গরম বেশি পড়লে দেশের সবখানে গরম নিয়ে আলাপ শুরু হয়। ফ্যান ছাড়লে গরম বাতাস টের পাওয়া যায়। খুব গরম পড়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গরম নিয়ে শোরগোল শুরু হলো। কিন্তু শরৎকালেও গরম থেকে নিস্তার নেই। মাঝেমধ্যেই বৃষ্টি ঝরছে। বয়ে যাচ্ছে ঝড়ো হাওয়া। তবে বৃষ্টিতেও ফিরছে না স্বস্তি। বৃষ্টির সময়ও ঝরছে ঘাম। চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল ৫৮ বছরের মধ্যে সবচেয়ে উত্তপ্ত দিন কাটায় রাজধানীবাসী। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ওইদিন বেলা তিনটা পর্যন্ত ঢাকার তাপমাত্রা উঠেছে সর্বোচ্চ ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পাশাপাশি বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকায় গরমের আঁচ আরও বেশি অনুভূত হয়। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার তাপমাত্রা সর্বোচ্চ উঠেছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
প্রখর রোদের ঝলকানিতে বেড়েছে গরমের তীব্রতা। গরম থেকে আরাম পেতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের (এসি) ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে মানুষ। আর মানুষের পৃথিবীকে এই আরামের জন্য মূল্য দিতে হচ্ছে। এসি ঘরকে ঠাণ্ডা করলেও বাইরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তাছাড়া এসির রাসায়নিক উপাদান ক্লোরোফ্লোরো-কার্বন (সিএফসি) অথবা ফ্রেয়ন এবং হাইড্রো-ক্লোরোফ্লোরো-কার্বন (এইচসিএফসি) নামের রাসায়নিক বাতাসে ছড়িয়ে ওজোন স্তরের ক্ষতি করে।
বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এইচএফসি একটি গ্রিনহাউজ গ্যাস হিসেবে কার্বন ডাইঅক্সাইডের চাইতে কয়েক হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী এবং এটার উচ্ছেদ বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি কমাতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। এক হিসেবে দেখা গেছে, প্রতিবছর এই এইচএফসির চাহিদা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। এমন বাস্তবতায় আজ বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে বিশ্ব ওজোন দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘মন্ট্রিল প্রটোকল বাস্তবায়ন করি-ওজোন স্তর রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করি।’
১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ সেপ্টেম্বর বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর ক্ষয়ের জন্য দায়ী দ্রব্যগুলোর ব্যবহার নিষিদ্ধ বা সীমিত করার জন্য ভিয়েনা কনভেনশনের আওতায় ওজোনস্তর ধ্বংসকারী পদার্থের ওপর মন্ট্রিল প্রটোকল গৃহীত হয়। এই দিনের স্মরণে ১৯৯৪খ্রিষ্টাব্দে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৬ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক ওজোন স্তর সুরক্ষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। বাংলাদেশ ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে এই মন্ট্রিল প্রটোকলে স্বাক্ষর করে। এরপর থেকে বাংলাদেশেও দিবসটি পালন করা হয়। ওজোন স্তরের ক্ষয় ও এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা তৈরির জন্য ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম দিবসটি পালন করা হয়। একই বছর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৬ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক ওজোন স্তর সুরক্ষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর থেকে প্রতি বছর ওজোন স্তর সুরক্ষা দিবস পালন করে আসছে গোটা বিশ্ব।
