর্তৃক বিচারকাজ নিষ্পত্তির সময় ৩৬০ দিন। এই সময়ের মধ্যে বিচারকাজ নিষ্পত্তি না করা গেলে এই ধারা অনুযায়ী বিচারিক আদালত জামিন অযোগ্য মামলায় জামিন দিতে পারেন।
হাইকোর্ট ও দায়রা আদালত কর্তৃক জামিন অযোগ্য মামলায় জামিন
জামিন অযোগ্য যেকোনো অভিযোগে হাইকোর্ট বিভাগ ও দায়রা আদালত জামিন দিতে পারেন। এ বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৮ ধারায় বলা হয়েছে, ‘দণ্ডের পর আপিল থাকুক আর না থাকুক হাইকোর্ট বিভাগ বা দায়রা আদালত যেকোনো ক্ষেত্রে যেকোনো ব্যক্তিকে জামিন মঞ্জুর করিবার আদেশ দিতে পারেন। ’ নিম্ন আদালতের জামিন নামঞ্জুরের আদেশের বিরুদ্ধে এই ধারায় ফৌজদারি বিবিধ (সিআর মিস) মামলা দায়ের করে জামিন চাওয়া হয়।
আগাম জামিন কখন নেওয়া যায়
আগাম জামিনের জন্য আইনে আলাদা কোনো বিধান নেই। হাইকোর্ট বিভাগে আগাম জামিনের দরখাস্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৮ ধারাতেই করা হয়। মূলত, পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার বা বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের পূর্বেই হাইকোর্ট বিভাগ সীমিত একটি সময়ের জন্য আগাম জামিন মঞ্জুর করে থাকেন।
আগাম জামিনের ক্ষেত্রে, আপাত দৃষ্টিতে জামিন পাওয়ার মতো যুক্তি সঙ্গত ভিত্তি থাকতে হবে বা জামিন দেওয়া না হলে তিনি অন্যায়ের শিকার হতে পারেন মর্মে আশঙ্কা থাকতে হবে। আগাম জামিন আদালতের বিবেচনায় বিশেষ ও ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে মঞ্জুর করা হয়। তদন্ত বা বিচার চলাকালে যেকোনো পর্যায়ে আগাম জামিন নেওয়া যায়। তবে আগাম জামিনের পর উচ্চ আদালতের নির্দেশ মোতাবেক নিম্ন আদালতে জামিননামা দাখিল করে নিয়মিত জামিন নিতে হয়।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট