নতুন শিক্ষাক্রমে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে শিখনকালীন মূল্যায়ন, যেটি প্রাকটিক্যাল টিচিং লার্নিংয়ের কথাই বলে। একটি ভাষা শেখার ক্ষেত্রে বিষয়টি অত্যন্ত কার্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা ভারতের হিন্দি ফিল্ম আর সিরিয়াল দেখে হিন্দি কথা বলতে পারেন এবং হিন্দি বোঝেন। যদিও তারা হিন্দি অক্ষরের সঙ্গেও পরিচিত নন, হিন্দি বিদ্যালয়ে পড়েননি, শিক্ষকদের সহায়তা নেননি, কোনো পরীক্ষাও দেননি। শুধু ভারতীয় সিনেমা দেখেই হিন্দি শিখে ফেলেছেন! ইংরেজির ক্ষেত্রে হয়েছে পুরোপুরি উল্টো। আমরা দীর্ঘ বারো বছর বাধ্যত্যমূলক বিষয় হিসেবে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি পড়াচ্ছি। শুধু কি পড়াচ্ছি, তারা কোচিং করছেন, ক্লাস করছেন, প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ছেন, পরীক্ষা দিচ্ছেন, বোর্ড থেকে ইংরেজিতে একটি গ্রেড নিয়ে পাসও করছেন। কিন্তু ইংরেজি না পারছেন বলতে, না পারছেন বুঝতে, না পারছেন নিজ থেকে দু’ চার লাইন লিখতে (ব্যতিক্রম দু’ চারজন ছাড়া)। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত বেশির ভাগ মূল্যায়ন হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাধ্যমে। অর্থাৎ বিষয় শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সারা বছর ধরে অ্যাসাইনমেন্টভিত্তিক কাজ, প্রকল্পভিত্তিক শিখনচর্চা, খেলাধুলা, গ্রুপ ওয়ার্ক, কুইজ, পোস্টার প্রদর্শনীসহ বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করাবেন এবং তাদের কাজের মূল্যায়ন করবেন।
তবে, আমার আজকের লেখা ভুল নিয়ে নয়। আমার লেখা ইংরেজি বই কতোটা আনন্দময় আর ইংরেজি ভাষা শেখানোর ক্ষেত্রে কতোটা উপযোগী হয়েছে, সেই বিষয়ে সামান্য একটু আলোকপাত করা। মাতৃভাষার বাইরে অন্য কোনো ভাষা শেখাতে হলে সেই ভাষাতেই শেখানোর পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হয়। তা না হলে শিক্ষার্থী বারবার তার মাতৃভাষায় ফিরে আসবে, বাধাগ্রস্ত হবে তার দ্বিতীয় ভাষাশিক্ষা। নতুন বইয়ে যেটি করা হয়েছে পুরো ইনস্ট্রাকশন বাংলায় করা হয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে শিক্ষার্থীরা এবং শিক্ষক ইংরেজি প্রাকটিস করবেন না। এটি ন্যাচারাল। তারা ইংরেজির দিকে তাকাবেনই না। তাহলে শিক্ষার্থীরা ইংরেজি কোথা থেকে শিখবেন, ইনস্ট্রাকশনগুলো সব সময়ই ইংরেজিতে ছিলো। এখন পাঠকে আনন্দময় করতে গিয়ে সব বাংলায় করা হলো, এ কেমন ভাষাশিক্ষার পদ্ধতি! আমরা তো আবারও গ্রামার ট্রান্সলেশন মেথডে ফিরে গেলাম। ইংরেজিতে যারা প্রশিক্ষণ দিয়েছেন-তারা দু’একজন ব্যতিক্রম ছাড়া সবাই বাংলায় প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তারা শিক্ষার বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন, কিন্তু ভাষা শেখার জায়গাটি কোথায়? এমনিতেই ক্লাসরুমের বাইরে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি প্রাকটিসের সুযোগ নেই বললেই চলে, ক্লাসরুম আর বই থেকে কিছুটা শিখবে। সেখানেও ইংরেজি শেখার সুযোগ সংকুচিত করা হলো।
আমাদের শিক্ষার্থীদের সমস্যা হচ্ছে, সিচুয়েশন সব জানা থাকলেও নিজ থেকে ইংরেজিতে কিছু লিখতে পারেন না, একইভাবে বলে প্রকাশ করতে পারেন না, যদিও তাদের সম্ভাবনা আছে। অন্যের ইংরেজি শুনে, বিদেশিদের ইংরেজি শুনে বুঝতে পারেন না, ইংরেজিতে লেখা কোনো বিষয় পড়ে বুঝতে পারেন না। শুধু নিজ টেক্সট বইয়ের নির্দিষ্ট কিছু চ্যাপ্টার ছাড়া। ঘুরেফিরে তারা ওই কয়েকটি চ্যাপ্টার এবং প্যাসেজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছেন। ফলে, পাসের হার বাড়ছে প্রচুর, কিন্তু ইংরেজি শেখার ধারে-কাছেও নেই দু’চারজন অনন্য ব্যতিক্রম ছাড়া। ইংরেজির এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য আমরা চিৎকার করছি, আবেদন করছি, শিক্ষার পত্রিকা দৈনিক শিক্ষাডটকম-এ লিখছি, টিচারদের সংগঠন করছি। কারণ, টিচারদের আগে এই প্রাকটিসগুলো করতে হবে। তা না হলে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শেখায় কোনো পরিবর্তন আসবে না। ভেবেছিলাম, নতুন কারিকুলামে অনেকটাই পরিবর্তন আসবে। কিন্তু দেখলাম, উল্টো এবং আগের ইংরেজি বইয়ের চেয়ে আরও একধাপ পিছিয়ে। এজন্যই বারবার শুনতাম ‘আনন্দময় কারিকুলাম’ আসছে। শিক্ষার্থীরা ইংরেজি অর্থ বুঝতে পারেন না, তাই বাংলায় ট্রান্সলেট করে দেওয়া হয়েছে বইয়ের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়। ভাষাশিক্ষার ক্ষেত্রে এ কেমন পদ্ধতি, এই আনন্দের কথাই তাহলে শুনে আসছিলাম!
