আবেদনের যোগ্যতা নেই তবু শিক্ষক

দৈনিক শিক্ষাডটকম, বেরোবি |

শিক্ষক পদে আবেদন করার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতাও নেই। নানা কলাকৌশল কাজে লাগিয়ে শেষ পর্যন্ত রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি)  প্রভাষক পদে ঠিকই নিয়োগ বাগিয়ে নিয়েছেন। পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন সহকারী অধ্যাপকও। এই শিক্ষকের নাম মো. ইউসুফ। নিয়োগের ক্ষেত্রে তাকে অনৈতিক সুবিধা দেয়ার অভিযোগ উঠেছে তৎকালীন বাছাই ও নিয়োগ বোর্ড এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে। অবশ্য অভিযুক্ত শিক্ষকের দাবি, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে দেওয়া যোগ্যতা অনুযায়ী তিনি নিয়োগ পেয়েছেন। মো. ইউসুফের নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে বলে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মো. গোলাম রব্বানী।

২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক/সহকারী অধ্যাপকের (স্থায়ী) একটি পদের জন্য যে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়; তাতে শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়—এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার যে কোনো একটিতে ন্যূনতম ‘এ’ (৫.০০ পয়েন্টভিত্তিক গ্রেড সিস্টেমে সিজিপিএ বা জিপিএ ন্যূনতম ৪.০) থাকতে হবে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, অভিযুক্ত ইউসুফ এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় ‘বি’ গ্রেড পেয়েছেন। এর মধ্যে এসএসসির গণিতে সি এবং এইচএসসির ইংরেজিতে ডি গ্রেড পেয়ে পাস করেছেন টেনেটুনে। স্নাতকে উত্তীর্ণ হয়েছেন দ্বিতীয় শ্রেণিতে। এসএসসি ও এইচএসসির কোনোটিতেই জিপিএ ৪ পাননি ইউসুফ। এই দুই পরীক্ষায় তার জিপিএ যথাক্রমে ৩.৫০ এবং ৩.০১। অর্থাৎ বিজ্ঞপ্তির শর্তানুযায়ী, ওই পদে আবেদনের যোগ্যতাই ছিল না মো. ইউসুফের।

আইন অনুযায়ী বিভাগের এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষকের সমন্বয়ে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্ল্যানিং কমিটি গঠনের কথা থাকলেও তা না করেই ওই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়া বাছাই বোর্ডের সদস্যরাও যোগ্যতাহীন ইউসুফকেই নিয়োগের সুপারিশ করেছিলেন। শুধু তা-ই নয়; একটি পদের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলেও নিয়োগসংক্রান্ত বাছাই কমিটি ইউসুফ ছাড়া আরও দুজনকে নিয়োগের সুপারিশ করে।

কিন্তু ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ৪ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৬তম সিন্ডিকেট সভায় বাছাই বোর্ডের সুপারিশ পর্যালোচনা করা হয়। সিন্ডিকেট সদস্যরা বাছাই বোর্ডের সুপারিশে বেশ কিছু অসংগতি খুঁজে পান। প্রথমত, ইতিহাস ও প্রত্নতত্ব বিভাগীয় অধ্যাপক পদের কোনো অস্তিত্ব নেই। অথচ বাছাই বোর্ড তৃতীয় মনোনীত প্রার্থীকে অধ্যাপক পদের বিপরীতে নিয়োগ প্রদানের সুপারিশ করেছে। দ্বিতীয়ত, একটি প্রভাষকের পদ বিজ্ঞাপিত করে দুজন প্রার্থীকে নিয়োগ প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে। তৃতীয়ত, ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের বাছাই বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী তিনজন প্রার্থীকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দ্বিতীয় প্রার্থী মো. ইউসুফের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় ‘বি’ গ্রেড ও স্নাতক সম্মান পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণি থাকায় নিয়োগের জন্য উপযুক্ত বিবেচিত হতে পারে না। সিন্ডিকেট সভায় উপস্থিত সব সদস্যের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তক্রমে পদ পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের জন্য সৃষ্ট দুটি প্রভাষকের স্থায়ী পদে বাছাই বোর্ডের সুপারিশকৃত প্রথম ও তৃতীয় প্রার্থী যথাক্রমে মো. মনিরুজ্জামান ও মো. আকতারুল ইসলামকে নিয়োগ প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

