আনন্দময় হোক শিশুর শিক্ষাক্রম

মো. সিদ্দিকুর রহমান |
শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য জ্ঞান অর্জন। জ্ঞানার্জন ছাড়া নম্বরপ্রাপ্তি অর্থহীন। শিক্ষার্থীরা কী শিখছে? কতটুকুু শিখছে? এ বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। মুখস্থ করে না বুঝে তোতাপাখির মত বলতে ও লিখতে পারা জ্ঞানমুখী শিক্ষা নয়। শিক্ষাবান্ধব সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৃজনশীল, জীবনমুখী আনন্দময় শিক্ষা বিকাশে শিক্ষাক্রমকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। এর চ্যালেঞ্জগুলো দূর না করে শুধু শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের দিকে অগ্রসর হলে মুখ থুবড়ে পড়বে এ মহতী উদ্যোগ। এ জন্য প্রয়োজন সকল শিশুকে শিক্ষাক্রমের আওতায় আনা। আমাদের দেশের শিশুর জন্য হরেক রকম শিক্ষা ব্যবস্থা বেদনাদায়ক। অনেকটা জমিদারের ও গৃহকর্মীর ‘কূয়ায় পড়া’ শিশুর মত বৈষম্য। সবার আগে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মানসিক বিভ্রান্তি দূর করা উচিত। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী, সচিব ও মহাপরিচালকদের বদ্ধমূল ধারণা, তারা সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কেবল অভিভাবক মাত্র। তাঁরা মনে করেন, কিন্ডারগার্টেন বা বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বই ও পিএসসি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেয়াটা করুণা বা দান। এ করুণা বা দানের ফলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী কিন্ডারগার্টেন বা বেসরকারি স্কুলে লেখাপড়া করে আসছে। এতে নিঃসন্দেহে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর চাপ কমেছে। পাশাপাশি সরকারের বিশাল অর্থেরও সাশ্রয় হয়। অথচ উক্ত শিক্ষার্থীরা কী পড়ছে? কীভাবে চলছে তাদের শিক্ষাব্যবস্থা? এই বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের কোন খবর বা দায় আছে বলে দৃশ্যমান নহে।
 
