আটকে আছে মহার্ঘ ভাতার সিদ্ধান্ত, করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর বিরোধী এনবিআর

দৈনিকশিক্ষা প্রতিবেদক |

মহার্ঘ ভাতা ও করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সরকারি কাজে কর্মরতদের মহার্ঘ ভাতা দেওয়ায় সরকারের আন্তরিক ইচ্ছে থাকলে বাড়তি ব্যয় এখানে বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আদায় ও করদাতা কমে যাবে। এতে এনবিআর করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর ঘোর বিরোধিতা করছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সরকারের ব্যয় না বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। একই সঙ্গে আদায় ও করদাতা বাড়ানোরও শর্ত দিয়েছে। রোববার (১৪ মে) দেশ রুপান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন ফারজানা লাবনী। 

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, বৈশ্বিক মন্দা ও ডলার সংকটের কারণে দেশের অর্থনীতি খানিকটা বেকায়দায় আছে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। রিজার্ভ, রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ে সুখবর নেই বললেই চলে। বাধ্য হয়েই শর্ত মেনে ঋণদানকারী সংস্থার কাছ থেকে অর্থ জোগাড়ে নেমেছে সরকার। আইন করে খরচ কমানোর পথে হাঁটছে। এমন পরিস্থিতিতে ভাতা বাড়িয়ে খরচের নতুন খাতা খোলা ঠিক হবে না বলে সরকারের নীতিনির্ধারকদের অনেকে এরই মধ্যে অর্থমন্ত্রীকে সতর্ক করেছেন।

তাই জাতীয় নির্বাচনের আগের শেষ বাজেট হওয়ায় সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের খুশি করতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রণীত বাজেট বিষয়ক রূপারেখায় মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হলেও তা এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি। এছাড়া বেসরকারি খাতের অনেক প্রভাবশালী ব্যবসায়ীও সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা বাড়ানোর পক্ষে নেই। সরকারি খাতের কর্মরতদের ভাতা দেওয়া হলে বেসরকারি খাতের বেতন-ভাতা বাড়ানোর চাপ আসবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো যাচ্ছে না। এই সময়ে নতুন করে বেতন-ভাতা বাড়ানোর চাপ নিতে রাজি নয় বেসরকারি খাতের অনেক মালিক। এসব ব্যক্তি সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে নিজে থেকে যোগাযোগ করে আপাতত মহার্ঘ ভাতা না দেওয়ার পক্ষে নিজের মতামত জানিয়েছেন। 

তবে অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলেছেন, খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত সব ধরনের খরচ বেড়েছে। এতে জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে সবাই। সরকারি-বেসরকারি সব খাতেই বেতন-ভাতা বাড়ানো এবং সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর পক্ষে তারা মত দিয়েছেন।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক মন্দা দেখা দিয়েছে। ডলার সংকট চলছে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো যাচ্ছে না। বেতন বাড়ার সুখবর নেই বললেই চলে। রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি। ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে বেতন বা ভাতা যাই বাড়ানো হবে তাতেই সরকারের ওপর চাপ বাড়বে। একইভাবে বেসরকারি খাতের মালিকরাও চাপে পড়বে। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে তাই আমি বেতন-ভাতা বাড়ানোর পক্ষেই বলব। বেশিরভাগ চাকরিজীবীকে বেতন-ভাতার ওপর নির্ভর করে চলতে হয়।

গত মাস ছয়েক থেকে মূল্যস্ফীতির অঙ্ক গড়ে ৮/৯ শতাংশের ঘরে আছে। বিবিএসের তথ্যানুসারে বাংলাদেশে মার্চে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ, যা বিগত সাত মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ প্রায় সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। শুধু তাই নয় খাদ্যবহির্ভূত খরচও বেড়েছে। এতে সার্বিকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। সাধারণ মানুষ এ খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রণীত রূপরেখায় মহার্ঘ ভাতার বিষয়টি রাখলেও এ খাতে কোনো বরাদ্দ না রেখেই গত ১১ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেওয়া হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাজেট প্রস্তুত কমিটির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, নির্বাচনের আগে শেষ বাজেট হওয়ায় সরকারি কাজে কর্মরতদের সন্তুষ্টিতে মহার্ঘ ভাতা দিতে চায় সরকার। এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি। যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এতে সরকারের ব্যয় বাড়বে। যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে না বাড়ানোর পক্ষে অনেকে সতর্ক করেছেন।

