আজ মহামানবের জন্মদিন

দুলাল আচার্য |

একজন রাজনৈতিক কর্মী থেকে নিজের মেধা, প্রজ্ঞা-মননশীলতা ও শ্রমের কারণে পরিণত হয়েছিলেন একটি জাতি, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। এ জন্য তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে দীর্ঘপথ। যে পথ পুরোটাই ছিলো বন্ধুর। শত বাধা পেরোতে পায়ে বিঁধেছে কাঁটা, ঝরেছে রক্ত। তবু যাত্রা থামেনি, গন্তব্যে পৌঁছানো পর্যন্ত কোনো আপসও করেননি। ৫৫ বছরের জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাগার ছিলো ঠিকানা। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে দু-দু’বার তার হত্যার চেষ্টাও হয়েছিলো। সেই অন্ধকার সময় পেরিয়ে আলোর দিশা দিয়েছিলেন তিনি। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি জাতি-রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। তার সংগ্রামী জীবন, বিশেষ করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানি শাসকের বৈষম্য নীতি, শোষণ ও অগণতান্ত্রিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে তেজদীপ্ত নেতৃত্বের কথাই বারবার ঘুরে-ফিরে আসে। আজ তার জন্মদিন। বাঙালির জন্য এক অবিস্মরণীয় দিন। 

১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে বঙ্গবন্ধু বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার তৎকালীন গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়ার সম্ভ্রান্ত শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মা সায়েরা খাতুন। পিতা-মাতার চার কন্যা এবং দুই পুত্রের সংসারে তিনি ছিলেন তৃতীয়। সবার আদরের খোকা। খোকা নামের সেই শিশুটি পরবর্তী সময়ে হয়ে ওঠেন নির্যাতিত-নিপীড়িত বাঙালির ত্রাতা ও মুক্তির দিশারী। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, আত্মত্যাগ এবং জনগণের প্রতি মমত্ববোধের কারণে হয়ে ওঠেন বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা। গ্রামের স্কুলে তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি।

খোকা থেকে মুজিব এবং বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা হয়ে ওঠার পথ মসৃণ ছিলো না তার। এই জন্য ইতিহাসের দুর্গমপথ পাড়ি দিতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। জেল-জুলুম আর নির্যাতনের সিঁড়ি বেয়ে এগোতে হয়েছে তাকে। মুজিব বড় হয়েছিলেন স্বীয় প্রতিভায়, তেজে, সাহসে, ভালবাসায় এবং অঙ্গীকারে। সমাজের দুর্বল মানুষের প্রতি শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী মুজিবের কৈশোরের সেই অঙ্গীকার এবং এর প্রতি বিশ্বস্ততা অক্ষুণ্ন ছিলো শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। রাষ্ট্র ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছেও শ্রেণি অবস্থান বদল হয়নি তার। পরিবর্তন ছিলো না চলন-বলন ও কথনে। নিজের নতুন জামা অন্যকে দান করা এবং নিজেদের গোলার ধান ক্ষুধার্তদের বিলিয়ে দেয়া কিশোর সাহসী মুজিবকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার অভিযোগে কারাগারে যেতে হয়েছিলো। পেরেছিলেন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা ও মন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর সামনে দাঁড়িয়ে তাৎক্ষণিক ছাত্রদের দাবি আদায় করতে। গোপালগঞ্জের কৃষক আন্দোলনেও তাকে পাওয়া গেছে অগ্রণী ভূমিকায়। কলকাতায় গান্ধীর কুইট ইন্ডিয়া, নেতাজী সুভাষ বসুর হলওয়েল মনুমেন্ট ভাঙা, ‘১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ডা. বিধান রায়ের বাড়িতে হামলা চালালে তা প্রতিহত এবং পাহারা দেয়া, কলকাতা মাদরাসা ও লেডি ব্রাভোন কলেজে লঙ্গরখানার দায়িত্বে ছিলেন শেখ মুজিব। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে শেরে বাংলাকে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কারের প্রতিবাদে রাস্তায় মিছিল নামিয়ে ছিলেন মুজিব। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে নির্বাচনে সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশে মুজিব ফরিদপুর জেলার নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করেন সফলভাবে। 

ঢাকায় শুরুতেই মুজিবকে পাওয়া গেলো পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগ্রামের পটভূমি সৃষ্টিতে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে গঠিত হলো গণতান্ত্রিক যুবলীগ। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ছাত্রলীগ। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ জুন জেলে বসেই নির্বাচিত হলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম-সম্পাদক। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১১ মার্চ বাংলা ভাষার দাবিতে ধর্মঘট পালনকালে পিকেটিংরত অবস্থায় প্রথম বন্দি হন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলন সমর্থনের কারণে ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হন শেখ মুজিব। মুচলেকা দেননি তাই ছাত্র জীবনের ইতি ঘটে সেখানেই তার। 

শুরু হয় জীবনের আরেক অধ্যায়। বাঙালির অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলন। আবার বন্দি দীর্ঘদিন ধরে। ছাড়া পান ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ ফেব্রুয়ারি। যাদের রক্তের বিনিময়ে মুক্তি পেলেন তাদের ত্যাগ মুজিবকে আরো বেশি সাহসী ও গতিশীল করে তোলে। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তানকে ৯৮ শতাংশ স্বায়ত্তশাসন দেয়ার দাবিতে পল্টনে এক জনসভায় তার রাজনৈতিক গুরু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দীকেও ছেড়ে কথা বলেননি তিনি।  

