বেগম রোকেয়া দিবস আজ (৯ ডিসেম্বর)। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতিবছর এদিন সারাদেশে সরকারিভাবে রোকেয়া দিবস পালন করা হয়।
দিবসটি উপলক্ষে প্রতিবছরের মতো এবারও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে দেশজুড়ে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেছেন, বেগম রোকেয়া শুধু নারী শিক্ষার অগ্রদূতই ছিলেন না, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী নিবেদিতপ্রাণ একজন সমাজকর্মীও ছিলেন।
তিনি বলেন, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে বেগম রোকেয়া তার শানিত অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন যে, সমাজে নারীর অধস্তন অবস্থা নারী উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায়। তাই তার চিন্তা-ভাবনা-উদ্বেগ সর্বক্ষণ আবর্তিত ছিল নারী জাগরণ ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেন, বেগম রোকেয়া ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন আধুনিক নারী। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন সমাজ তথা রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নের জন্য পুরুষের পাশাপাশি নারীকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন। তার এই উপলব্ধি ও আদর্শ আজও আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায়।
১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের মিঠাপুকুর থানার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বেগম রোকেয়া। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়েও তিনি নারী জাগরণের অগ্রদূতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন খ্যাতিমান বাঙালি সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বাবা জহির উদ্দিন মুহম্মদ আবুল আলী হায়দার সাবের, মা রাহাতুন্নেছা চৌধুরানী। বেগম রোকেয়ার ছিল দুই ভাই ও দুই বোন। বড় ভাই ইবরাহিম সাবের ছিলেন একজন প্রগতিশীল মানুষ। অগোচরে মোমের আলোয় বেগম রোকেয়া ও আরেক বোন করিমনুন্নেছাকে বর্ণশিক্ষা দিতেন। আর রোকেয়ার ছিল জানার ও শিক্ষার অদম্য আগ্রহ।
১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ১৬ বছর বয়সে বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয় ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট খান বাহাদূর সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। রোকেয়া পেলেন আরেক জন প্রগতিশীল মানুষের সাহচার্য। স্বামী সাখাওয়াত হোসেন বেগম রোকেয়ার লেখাপড়ার প্রতি অকুণ্ঠ আগ্রহ দেখে তাকে সাহায্য করতে লাগলেন বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে এবং তার লেখালেখিতে সাহায্য করতে লাগলেন।
এই শিক্ষাই বেগম রোকেয়াকে ভাবতে শিখিয়েছিল সে সময়ের অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন জীবন, শিক্ষাহীন নারী সমাজের মুক্তির কথা। নারীদের অশিক্ষার অন্ধকার থেকে কী করে তাদের টেনে তোলা যায়, সে ভাবনা থাকতো তার মাথায়। আর তাই তো তিনি স্বপ্ন দেখলেন একটি স্কুলের। যেখানে সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীরা লেখাপড়া শিখবে। আর তার এ স্বপ্নকে আরও বড় করে তোলেন তার স্বামী সাখাওয়াত হোসেন।
১৯০২খ্রিষ্টাব্দে ‘পিপাসা’ নামে একটি বাংলা গল্প লিখে সাহিত্যের জগতে প্রবেশ। আর ১৯০৫খ্রিষ্টাব্দে রোকেয়া ইংরেজিতে লিখলেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘সুলতানাস ড্রিমস’। সাখাওয়াত হোসেন লেখাটি পড়ে অভিভূত হয়ে পড়েন এবং তাকে উৎসাহ দেন লেখাটি বই আকারে প্রকাশ করার জন্য।
১৯০৮খ্রিষ্টাব্দেসুলতানাস ড্রিমস বই আকারে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে বইটি বাংলায় ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নামে রূপান্তরিত হয়েও প্রকাশিত হয়। এই বইটিকে বিশ্বের নারীবাদি সাহিত্যে একটি মাইলফলক হিসেবে গণ্য করা হয়। তার অন্যান্য গ্রন্থগুলো হলো ‘অবরোধবাসিনী’, ‘মতিচুর’, ‘পদ্মরাগ’।
১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে সাখাওয়াত হোসেন খান মৃত্যুবরণ করেন। স্বামীর মৃত্যু তাকে অকাল বৈধব্য এনে দিলেও তাকে দমন করতে পারলেন না। কিন্তু কষ্টকে লালন না করে তিনি এগিয়ে গিয়েছেন তার অভীষ্ট লক্ষ্যে।
‘নারীশিক্ষার প্রসার ছাড়া নারী সমাজের মুক্তি নেই এবং সমাজের কোনো আশা নাই’ এই মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী বেগম রোকেয়া সমাজের প্রবল প্রতাপের বাধা থেকে বেড়িয়ে এসে নারী শিক্ষার জাগরণে কাজ করে যান। সেই সঙ্গে তার আন্দোলনে যোগ হয় নারী সমাজের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম।
সাখাওয়াত হোসেনের মৃত্যুর পাচ মাস পর ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দের ১ অক্টোবর ভাগলপুরের তদানীন্তন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ শাহ আব্দুল মালেকের সরকারি বাসভবন গোলকুঠিতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুল। তখন এর ছাত্রী সংখ্যা ছিল পাঁচজন। ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলার কারণে স্কুল বন্ধ করে কলকাতায় চলে যান।
পররর্তীতে ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ মার্চ স্কুলটি কলকাতায় ১৩ নম্বর ওয়ালীউল্লাহর ভাড়া বাড়িতে নতুন করে পুনরায় চালু করা হয়। বর্তমানে স্কুলটি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার পরিচালনা করছে। কলকাতায় প্রাথমিক অবস্থায় এই স্কুলের ছাত্রী সংখ্যা ছিল মাত্র আটজন।
সে সময় নারী শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রীদের ও তাদের অভিভাবকদের বোঝাতেন শিক্ষার কথা। এতে ধীরে ধীরে ছাত্রী সংখ্যা বাড়তে লাগলো। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে এটি হাইস্কুলে পরিণত হয়।
স্কুল প্রতিষ্ঠা করা ছাড়াও সে সময়ের নিগৃহীত নারী সমাজের অধিকার আদায়ের প্রতিষ্ঠাকে আরও বেগবান করার জন্য ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সঙ্গে চলতে থাকে সমাজের নানা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে তার ক্ষুরধার লেখনি।
১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দেতিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘মুসলিম মহিলা ট্রেনিং স্কুল’। সেখানে নারীদের রান্না, সেলাই, সন্তান পালনসহ নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। বেগম রোকেয়া নারীশিক্ষার প্রসারের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন। মিসেস আর এস হোসেন নামে সে সময়ের বিখ্যাত সব পত্রিকায় তিনি নারী জাগরণের ক্ষুরধার লেখা লিখেছেন।
১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম রোকেয়ার নামে একটি কলেজ স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে এটি জাতীয়করণ করা হয়। ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী হলের নাম করন করা হয় তার নামানুসারে। বর্তমান সরকার ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে ‘ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়’ করেন।