কেউ কেউ বলছেন, নতুন কারিকুলামে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বইয়ে ব্যাপকভাবে task-based language teaching theory প্রয়োগ করা হয়েছে। এখন শিক্ষার্থীরা সিএলটি মেথড, সঙ্গে জিটিম পদ্ধতিতে ইংরেজি শিখবেন। গ্রামার ট্রান্সলেশন পদ্ধতি তো পুরোনো, সেটি বাদ দিয়ে তো কমিউনিকেটিভ মেথড (সিএলটি) আমদানি করা হলো। দুই পদ্ধতির বেস্ট প্রাকটিসগুলো একসঙ্গে ব্যবহৃত হলে সেটিকে বলা হয় একলেকটিস অ্যাপ্রোস। এটি কিন্তু কোনোটিই হয়নি। তাহলে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শেখার কী হবে? তারা আরও বলছেন, শিক্ষার্থীরা নিজেরাই ভাষার চারটি দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হবেন। সেটি কীভাবে? বলা হয়েছে, প্রথমবারের মতো ইংরেজি বই দুটোতে বাংলা যোগ করা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের বাংলার মাধ্যমে ইংরেজি শিখতে উৎসাহিত করার জন্য। সেটিতো গ্রামার ট্রান্সলেশন মেথড যা বহু বছর চালু ছিলো, কিন্তু শিক্ষার্থীরা ভাষার প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারেননি। তাই সিএলটি আমদানি করা হলো। আবার সেই পুরোনো পদ্ধতিতে যাওয়া হচ্ছে কেনো?
ইংরেজিতে সামেটিভ অ্যাসেসমেন্ট ও কন্টিনিউয়াস অ্যাসেসমেন্ট দুটো পদ্ধতিতেই অ্যাসেসমেন্ট হবে। বলা হচ্ছে, সামেটিভ অ্যাসেসমেন্টের মাধ্যমে রিডিং ও রাইটিং স্কিল আর কন্টিনিউয়াস অ্যাসেসমেন্টের মাধ্যমে স্পিকিং ও লিসেনিং স্কিলসহ অন্যান্য স্কিল মূল্যায়ন করা হবে। এতে শিক্ষকদের ক্ষমতায়ন করা হলো বলেও কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। বলা হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা এখন ক্রিটিক্যাল থিংকিং ডেভেলপ করতে পারবেন। আমাদের শিক্ষার্থীরা ভাষায় বিশেষভাবে পিছিয়ে আছে, ইংরেজিতে কীভাবে তারা ক্রিটিক্যাল থিংকিং স্কিল উন্নত করবেন, নতুন নতুন ভোকাবুলারি সব লেসনের প্রথমে আছে আর, সবগুলোর অর্থ বাংলায় বইয়ের শেষে দেওয়া আছে। আসলে কোনো শব্দের অর্থ জানলেই ভোকাবুলারি উন্নত হয় না, শিক্ষার্থীরা যদি সেইসব নতুন শব্দ ব্যবহার করে নিজেরা বাক্য তৈরি করতে না পারেন। যতোটা সম্ভব ইংরেজিতেই শব্দগুলোর ব্যবহার ও অর্থ দেওয়াটা বিজ্ঞানসম্মত। কিন্তু সেসব বাদ দিয়ে বাংলায় শব্দের অর্থ দেওয়া হয়েছে, সম্ভবত এটিকেও তারা আনন্দময় বলে প্রকাশ করতে চেয়েছেন।
সপ্তম শ্রেণির বইয়ে ‘এ ড্রীম স্কুল’ নামক প্রথম চ্যাপ্টারে দেখলাম, আঠারোটি প্রশ্ন করা হয়েছে, সবগুলোই ‘ডু’ দিয়ে শুরু-এ কেমোন ভাষা শিক্ষার ক্লাস, আর আনন্দই বা কোথায়? বিভিন্ন রকম সাহায্যকারী ক্রিয়া দিয়ে বাক্যগুলো গঠন করা যেতো। দ্বিতীয় অধ্যায়ে ‘প্লেলিং উইথ ওয়ার্ডস’ এ ‘সাফিক্স’ আর ‘প্রেফিক্স’ বুঝানোর জন্য পুরোপুরি ট্রেডিশনাল পদ্ধতিতে জটিলভাবে গ্রামারের নিয়ম-কানুন ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এখানে আনন্দের তো কিছুই দেখছি না। আমরা দেখি, অনেক সময় গল্পকার গল্প বলে নিজেই হাসেন। কারণ, শ্রোতা কিছুই বোঝেননি। তবে