সরকারি পাঠ্য বই ও পিএসসি পরীক্ষা দেয়ার মাধ্যমে মন্ত্রণালয় কিন্ডারগার্টেন বা বেসরকারি স্কুল গড়ে তোলার জন্য পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছে। অথচ নিষ্ঠুর বৈষম্যমূলক আচরণ করে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে আনন্দময় জ্ঞানমুখী শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিতও করা হচ্ছে। অবিলম্বে কিন্ডার গার্টেন বিদ্যালয়গুলোকে সহজ শর্তে রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনা প্রয়োজন। শিক্ষকদের ইউআরসি. পিটিআই-তে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি। নচেৎ একাংশ শিশু আলোকিত শিক্ষাক্রমের আওতায় আসবে। অপর অংশ অন্ধকারে হাবুডুবু খাবে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর দেশের শিশুশিক্ষায় এধরনের বৈষম্য জাতির জন্য মাঝ নদীতে ডুবে মারার মত। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কেন শিশুদের ওপর বৈষম্যময় বিমাতাসূলত কর্মকাণ্ড করে চলেছে, তা বোধগম্য নয়। বেসরকারি স্কুলের শিশুরা তো এদেশেরই সন্তান। পরীক্ষাপদ্ধতি নিয়ে আমাদের দেশের শিক্ষক, অভিভাবকরা এখনো গভীর নিদ্রায় মগ্ন। তারা উন্নত দেশের খোঁজ খবরের তোয়াক্কা করে না। তাদের মতে পরীক্ষা ছাড়া কি লেখাপড়া হয়? পুরনো ধারণা, পাস-ফেল তো থাকবেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সকল শিক্ষার্থীকে জ্ঞান অর্জনের আওতায় আনতে হবে। প্রাথমিকে এর প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো শিক্ষক সঙ্কট। এ সঙ্কট যেন অনেকটা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। করোনার পর শিক্ষক নিয়োগের কোন কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়। অথচ সরকারি, আধাসরকারিতে নিয়োগের কার্যক্রম জোরে সোরে চলছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে প্রয়োজনে শ্রেণিতে অনূর্ধ্ব ৩০ জন শিক্ষার্থী থাকা দরকার। শ্রেণির কার্যক্রমে পর শিক্ষককে পরবর্তী ঘণ্টা বিশ্রাম নেয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া শিক্ষক সঙ্কট জিরো টলারেন্স পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে। শিক্ষার্থী জ্ঞানমুখী করার জন্য তাদের প্রশ্ন তৈরির মাধ্যমে উত্তর লেখার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষক ভালভাবে বিষয়বস্তু শিক্ষার্থীর কাছে তুলে ধরবেন। শিক্ষার্থীরা দলগত বা এককভাবে নানা প্রশ্ন তৈরি করে উত্তর তৈরি করবে। এ মানসিকতা নিয়ে শিক্ষার্থী বিষয়বস্তু হতে এক কথায়, রচনামূলক, বহুনির্বাচনী, শুদ্ধ ও অশুদ্ধ, খালিস্থান পূরণ, পাঠ্যবইয়ের শব্দ দিয়ে নতুন বাক্য তৈরি, কবিতা এলোমেলো করিয়ে সাজিয়ে লেখা, পদ বা চধৎঃং ড়ভ ংঢ়ববপয চিহ্নিত করাসহ বহুমুখী প্রশ্ন তৈরির মাধ্যমে তাদের মাঝে সৃজনশীল ভাবনা সৃষ্টি করা, যাতে সহজে তারা উত্তর বুঝে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে। শিক্ষক সহায়তাকারীর দায়িত্ব পালন করবেন। শিক্ষার্থীকে আগামীর সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তোলার জন্য নানা সদভ্যাসগুলো বিদ্যালয়ে অনুশীলন করাবেন। যেমন পরিষ্কার কাপড়চোপড় পরা, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, চোখ, দাঁত, নখ, চুলের যত্ন্ন নেয়া, যেখানে সেখানে ছেঁড়া কাগজ, ময়লা না ফেলা, সময়মত আগমন, প্রস্থান, সময়ের কাজ সময়মত করা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, ধর্মীয় অনুষ্ঠান আয়োজন, খেলাধূলার ব্যবস্থা রাখা। জ্ঞানকে বিকশিত করার লক্ষ্যে কবিতা, ছড়া, গল্প ও মহাপুরুষদের জীবনী পড়ার অভ্যাস তৈরি করা। এ জন্য বিদ্যালয়ে পাঠাগারের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। ভাল কাজ করার জন্য প্রণোদনা, বিদ্যালয়ে বাগান করা, নানা কো-কারিকুলাম কার্যক্রমে প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করে বিদ্যালয়কে শিক্ষার্থীদের স্বর্গ হিসেবে রূপান্তরিত করা। তা হলে আগামী প্রজন্ম সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে বাধ্য।  
 
বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সহযোগিতায় গরিব, অসহায়দের খাদ্য ও পোশাকসহ শিক্ষোপকরণের ব্যবস্থা করলে পরবর্তীতে তাদের মাঝে দরিদ্র ও অসহায়দের প্রতি ভালবাসা জাগ্রত হবে। শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে দরিদ্র শিক্ষার্থীর অভাব মোচন হলে বিদ্যালয় হবে বৈষম্যহীন শিক্ষাবান্ধব প্রতিষ্ঠান। শিক্ষাব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকে রচনা, অনুচ্ছেদ বা প্যারাগ্রাফ লেখা বিষয়টি পরীক্ষা প্রশ্নপত্রে দেয়া হয়ে থাকে। উক্ত বিষয়ে আমরা সাধারণত বই থেকে মুখস্থ করে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, পরীক্ষায় খাতায় বমি করার মত ঢেলে দেই।  যাদের বিষয়টি কমন পড়েনি বা মুখস্থ করা সম্ভব হয়নি, তাদের ভাগ্যে শুণ্য নাম্বার মিলে। জ্ঞান অর্জনমুখি শিক্ষায় শিক্ষার্থীকে আনতে হলে পরিবেশকেন্দ্রিক বা বাস্তব জিনিস দেখে শিক্ষার্থী আপন মনে লিখবে বা বলবে। সাধারণত শিশু শিক্ষার্থীদেও ওপর থেকে সূচনা, উপসংহার নাম শিরোনাম বাদ দিতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষক গুরুত্বপূর্ণ বাদ পড়া লাইন বা বিষয় সংযুক্ত করার কাজে সহযোগিতা করবেন নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে কতিপয় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাস্তবায়নে কতিপয় সুপারিশ উপস্থাপন করছি: - 
 