১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে আয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে চার দিনের মধ্যে শেখ মুজিবকে বন্দি করলেন। রাখলেন দেড় বছর। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে মণি সিংহ, মানিক মিয়া, খোকা রায়দের সঙ্গে এক বৈঠকে মুজিব বলে ফেললেন, ওদের সঙ্গে আর থাকা যাবে না। স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু করতে হবে।’ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আইয়ুবের নির্যাতন ও শোষণের বিরুদ্ধে লড়বার জন্যও নেতা কেবলই মুজিবই। তিনি প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসনের চাইতে এক ধাপ এগিয়ে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য ঐতিহাসিক ৬ দফার দাবি পেশ করেন। 

এরপর তিনি আর মুজিব নন, বঙ্গবন্ধু। কৃতজ্ঞতার এ ঋণ শোধ করার জন্য তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। শেখ মুজিব আইয়ুবের উত্তরাধিকারী ইয়াহিয়ার কাছ থেকে প্রথমেই দুটি জিনিস আদায় করে নিলেন। সত্তরের নির্বাচনে জনগণ পাকিস্তানের ৩০০ আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ ১৬৯ এর মধ্যে ১৬৭টিতে মুজিবের দল আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করে। এই বিজয় শুধু পূর্ব পাকিস্তান নয়, সমগ্র পাকিস্তান শাসনের অধিকার পান তিনি। 

বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন একটি নজিরবিহীন ঘটনা। এমনকি বাস্তিল কারাগারের পতন, ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, মাও সেতুং-এর লং মার্চ-এসব ঘটনার চাইতেও ব্যতিক্রম কৌশল ছিলো এই আন্দোলন। কার্যত ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ মার্চ পাক প্রেসিডেন্ট ঢাকায় আসতে মুজিবের অনুমতি নিতে হয়েছিলো। আর তার উপস্থিতিতে এতদাঞ্চলে চলছিলো অঘোষিত মুজিবের সরকার। 

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ রাতে শত্রুরা যখন মুজিবকে বন্দি করে তখন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে  ‘This may be my last massage. from today, Bangladesh is Independent’। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ১০ এপ্রিল ’৭১ তার যোগ্য উত্তরসূরি সৈয়দ নজরুল ও তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখরা গঠন করেন মুজিব নগর সরকার। তৈরি হয় ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। 

রাষ্ট্র পরিচালনায় এসে বঙ্গবন্ধু দেখলেন কলোনিয়াল বুল দিয়ে রাজার মতো দেশ শাসন করা যায়, কিন্তু দুঃখী মানুষের কল্যাণ আসে না। তাই তার দ্বিতীয় বিপ্লব শুরু হয় বিশ্বের শোষিত মানুষের পক্ষে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন এবং বাস্তচ্যুত ও অসহায় মানুষের পুনর্বাসনের গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করলেন। শুধু তাই নয়, এক বছরের মধ্যেই জাতি একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান পেলো, অনুষ্ঠিত হলো সাধারণ নির্বাচন। কিন্তু সময়টা অনেক বদলে গিয়েছিলো। স্বাধীন দেশে মানুষের প্রত্যাশা এতো বেড়ে গিয়েছিলো যে, অনেক ক্ষেত্রে বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে মিল হচ্ছিলো না। তখনই আন্তর্জাতিক এবং স্বাধীনতার পরাজিত শক্তির সম্মিলিত ষড়যন্ত্রে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। 

এ কথা সত্য যে, ’৭৫ পরবর্তী সময়টা নতুন প্রজন্মের অনুধাবন করা কষ্টকর। কারণ, ’৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশ আর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাংলাদেশ নতুন প্রজন্মের কাছে চিন্তার দূরত্ব অনেক। যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলো, যারা হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করলো, যারা আইন দ্বারা বিচার কাজ বন্ধ করলো, যারা পাকিস্তানের আদলে বাংলাদেশ গড়তে চাইলো- তাদের ব্যাপারে বর্তমান প্রজন্ম কতোটুকুই বা জানে? শুধু তাই নয়, তারা ইতিহাস বিকৃত করে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার নানা কৌশলে ষড়যন্ত্র শুরু করলো। ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিতে নানা কৌশল করেছিল তৎকালীন ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউর রহমান ও তার অনুসারীরা। 

দেশের ১৮ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ৭ কোটিই শিশু। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে প্রত্যাশা শিশুরা যাতে একটি সুষ্ঠু স্বাভাবিক উপায়ে বেড়ে উঠতে পারে সেটি নিশ্চিত হোক। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাও পিতার মতো শিশুদের ভালোবাসেন। তার সরকার শিশু অধিকার রক্ষায় নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। শিশুর অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তাদের আগামীর সুযোগ্য নাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠার সুযোগ করে দিতে হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কর্ম ও রাজনৈতিক জীবন অসামান্য গৌরবের। তার এ গৌরবের ইতিহাস থেকে প্রতিটি শিশুর চারিত্রিক দৃঢ়তার পাশাপাশি স্বাস্থ্য-পুষ্টির দিকে নজর দিয়ে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ নিশ্চিত হোক-শিশু দিবসে এই প্রত্যয়। 

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ - dainik shiksha ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত - dainik shiksha টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0024189949035645