প্রসঙ্গত, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি হিসাব অনুযায়ী দেশে সরকারি কর্মচারী ১৪ লাখ। বিভিন্ন করপোরেশন এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের নিয়ে এ হিসাব প্রায় ২২ লাখ। বর্তমানে সরকারি কর্মচারীরা ২০১৫ সালের বেতন কমিশন অনুযায়ী বেতন-ভাতা পাচ্ছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী এ বেতন কমিশন প্রণীত হয়েছিল। এ কমিশনের সুপারিশে বলা হয়, আর নতুন বেতন কমিশন গঠন করা হবে না। প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট বা বেতন বাড়ানো হবে। এ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী তা হয়ে আসছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ রাখা হয়েছে ৭৫ হাজার ১০ কোটি টাকা। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি অঙ্কের বাজেটে বেতন-ভাতার জন্য বরাদ্দ রাখা হতে পারে ৭৭ হাজার কোটি টাকা। এখানে মহার্ঘ ভাতা ১০ শতাংশ দেওয়া হলে এ হিসাবে ৪ হাজার কোটি টাকা যোগ করতে হবে। ১৫ শতাংশ দেওয়া হলে ৬ হাজার কোটি এবং ২০ শতাংশ দেওয়া হলে ৮ হাজার কোটি টাকা যোগ করতে হবে। অর্থাৎ মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হলে আগামী অর্থবছরে সরকারের ব্যয় বাড়বে।

বর্তমানে আয়কর আইন অনুযায়ী করদাতাদের আয় তিন লাখ পর্যন্ত করমুক্ত। পরবর্তী এক লাখ পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ৫ শতাংশ, পরবর্তী ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ, পরবর্তী ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ২০ শতাংশ, অবশিষ্ট মোট আয়ের ওপর ২৫ শতাংশ হারে কর ধার্য রয়েছে। ২০১৯ সালে রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত এনবিআরের তৈরি এক প্রতিবেদনে হিসাব কষে বলা হয়, করমুক্ত সীমা ৫০ হাজার টাকা বাড়ানো হলে এক করবর্ষে (এক বছরে) এনবিআরের আদায় কমবে ৬০ কোটি থেকে ৭০ কোটি টাকা। বছরে ৩ লাখ থেকে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত করযোগ্য আয় আছে এমন করদাতাদের অধিকাংশই সাধারণ আয়ের।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ভিসি নিয়োগের দাবিতে এবার উত্তরবঙ্গ ব্লকেড বেরোবি শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ভিসি নিয়োগের দাবিতে এবার উত্তরবঙ্গ ব্লকেড বেরোবি শিক্ষার্থীদের দীপু মনি-রতন সিন্ডিকেটের ফিরোজই শিক্ষা অধিদপ্তরের এ ডি! - dainik shiksha দীপু মনি-রতন সিন্ডিকেটের ফিরোজই শিক্ষা অধিদপ্তরের এ ডি! ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের ‘জাতীয় বীর’ ঘোষণার দাবি জামায়াতের - dainik shiksha ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের ‘জাতীয় বীর’ ঘোষণার দাবি জামায়াতের শিক্ষক আত্মগোপনে দায়িত্বে ছাত্ররা - dainik shiksha শিক্ষক আত্মগোপনে দায়িত্বে ছাত্ররা ভারতে পাঠ্যবই ছাপানোর বিপক্ষে ৯২ শতাংশ বাংলাদেশি - dainik shiksha ভারতে পাঠ্যবই ছাপানোর বিপক্ষে ৯২ শতাংশ বাংলাদেশি পেছালো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ১ম বর্ষের পরীক্ষা - dainik shiksha পেছালো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ১ম বর্ষের পরীক্ষা ভয়ংকর বিপদের মধ্যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী - dainik shiksha ভয়ংকর বিপদের মধ্যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রশ্নফাঁসের মামলায় ১০ জনের কারাদণ্ড, খালাস ১১৪ - dainik shiksha প্রশ্নফাঁসের মামলায় ১০ জনের কারাদণ্ড, খালাস ১১৪ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ ও সবুজায়নের তথ্য আহ্বান - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ ও সবুজায়নের তথ্য আহ্বান কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026428699493408