আগামীর পথ দেখাবে সন্ত্রাসমুক্ত কুসিক নির্বাচন

দেলোয়ার জাহিদ |

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে ১৫ জুন অনুষ্ঠিত হলো কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের) নির্বাচন।  বেসরকারি ফলাফলে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত। আরফানুল হক রিফাত নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন ৫০ হাজার ৩১০ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সদ্যবিদায়ী মেয়র মনিরুল হক সাক্কু টেবিল ঘড়ি প্রতীকে পেয়েছেন ৪৯ হাজার ৯৬৭ ভোট। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত অপর প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সার ঘোড়া প্রতীকে পেয়েছেন ২৯ হাজার ৯৯ ভোট। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেছেন, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনসহ পাঁচটি পৌরসভা ও ১৭৬টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হয়েছে।

কুসিক নির্বাচনকে ঘিরে একটি নিরপেক্ষ ও দ্বন্দ্বমুক্ত প্রশাসন নিশ্চিতে একজন সংসদ সদস্যের এখতিয়ার, দায়িত্ব ও আচরণ নিয়ে অনভিপ্রেত এক বিতর্কে জড়িয়েছে নির্বাচন কমিশন। যার ফলে প্রার্থীদের হার-জিতের ফলাফলের চেয়েও দেশজুড়ে আলোচনা ও অগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল নতুন নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা ও আস্থা অর্জনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার বিষয়টা। কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনের এটাই স্থানীয় সরকার সংস্থার প্রথম বড় নির্বাচন। 

কুমিল্লা সিটির রাজনৈতিক মেরুকরণ ভোটের মাঠে তিন প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস ও ভোটপূর্ব আলোচনা ছিল নগরজুড়ে। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশকে উপেক্ষা করে সিটি করপোরেশন এলাকা ছেড়ে যাননি কুমিল্লা সদর আসনের সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন বাহার। তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, কোনো সংসদ সদস্যকে তার নিজ নির্বাচনী এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলা তার মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপের সামিল। 

ওদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচনী নিয়ম-নীতি অনুসরণ করে একজন সংসদ সদস্যকে (এমপি) নির্বাচনী এলাকা থেকে বের করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। এ থেকে বোঝা যায় নির্বাচন কমিশন কতটা ব্যর্থ, কতটা অসহায়।  

একটি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশে বহুপ্রতীক্ষিত গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে সর্বাগ্রে যে আস্থা তৈরির পরিবেশ গঠন সরকারের অগ্রাধিকার ছিল, তা শুরুতেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল। নির্বাচনী পরামর্শদাতা সু নেলসন বলেন, ‘নির্বাচনী আইন ও প্রবিধানের প্রয়োগ অবাধ, সুষ্ঠু ও নির্ভরযোগ্য নির্বাচনের একটি অপরিহার্য উপাদান, সেগুলো যেখানেই অনুষ্ঠিত হোক না কেন। প্রয়োগ নিশ্চিত করে না যে নির্বাচন, তার জন্য যদি আইনি এবং নিয়ন্ত্রক কাঠামো প্রয়োগ করা হয়, তবে ভোটারদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বৈধতা নিশ্চিত করে। এটি জবাবদিহিকে উৎসাহিত করে, প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে, স্বচ্ছতা বাড়ায় এবং নির্বাচনী ফলাফলে আস্থা তৈরি করে। নির্বাচনী আইন প্রয়োগের জন্য ভোটার, প্রার্থী এবং অন্যদের প্রক্রিয়ার সন্দেহজনক অংশগুলোকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য এবং তাদের অভিযোগগুলো তদন্ত ও সমাধান করার জন্য একটি ব্যবস্থার প্রয়োজন। অনেক নির্বাচনী বিরোধ জালিয়াতি বা নির্বাচনী আইন লঙ্ঘনের অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে হয়। প্রতিটি সিস্টেম নির্বাচনী বিরোধগুলো পরিচালনা করা এবং তার সমাধানের সময় পাওয়া যে কোনো অবৈধ পদক্ষেপ প্রক্রিয়াকরণের নিজস্ব উপায় তৈরি করেছে। বিভিন্ন প্রয়োগকারী ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনকালে প্রয়োগকারী শাসন ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে মিলগুলো লক্ষণীয়। তাদের একই মৌলিক উদ্দেশ্য রয়েছে এবং বৃহৎ পরিমাপে একই মৌলিক কাজগুলো অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করে। তারা প্রায় উচ্চ চার্জযুক্ত এবং রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যে নিরপেক্ষ, সময়োপযোগী এবং কার্যকর প্রয়োগ প্রদানে একই সমস্যার সম্মুখীন হয়। পার্থক্যগুলো প্রতিটি দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও ইতিহাসকে প্রতিফলিত করে এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তারা সবচেয়ে প্রত্যক্ষ হুমকি হিসাবে তা বিবেচনা করে। ঐতিহাসিক এবং সম্ভাব্য হুমকির ওপর এই ফোকাস প্রতিষ্ঠানের পছন্দ। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া ক্ষমতার পরিমাণ এবং নিষেধাজ্ঞার তীব্রতা প্রতিফলিত হয় এতে। 

এনফোর্সমেন্ট সিস্টেম প্রতিটি এখতিয়ারের আইনি এবং নিয়ন্ত্রক কাঠামোর অংশ গঠন করে। যাই হোক, যদি না একটি এনফোর্সমেন্ট সিস্টেমকে সম্মান করা হয় এবং যথাযথভাবে ব্যবহার করা হয়, তবে এর মূল্য প্রশ্নবিদ্ধ। আইন লঙ্ঘনকারীদের জন্য ব্যাপক দায়মুক্তি বা পক্ষপাতমূলক উদ্দেশ্যে প্রয়োগকারীর ব্যবহার জনগণের আস্থা নষ্ট করে এবং নির্বাচনের ফলাফলের বৈধতাকে মেঘে পরিণত করতে পারে।’

