আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে গড়ে উঠুক বিশ্ববিদ্যালয়

মো. শফিকুল ইসলাম |

বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে উচ্চ বিদ্যাপীঠ। দেশে পাবলিক ও প্রাইভেট নিয়ে প্রায় ১৫৭টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। কিছুদিন ধরেই বিভিন্ন সংস্থার প্রকাশিত বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় টপ ৫০০ তালিকার মধ্যে নেই। এটা নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে।

সমালোচনা হওয়াটাই স্বাভাবিক।

টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিং একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বজনীন কর্মক্ষমতা নির্ধারণের স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান। এই র‌্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুয়েট স্থান পেলেও তা খুবই তলানিতে রয়েছে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এসব মানদণ্ডে কোনো জায়গা পায়নি। তাই এটা আমাদের জন্য হতাশাজনক। কেন আমাদের কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেল না। এটা খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। যেখানে আমাদের চেয়ে অর্থনীতিতে এবং অন্যান্য অনেক সূচকে পিছিয়ে রয়েছে, ওই সব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম টপ ৫০০-৬০০ তালিকার মধ্যে রয়েছে। শুক্রবার  (০৪ মার্চ) কালের কন্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে এ আরও জানা যায়, এই র‌্যাংকিংয়ে যে বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়, তার মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গড় অনুপাতের ন্যূনতম মানদণ্ড ধরা হয় ১ : ২০। অর্থাৎ প্রতি ২০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন করে শিক্ষক থাকতে হবে। কিন্তু দেশের ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬টিই এই অনুপাতের ধারেকাছে নেই। এ ছাড়া দেশের ৫৮টি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এই মানদণ্ড বজায় রাখতে পারেনি। মানদণ্ডে এমনও বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যেখানে ৫৪ শিক্ষার্থীর জন্য একজন শিক্ষক রয়েছেন। এটা খুবই দুঃখজনক। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) কর্তৃক প্রকাশিত ৪৭তম বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে, যা খুবই অপ্রত্যাশিত।  

এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে নেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। শিক্ষা গবেষকরা বলছেন, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যাচাই-বাছাই ছাড়াই একের পর এক খোলা হচ্ছে নতুন বিভাগ। বাড়ানো হচ্ছে আসন সংখ্যা। এ কারণে এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে। যেমন—আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নতুন বিভাগ খোলা হয়েছে, যে বিভাগে কোনো জনবল নেই। এ নিয়ে বর্তমান উপাচার্য একটু বিব্রত। কারণ তিনি যোগদানের আগে এই বিভাগের ভর্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। এই বিভাগে একজন শিক্ষকও নেই। যেকোনো নতুন বিভাগ চালু করতে হলে অবকাঠামোসহ অন্যান্য জনবল যেমন—শিক্ষক ও সাপোর্টিং স্টাফ নিশ্চিত করতে হবে। তাই এই দায়িত্ব যেমন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের।

মানসম্মত অনুপাত নিশ্চিত করতে পারেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বেসরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এই মানদণ্ডে পিছিয়ে রয়েছে। শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে হলে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত মেনে চলতে হবে। যাচাই-বাছাই ছাড়া নতুন বিভাগ খোলার অনুমোদন দেওয়া যাবে না। এমনকি আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করা যাবে না। তাহলে এই ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হবে না। তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেন নতুন কোনো বিভাগ জনবল ছাড়া আর না খুলতে পারে, সেই বিষয়ে ইউজিসিকে কঠোর হতে হবে। কোনো বিভাগ অনুমোদন দেওয়ার আগে এই বিষয়টি যেন ইউজিসি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। শিক্ষক কতজন আছেন এবং অবকাঠামোগত শিক্ষার্থীর ধারণক্ষমতা কতটুকু আছে; সেই ধারণক্ষমতা অনুসারে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন বিভাগ খোলার সময় দেখতে হবে, বিষয়টির কতটুকু বর্তমান কর্মবাজারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ এবং জব মার্কেটে এর চাহিদা আছে কি না, সে বিষয়ে ইউজিসিকে অধিকতর সতর্ক থাকতে হবে। ঢালাওভাবে নতুন নতুন বিভাগ এবং বিশ্ববিদ্যালয় না খোলাই ভালো। অর্থাৎ ইউজিসিকে এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষক পদ ছাড় করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ঠিক থাকে।

এতে যেমন শিক্ষার গুণগত মান বাড়বে, তেমনি শিক্ষার্থীরা তাদের সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ঠিক রাখতে হবে। কারণ একজন শিক্ষককে যদি এক দিনে চার-পাঁচ ঘণ্টা করে ক্লাস নিতে হয়, তাহলে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত না করতে পারলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে শিক্ষার উন্নয়নের বিকল্প নেই। যদিও সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে, তবু আরো বেশি গবেষণায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে গবেষণা বাড়াতে হবে। কৃষিতে গবেষণা হচ্ছে বিধায় আমরা অনেক সবজি ও ফল সারা বছর পেয়ে থাকি, যা অতীতে ছিল না। এটা আমাদের জন্য অবশ্যই ইতিবাচক।  

তবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতের এই অবস্থার জন্য ইউজিসির দুর্বল মনিটরিং রয়েছে বলে মনে করি। সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়সহ ইউজিসি আন্তরিক হলেই এই সমস্যা আর থাকবে না। ইউজিসি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আরো বেশি গবেষণা, শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং অন্যান্য ফ্যাক্টরকে গুরুত্ব দিতে হবে, যা বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিংয়ে বিবেচনা করা হয়। তাহলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিং এবং অন্যান্য গ্লোবাল র‌্যাংকিংয়ে স্থান পাবে। এ ছাড়া আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিংয়ে স্থান করে নিতে পারে, সে জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিংয়ে স্থান পেতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই।

জব মার্কেট এবং সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গ্লোবাল ভিলেজে তাল মিলিয়ে চলতে শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিক মানের গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষার্থীদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চাহিদা তৈরি করতে বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিংয়ে স্থান পাওয়া একান্ত প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা স্থান করে নিতে পারলে এবং তাঁরা চাকরি করার সুযোগ পেলে আমাদের শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা কমে আসবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ইতিবাচক ভাবনা ও সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যাতে শিক্ষার মানের উন্নতি করে এবং মানদণ্ড পূরণের মাধ্যমে বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায় স্থান করে নিতে পারলেই আমরা বিশ্বদরবারে আরো পরিচিতি লাভ করতে পারব।

শুধু শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ঠিক রাখলেই হবে না, নিয়োগ দিতে হবে যোগ্য ও মেধাবী আবেদনকারীকে শিক্ষক হিসেবে। নতুন নিয়ম হতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে হলে স্নাতক ও স্নাতকত্তোর ডিগ্রির সঙ্গে পিএইচডি ডিগ্রি থাকতে হবে। এর জন্য নতুন বেতন কাঠামো করতে হবে, তাহলে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহী বেশি হবেন বলে মনে করি।

 

লেখক : মো. শফিকুল ইসলাম, সাবেক সভাপতি, শিক্ষক সমিতি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন কলেজ পরিচালনা পর্ষদ থেকে ঘুষে অভিযুক্ত সাংবাদিককে বাদ দেওয়ার দাবি - dainik shiksha কলেজ পরিচালনা পর্ষদ থেকে ঘুষে অভিযুক্ত সাংবাদিককে বাদ দেওয়ার দাবি পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0051858425140381