আত্তীকরণ বিধিমালা সংশোধন প্রয়োজন: শেষ পর্ব

সুধাংশু শেখর তালুকদার |

সরকারিকৃত প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত সহকারী প্রধান শিক্ষক, সিনিয়র শিক্ষক, সহকারী গ্রন্থাগারিক, কম্পিউটার ডেমোনেস্ট্রেটর, ল্যাব/শপ অ্যাসিসটেন্ট পদে কর্মরত শিক্ষক কর্মচারীরা সরকারিকরনের পর আর্থিক ভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এর একটি তুলনামূলক বিবরণী নিম্নে উপস্থাপন করা হলো- 

বেসরকারি আমল ও সরকারি হওয়ার পর প্রাপ্ত বেতনের তুলনামূলক বিবরণী:

বয়স ৫৯ উত্তীর্ণ: প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণের দিন যাদের বয়স ৫৯ উত্তীর্ণ হয়নি, কিন্তু আত্তীকরণের দীর্ঘ সূত্রিতার কারণে অ্যাডহক নিয়োগের সময় বয়স ৫৯ উত্তীর্ণ হয়েছে এমন শিক্ষক কর্মচারীকে প্রথম দিকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আনলে আত্তীকরণ বিধিতে ধারা সংযোজন করে তাদেরকে আত্তীকরণের আওতায় আনা হয় কিন্তু নিয়োগ দেয়া হয়নি। বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রনালয়ে কথা বললে জানা যায়, আত্তীকরণ বিধি অনুমোদনের পর তাদেরকে নিয়োগ দেয়া হবে। অথচ সরকারিকৃত কলেজে বয়স ৫৯ উত্তীর্ণদের একইসঙ্গে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। কলেজ বিধিতে ৫৯ উত্তীর্ণদের নিয়োগ দেয়া যাবে কি না এরূপ নির্দেশনা না থাকার পরও তারা নিয়োগ  পেছেয়েন। পক্ষান্তরে সরকারিকৃত মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠানে ৫৯ উত্তীর্ণদের নিয়োগ দেয়া হয়নি। এতে কয়েক শত বয়স ৫৯ উত্তীর্ণ শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগ বঞ্চিত হয়ে চরম আর্থিক কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। 

বকেয়া উৎসব ও শ্রান্তি বিনোদন ভাতা: ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে একই তারিখে দুইটি প্রতিষ্ঠান সরকারি হয়েছে। আত্তীকরণ প্রক্রিয়ার দীর্ঘ সূত্রতার কারণে একটি প্রতিষ্ঠান ২০২০ এবং অন্যটি ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে অ্যাডহক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে অ্যাডহক নিয়োগপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীরা শুরু থেকে উৎসব ভাতা, বৈশাখী ভাতাসহ দুটি শ্রান্তি বিনোদন ভাতা পেয়েছেন। পক্ষান্তরে যে প্রতিষ্ঠানটি ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে অ্যাডহক নিয়োগ পেলো সেসব শিক্ষক কর্মচারীরা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের পূর্বে কোনো উৎসব ভাতা, বৈশাখী ভাতা, শ্রান্তি বিনোদন ভাতা পাছেন না। একই সময়ে সরকারিকরণ হলেও ভিন্ন তারিখে অ্যাডহক নিয়োগের কারণে দুই ধরনের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক কর্মচারীদের মধ্যে উৎসব ভাতা, বৈশাখী ভাতা, শ্রান্তি বিনোদন ভাতা কেউ পাচ্ছেন, কেউ পাচ্ছেন না। আত্তীকরণ দীর্ঘ সূত্রতার কারণে কেউ সুবিধাপ্রাপ্ত, কেউ সুবিধাবঞ্চিত-এটা হতে পারে না।

মহাপরিচালকের প্রতিনিধি: আত্তীকৃত প্রতিষ্ঠান প্রধান বা ভারপ্রাপ্ত প্রধানরা বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ বোর্ডে মহাপরিচালকের প্রতিনিধি হিসেবে সদস্য মনোনীত হতেন। কিন্তু ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ২১ জানুয়ারির মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পত্রে নিয়মিতকরণ না হলে আত্তীকৃত প্রধান বা ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মহাপরিচালকের প্রতিনিধি মনোনীত হতে পারবেন না মর্মে আদেশ জারি করা হয়। নিয়মিতকরণ একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া হওয়া সত্ত্বেও যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নিয়োগ এবং বেতন ভাতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে নিয়মিতকরণের অজুহাতে মনোনয়নবঞ্চিত করে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে।