সংবাদসূত্রে প্রকাশ, গত কুমিল্লা শহরের নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় মিলনায়তনের বাইরে গণমাধ্যমকর্মীদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে ইসি রাশিদা সুলতানা বলেন, 'আইনের কিছু ফাঁকফোঁকর ব্যবহার করে সংসদ সদস্য বাহার কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এলাকায় অবস্থান করছেন। আমাদেরও সময় আসবে। ওয়েট অ্যান্ড সি।' 

এ সময় কমিশনার আহসান হাবিব সরকারদলীয় ওই এমপির উদ্দেশে বলেন, 'আইনপ্রণেতা হয়ে আপনি নিজেই ব্যর্থ হলেন। এরপর কুমিল্লা সিটি নির্বাচনকে উদাহরণ হিসেবে নেবে বাংলাদেশের মানুষ। যেখানে ভোটের পরিবেশ ভালো থাকবে না, সেই কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হবে।'

বেসরকারিভাবে ফলাফল ঘোষণার পর হেরে গিয়ে আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন টানা দুইবারের মেয়র মনিরুল হক সাক্কু। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আরফানুল হক রিফাতের কাছে ৩৪৩ ভোটে হেরে সাংবাদিকদের কাছে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় সাক্কু বলেন, আমার বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। দুই ঘণ্টা ফলাফল আটকে রাখা হলো। এটা গায়ের জোরে আটকে রাখা হলো। এখন আমি আইনি প্রক্রিয়ায় যাব। তিনি আরও বলেন, আমার কাছে ফলাফলের কাগজ আছে। এটা অন্যায়। এর মাধ্যমে প্রমাণ হলো নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষতা দেখাতে পারেনি। 

নির্বাচন কমিশনের দেয়া চিঠির ভাষা এখতিয়ারবহির্ভূত বলে জানিয়েছেন কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহার। বুধবার কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুল কেন্দ্রে ভোট দেয়া শেষে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। বাহার বলেন, নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনের আইন মানতে হবে। আমি খুব দুঃখ পেয়েছি। একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, আমি আইন প্রণেতা হয়ে আইন ভঙ্গ করেছি। আমাকে কোথাও দেখেছেন নির্বাচনে? ইসি যে চিঠি দিয়েছে তা এখতিয়ার বহির্ভূত এবং ভাষাগতভাবেও ঠিক হয়নি উল্লেখ করে কুমিল্লার এই এমপি বলেন, একজন জাতীয় সংসদ সদস্যকে এইভাবে ‘নির্দেশ’ শব্দ ব্যবহার করতে পারে না। চিঠিটা অসমাপ্ত ছিল। আইনের পুরো ব্যাখ্যা ছিল না। আইনটি নিয়ে সংসদে কথা বলবেন বলে জানান তিনি এবং তা সংশোধন করার আশা প্রকাশ করেন।বিষয়টি নিয়ে হাইকোর্টে একটি রিট চলছে, এর চূড়ান্ত ফলাফলই নির্ধারণ করবে নির্বাচন কমিশনের দেয়া চিঠিটি বেআইনি ও কর্তৃত্ববহির্ভুত কিনা?

বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠান একটি চ্যালেঞ্জস্বরূপ। এ চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে বর্তমান নির্বাচন কমিশন কুমিল্লায় যে নির্বাচনটি সম্পন্ন করেছে, তার জন্য তাদের সর্বোচ্চ নম্বর দেয়া না গেলেও সম্পূর্ণ ব্যর্থতার দায়ভার চাপানোর কোনো সুযোগ নেই। এ নির্বাচনে বিএনপি দলীয়ভাবে যদিও অংশ নেয়নি, তারপরও বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত দুইজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর সম্মিলিত ফলাফল তাদের শক্তির জানান দেয়। ইভিএম মেশিনের ধীরগতির পরও ৬০% ভোট পড়েছে এবং কোথাও কোনো সন্ত্রাস বা সহিংসতা ঘটেনি। নির্বাচনের ফল প্রকাশের সময় কিছু ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা দৃশ্যমান হয়েছে। সেখানে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেছে কিনা, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সিইসির অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার অব্যাহত চেষ্টার অংশ হিসেবে প্রয়োজনে কিছু নির্বাচনী আইনের সংস্কার করতে হবে। 

‘কুমিল্লায় যিনিই জিতুন, নির্বাচনটি যেন না হারে’- আমরা এর জবাব পেয়ে গেছি। তবে আত্মসন্তুষ্টি একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। সন্ত্রাস ও সহিংসতামুক্ত কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন আগামী জাতীয় নির্বাচনের পথ দেখাবে এ প্রত্যাশা সকলের।

লেখক : দেলোয়ার জাহিদ, কানাডা প্রবাসী


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি - dainik shiksha ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ অষ্টম পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করবে ইউএনএফপিএ - dainik shiksha অষ্টম পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করবে ইউএনএফপিএ ইসরায়েলকে বোমা পাঠানো বন্ধ রাখছে যুক্তরাষ্ট্র - dainik shiksha ইসরায়েলকে বোমা পাঠানো বন্ধ রাখছে যুক্তরাষ্ট্র ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে - dainik shiksha ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! - dainik shiksha ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল - dainik shiksha জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0064890384674072