সিন্ডিকেটে অযোগ্য ঘোষিত হওয়ার পরও কৌশল খুঁজতে থাকেন ইউসুফ। সহযোগিতা নেন তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান ইকবাল শাহ রুমি ও তৎকালীন ভিসি প্রফেসর একেএম নুর উন নবীর। তাদের সহযোগিতা নিয়ে ইউসুফ অবৈধ উপায়ে বাছাই বোর্ডের সুপারিশসহ তার নিয়োগ সংক্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তের গোপন সব নথি সংগ্রহ করে ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করেন। তবে কী কারণে সিন্ডিকেট তাকে অযোগ্য ঘোষণা করেছে সে বিষয়টি চেপে যান। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে আদালত ইউসুফের পক্ষে রায় দেন। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি ড. নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ ওই রায়ের বিপক্ষে আপিল না করায় ওই বছরই প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান ইউসুফ। 

ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. গোলাম রব্বানী বলেন, ইউসুফ রিট পিটিশন করলেও কেন তাকে বাদ দেয়া হয়েছে, তা তিনি আদালতকে অবগত করেননি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও এ বিষয়ে আদালতকে অবগত না করায় একতরফা রায় পান ইউসুফ। যারা এই নিয়োগের সঙ্গে সম্পৃক্ত, সবাই আইন অমান্য করেছেন। তাদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

অভিযুক্ত শিক্ষক ইউসুফ বলেন, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি শর্তাবলির ‘ঘ’-তে বলা হয়েছে ‘কোন পরীক্ষায় বি গ্রেড এর নিচে অথবা তৃতীয় বিভাগ/শ্রেণি গ্রহণযোগ্য হবে না। এই অনুযায়ী আমি আবেদনের যোগ্য। সেজন্যই আমাকে বাছাই বোর্ড সুপারিশ করেছে।’ বিজ্ঞপ্তিতে শর্তাবলির (গ) নং শর্তে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার যে কোনো একটিতে ন্যূনতম ‘এ’ এবং জিপিএ ন্যূনতম ৪.০ থাকতে হবে–এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘এটা সার্কুলারের দুর্বলতা। এর দায় আমার নয়।’

তিনি আরও বলেন, বাছাই বোর্ডের সুপারিশ সিদ্ধান্ত সিন্ডিকেট বাতিল করতে পারে না। সে কারণে আমি উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হই। আদালতের আদেশে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছি। আদালত পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. শওকাত আলী সাংবাদিকদের জানান, অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত কমিটি করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিষয়টি নিয়ে রেজিস্ট্রারের সঙ্গে আমি কথা বলব।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবি - dainik shiksha শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবি কারিগরি শিক্ষকদের অক্টোবর মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha কারিগরি শিক্ষকদের অক্টোবর মাসের এমপিওর চেক ছাড় সরকারি কর্মচারীদের ৯ দফা নির্দেশনা - dainik shiksha সরকারি কর্মচারীদের ৯ দফা নির্দেশনা স্কুল-কলেজে বেতন ছাড়া সব ফি বেঁধে দিলো সরকার - dainik shiksha স্কুল-কলেজে বেতন ছাড়া সব ফি বেঁধে দিলো সরকার সব শিক্ষকের স্বার্থ সংরক্ষণ করে বদলির নীতিমালা : সাক্ষাৎকারে শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha সব শিক্ষকের স্বার্থ সংরক্ষণ করে বদলির নীতিমালা : সাক্ষাৎকারে শিক্ষা উপদেষ্টা ঢাবিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রেখেই ভর্তি কার্যক্রম - dainik shiksha ঢাবিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রেখেই ভর্তি কার্যক্রম ক্যামব্রিয়ানের বাশারকে গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত - dainik shiksha ক্যামব্রিয়ানের বাশারকে গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: অষ্টম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি - dainik shiksha শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: অষ্টম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা কল্যাণের হবে না: ছাত্রদল সম্পাদক - dainik shiksha ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা কল্যাণের হবে না: ছাত্রদল সম্পাদক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028719902038574