বিজ্ঞানীদের মতে, ওজোন স্তর (ওজোন লেয়ার) হচ্ছে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের এমন একটি স্তর, যেখানে তুলনামূলকভাবে বেশি মাত্রায় ওজোন গ্যাস থাকে। এই স্তরে থাকে প্রধানত স্ট্র্যাটোমণ্ডলের নিচের অংশে, যা ভূপৃষ্ঠ থেকে ২০-৩০ কিলোমিটার ওপরে অবস্থিত। সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে পৃথিবীকে নিরাপদ রাখতে বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তরের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
দিবসটি বিষয়ে জানতে চাইলে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ‘ওজোন স্তর ক্ষয় হলে মানুষের বিভিন্ন রকমের কাশি, গলা জ্বালা, বুকে ব্যথা, এজমা, ক্যান্সার এসব হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ওজোন উদ্ভিদের গ্যাসীয় আদান-প্রদানকে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ হ্রাস করে এবং সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অ্যাটমোস্ফেয়ারিক ওজোন সূর্যের আলো, তাপ এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। এখন এই এটমোস্ফেয়ারিক ওজোন লেয়ারটা কতগুলো গ্যাসের কম্বিনেশনের কারণে ক্ষয় হয়। যাকে বলা হয় ওজোন ডিপ্ল্যাটিং সাবস্ট্যান্স। এই গ্যাসগুলো মানুষের বিভিন্ন কার্যকলাপের ফলে সৃষ্টি হয়। প্রাকৃতিকভাবেই সূর্যরশ্মি ওজোন লেয়ারে প্রতিফলিত হয়, কিন্তু ওডিএস সেই প্রতিফলন করাকে বাধা সৃষ্টি করে। অর্থাৎ ওজোন লেয়ারকে পুনরায় তৈরি হতে বাধা সৃষ্টি করে। সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মিকে সিএফসি গ্যাস অর্থাৎ ক্লোরোফ্লোরো কার্বন বা অন্য যেসব ওজোন ডিপ্ল্যাটিং সাবস্ট্যান্স আছে, সেগুলো মিলে ওজোন স্তরকে ক্ষয় করে ফেলে। আর ওজোন স্তর যখন ছিদ্র হয়ে যায় সেটাকে আমরা ওজোন হোল বলি। এই ওজোন হোল দিয়েই আসলে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে চলে আসে। পৃথিবীর তাপমাত্রা তখন বৃদ্ধি পায় এবং গ্লোবাল ওয়ার্মিং করে।’
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার বাণীতে বলেছেন, ‘ওজোন স্তরের মাত্রাতিরিক্ত ক্ষয় হলে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে মানবদেহে ক্যান্সার, রোগ প্রতিরাধ ক্ষমতা হ্রাসসহ উদ্ভিদ ও প্রাণিজগত হুমকির সম্মুখীন হবে। ওজোনস্তর রক্ষায় তাই সিএফসি গ্যাসের ব্যবহার হ্রাস ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সরকার গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়নে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওজোন দিবসে তার বাণীতে বলেছেন, ‘বায়ুমণ্ডলের এ অতি গুরুত্বপূর্ণ স্তর সুরক্ষার জন্য ভিয়েনা কনভেনশনের আওতায় ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে হতে মন্ট্রিল প্রটোকল বাস্তবায়িত হচ্ছে। ফলে বিগত ৩৬ বছরে পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ওজোনস্তর ধীরে ধীরে পুনর্গঠিত হতে শুরু করেছে এবং আশা করা যায় ওজোন স্তর ২০৬৬ খ্রিষ্টাব্দে মধ্যে তার পূর্বাবস্থায় ফিরে আসবে। এছাড়া মন্ট্রিল প্রটোকলের কিগালি সংশোধনী বাস্তবায়নের মাধ্যমে হাইড্রোফ্লোরো কার্বন (এইচএফসি) ব্যবহার পর্যায়ক্রমে হ্রাস এবং শক্তি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি-হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।’
দিবসটি উপলক্ষে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় বিভিন্ন কর্মসূচি আয়োজন করছে। সরকারি বেসরকারি সংস্থার অংশগ্রহণে দিবস উপলক্ষে একটি সমাবেশ ও শোভাযাত্রার আয়োজন করা হবে। মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনকে প্রধান অতিথি করে একটি সেমিনার আয়োজনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।