শুরুতে কয়টি প্রশ্ন ছিলো, সে প্রশ্ন ক’টি ভালো। যেমন-ডু ইউ লাইক অর ডিজলাইক ক্রিকেট? আর দ্যা প্লেয়ারস স্পিরিটেড অর স্পিরিটলেস? তাছাড়া ‘Present Continuous’ আর Past Continuous tense শেখানোর জন্য বেশ ভাল কিছু উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। যেমন-Today I am having breakfast with my little sister but yesterday I was having my breakfast with my grandparents. এভাবে কিছু কিছু চ্যাপ্টারে ভাল কিছু অ্যাক্টিভিটি আছে। কিন্তু অধিকাংশ জায়গাতেই দেখা যায়, ট্রেডিশনাল পদ্ধতিই ব্যবহার করা হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণির বইয়ের ক্ষেত্রেও একই বিষয় ঘটেছে। স্থানাভাবে সবকিছু এখানে উল্লেখ করা সম্ভব হলো না। পরবর্তীতে হয়তো আরও লেখা নিয়ে হাজির হবো।
বইয়ের পক্ষে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের ‘প্যারাগ্রাফ’ আর ‘রচনা’ মুখস্থ করতে হবে না। গাইডবই ব্যবহার করার প্রয়োজন হবে না। বিভিন্ন সিচুয়েশনে শিক্ষার্থীরা ডেমোক্রেটিক ওয়েতে নাকি সমস্যা ডিল করতে করতে এগিয়ে যাবেন। ইংরেজির স্কিলগুলো ধারালো করা না হলে কীভাবে তারা লিখবেন আর কীভাবে ডেমোক্রেটিক ওয়েতে আগাবেন। যেমন, তাদের ইংরেজির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে পুরোটাই বাংলায় এবং এইসব কথাগুলোই বেশি বেশি আলোচিত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ল্যাংগুয়েজ ডেভেলপ করতে গিয়ে শিক্ষকদের যে ডেভেলপ করতে হবে-তার তেমোন কোনো আলোচনা বা প্রশিক্ষণ অনুপস্থিত। আরও বলা হয়েছে, ইংরেজিতে ফেলের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে যাবে। ইংরেজিতে এখন কতো শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেন? কৃষিবিজ্ঞান, ইতিহাস কিংবা ইসলামিয়াতে ফেল করতে পারেন, কিন্তু ইংরেজিতে তো ফেল করা কঠিন। বোর্ড পরীক্ষার ফল তো তাই বলে। এখন ৬০ শতাংশ নম্বর শিক্ষকের হাতে, অতএব ফেলের কোনো প্রশ্ন ওঠেনা। ইংরেজি না শিখে পাস, এখন না শিখে না পড়ে, পাস হবে। এটিকেও আনন্দের বিষয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে কী না জানিনা। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, একজন দক্ষ শিক্ষক কিন্তু পত্রিকার কিংবা বইয়ের একটি পাতা ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের হাসাতে পারেন, নাচাতে পারেন, গান গাওয়াতে পারেন, গ্রামার শেখাতে পারেন, ভাষার চারটি স্কিল প্রাকটিস করাতে পারেন, সঙ্গে সঙ্গে শেখাতে পারেন মানবিকতা, সহানুভূতি, দেশপ্রেম। অর্থাৎ, জাদু কিন্তু শিক্ষকের হাতে। শিক্ষকদের সেভাবে প্রস্তুত করতে পারলে এতো ঢাকঢোল পেটানো দরকার হয় না। শিক্ষকরা নিজেরাই আনন্দের মাধ্যমে পড়াতে পারবেন, বিষয় শেখাতে পারবেন। কিন্তু শিক্ষকদের সেই উন্নয়নের ব্যবস্থাটি কোথায়-এটি নিয়ে ভেবে দেখার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
লেখক : মাছুম বিল্লাহ, প্রেসিডেন্ট ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)