নিয়মিতকরণ/স্থায়ীকরণ: আত্তীকৃত শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি নিয়মিতকরণ বা স্থায়ীকরণের চরম বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। দু’তিনটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কোনো প্রতিষ্ঠানের নিয়মিতকরণ বা স্থায়ীকরণ হয়নি। নিয়মিতকরণ প্রক্রিয়াটি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রস্তাব প্রেরণের পর শিক্ষা মান্ত্রণালয় থেকে পাবলিক সার্ভিস কমিশনে প্রস্তাব প্রেরণ করে। পিএসসি যাচাই-বাছাই করে নিয়মিতকরণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠায়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিয়মিতকরণের আদেশ জারির সময় দেখা যায় যে পদ সংরক্ষণের আদেশ নেই। অথচ পদ সংরক্ষণের আদেশটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় যখন পদ সৃষ্টির আদেশ করে তখনই করার কথা। কোনো অদৃশ্য কারণে তখনকার সময়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা পদ সংরক্ষণের আদেশ জারি করেননি। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের সব পদেই সংরক্ষণের আদেশ করা হয়নি। কিছু প্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক ছাড়া অন্য পদগুলোর পদ সংরক্ষণ আদেশ জারি করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে শিক্ষক-কর্মচারীদের। 

সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র পদ সংরক্ষণের আদেশের অভাবে দুই বছর ধরে নিয়মিতকরণ/স্থায়ীকরণ আটকে আছে। এই দুই বছর মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ে ধরনা দিয়েও কোনো দায়িত্বশীল কর্মকর্তা পাওয়া যায়নি, যিনি মন্ত্রণালয়ের অতীতের ভুলটি সংশোধন করে ভূতাপেক্ষ পদ সংরক্ষণের আদেশ জারি করে দেবেন। কর্মকর্তাদের আচরণে মনে হয়েছে যেনো এ ভুলের দায় শিক্ষক-কর্মচারীদের। সমস্যা আরো জটিল আকার ধারণ করেছে হাল নাগাদ পদ সংরক্ষণের আদেশের জন্য। হালনাগাদ পদ সংরক্ষণের ফাইল মাউশি অধিদপ্তরের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানোর পর একটি নতুন চেকলিস্ট দিয়ে আবারো মাউশিতে পাঠানো হয়। নতুন চেকলিস্ট অনুযায়ী মাউশিতে ফাইল জমা দিলে ৭-৮ মাস ধরে মাউশিতে পদ সংরক্ষণের ফাইল পরে আছে। পদ সংরক্ষণের ফাঁদে পড়ে অবসর গ্রহণকারী ও মৃত্যুবরণকারী আত্তীকৃত কোনো শিক্ষক কর্মচারী আজ পর্যন্ত পেনশন সুবিধা পাচ্ছেন না। কোনো কোনো আঞ্চলিক উপ-পরিচালকরা পিআরএল গমণকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়মিতকরণ না হওয়ায় পিআরএল মঞ্জুরের ফাইল অগ্রায়ণ করছেন না।

২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ জুলাই থেকে সরকারিকৃত প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ নিষেধাজ্ঞা জারি থাকায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৩০ শতাংশ বা তার অধিক পদশূন্য হয়েছে। শিক্ষক সংকটে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে প্রতিষ্ঠানগুলো চরম বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। যেখানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এমপিও নীতিমালার আলোকে এনটিআরসির মাধ্যমে পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। সেখানে সরকারিকৃত প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক সংকটের কারণে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা দুরূহ হয়ে পড়ছে। 
প্রধানমন্ত্রীর গ্রাম ও শহরের বৈষম্য দূরীকরণের মহতী উদ্যোগ নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে জনসাধারণ এবং শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে যেনো ভুল বার্তা না যায়, সে জন্য আত্তীকরণ বিধিমালা-২০২৪ আংশিক সংশোধনসহ উল্লিখিত সমস্যাবলির দ্রুত সমাধান প্রয়োজন।

লেখক: আহ্বায়ক, সরকারিকৃত মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি বাংলাদেশ, ঢাকা

 শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! - dainik shiksha মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0055801868438721