১. শিক্ষকসঙ্কট জিরো টলারেন্সে নামিয়ে আনতে হবে। এ জন্য প্যানেল ব্যবস্থার বিকল্প নেই। শিক্ষক সঙ্কটে শিক্ষাক্রম ব্যাহত হলে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বের অবহেলার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে।  
 
২. প্রাথমিকে শিক্ষাবান্ধব ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে হবে। এই জন্য প্রাথমিক শিক্ষায় ক্যাডার সার্ভিস সৃষ্টি করে সহকারী শিক্ষক থেকে শতভাগ পদোন্নতির সুযোগ দিতে হবে। প্রাথমিকে সর্বস্তরের শতভাগ পদোন্নতি ছাড়া শিক্ষাবান্ধব প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন করা শুধুই স্বপ্ন। প্রাথমিক শিক্ষাসম্পর্কিত অভিজ্ঞতাবিহীন কর্মকর্তাদের ইচ্ছা থাকলেও প্রাথমিক শিক্ষার কাক্সিক্ষত উন্নয়ন সম্ভব নয়। 
 
৩. কিন্ডারগার্টেন বা বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহজ শর্তে রেজিস্ট্রেশনের আওতায় এনে শিশুশিক্ষায় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা উচিত। শিশুশিক্ষায় বৈষম্য রেখে নতুন, মুখস্থবিহীন ও আনন্দময় শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন দুরূহ। 
৪. প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতনভাতাসহ সুযোগ-সুবিধার বৈষম্য দূর করে শিক্ষকদের জবাদিহির আওতায় এনে পুরস্কার ও শাস্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে। 
 
৫. শিক্ষক, ম্যানেজিং কমিটি, কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিষয়ে প্রমাণ পেলে তাদের বরখাস্ত করে প্রাথমিক শিক্ষাকে দুর্নীতিমুক্ত করা প্রয়োজন। সকলকেই এই ভাবনা নিয়ে কাজ করতে হবে। শিক্ষকসহ মন্ত্রী পর্যন্ত সকলের মধ্যমণি আগামী প্রজন্ম। সকলেই শিক্ষার্থী লেখাপড়ার জন্য তাদের পদবী মোতাবেক দায়ী। সাধারণত মন্ত্রী, সচিব, ডিজিদের শিক্ষক সঙ্কট, শিক্ষকদের পাওনা নিয়ে গড়িমসি, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সময়ক্ষেপণ করা ইত্যাদিই দায়ী এ ক্ষেত্রে। এভাবে শিক্ষকসহ কর্মকর্তারা সকলে তাদের কর্মের জন্য দায়ী। 
 
কর্মক্ষেত্রে শিক্ষক বা কর্মকর্তাদের কারোই ধমক, রাগারাগি, এক কথায় দারোগাগিরি দেখানোর সুযোগ নেই। প্রাথমিকে সকলে এক কথায় শিক্ষার্থীর সেবক। 
 
শিশুশিক্ষা আজও নানা বৈষম্যের মাঝে ঘুরপাাক খাচ্ছে। দুর্নীতির সুযোগ না দেওয়ায় গোপালগঞ্জের শিক্ষক মনোজ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ও সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারের লাথি, ঘুষি খেয়ে সাময়িক বরখাস্তের শিকার। অথচ দুর্নীতির চাদরে ঢাকা কতিপয় নেতা আজ নীরব নিস্তব্ধ। তাদের বিচারও আজ কাম্য। ভাবখানা এমন, তাদের দুর্নীতির সহচর গোপালগঞ্জের ডিপিইও ও সহকারী কর্মকর্তা নিয়ে তারা আজ মর্মাহত। 
 
মো. সিদ্দিকুর রহমান: সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ

পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0024049282073975