আমরা আদর্শ ভুলে গেছি : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বৈশ্বিক মহামারি করোনাদুর্যোগ শুধু যে সামাজিক দূরত্বই বাড়িয়েছে, তা নয়; অনেক ক্ষেত্রে মানসিক দূরত্বও বাড়িয়েছে। এই দুর্যোগ নানাদিকে স্থবিরতা সৃষ্টি করেছে। রাজনীতিও এর বাইরে নয়। তবে আমাদের দেশে এরই মধ্যে রাজনীতির কিছু চিত্র ফের প্রশ্ন তুলেছে। আমাদের রাজনীতির যেমন অর্জন আছে অনেক; একই সঙ্গে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে অনেক অর্জনের বিসর্জনও ঘটেছে। হীনস্বার্থবাদীরা রাজনীতির নামে অপরাজনীতির বিস্তার ঘটিয়েছেন। ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির আপদ-বিপদ দুই-ই আমরা দেখেছি। স্বাধীনতার আগে; স্বাধীনতার পরেও দেখেছি, যা ছিল একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত-অনভিপ্রেত। একাত্তরে জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের হিংস্রতা আমরা দেখেছিলাম। স্বাধীন দেশে ঘাপটি মেরে ছিল ওরা অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে। ক্রমে ক্রমে সে অবস্থা কাটিয়ে উঠে রাজনীতিতেই তাদের শুধু সক্রিয় অংশগ্রহণ বাড়ল না; শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতারও অংশীদার হলো। বিলম্বে হলেও যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতা অনেকেরই বিচার হলো। চূড়ান্ত দণ্ডও কার্যকর হলো। বিচার এখনও চলমান। তারা কীভাবে ফের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে ক্ষমতার অংশীদার হয়েছিল এবং লক লক করে বেড়ে উঠেছিল, তা সচেতন মানুষমাত্রেরই জানা। শুক্রবার (০৭ মে) সমকাল পত্রিকার এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে  আরও জানা যায়, অবস্থার কারণে এখন ওরা অনেকটা কোণঠাসা। রাজনীতিতে কতটা উপস্থিত, তাও ঠিক টের পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু তারা যে মোটেও নিষ্ফ্ক্রিয় নয়, তা তো বোঝাই যায়। সম্প্রতি নানা কারণে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুব আলোচিত। সংবাদমাধ্যমেই জানা গেল, হেফাজত কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত। এর মধ্যে একটি গ্রুপের ওপর জামায়াতের ছায়া আছে। হেফাজতও এখন বেশ বেকায়দায় পড়েছে নিজেদের কারণে। তাদের এক গ্রুপ কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে; আবার আরেক গ্রুপ পাল্টা কমিটি ঘোষণার হুঙ্কারও দিয়েছিল। ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির উত্থান কিংবা এ নিয়ে নানা কৌশলের খেলা বড় ডানপন্থি দলগুলোই করে আসছে নিজেদের স্বার্থে। বলা ভালো, ভোটের রাজনীতির লক্ষ্যে। স্বাধীনতাউত্তর আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের রাজনীতির মেরুকরণের যত সমীকরণ হয়েছে কিংবা হচ্ছে, সবই নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে।

বলা যায়, এর ফলে সুস্থ ধারার রাজনীতির পথটা একদিকে ক্রমেই কণ্টকাকীর্ণ হচ্ছে, অন্যদিকে গণতন্ত্র পড়েছে হুমকির মুখে। গণতন্ত্র বলতে নানা মত আছে। কেউ ভাবেন, গণতন্ত্র হচ্ছে নির্বাচিক সরকার। আবার কেউ বলেন, মোটেও তা নয়। গণতন্ত্র অনেক বড় ব্যাপার। এ হচ্ছে একটা পরিপূর্ণ সংস্কৃতি। সংজ্ঞা নিয়ে মতবিরোধ যতই থাকুক, গণতন্ত্র যে পরিচিত শাসন ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম- এ নিয়ে তেমন একটা দ্বিমত নেই। সর্বোত্তম কেন- তাও আমরা জানি। কারণটা হচ্ছে এই, গণতন্ত্র ব্যক্তিকে মর্যাদা দেয়। কেবল মর্যাদা দেয় না; ব্যক্তির অধকিার, তার স্বার্থ, বিকাশ এসব বিবেচনায় একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে রাখে। ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির দ্বন্দ্বটাও খুব স্বাভাবিক। গণতন্ত্র সবার স্বার্থ দেখতে চায় এবং ব্যক্তির স্বার্থকে মেলাতে চায় সমষ্টির স্বার্থের সঙ্গে। অর্থাৎ এমন একটা ব্যবস্থা চায়, যেখানে ক্ষমতা বিশেষ কোনো কেন্দ্রে কুক্ষিগত থাকবে না। ছড়িয়ে থাকবে সামাজের সর্বত্র। রাষ্ট্র শাসন করবেন জনপ্রতিনিধিরা। এখানেই আসে নির্বাচনের ব্যাপার। জনপ্রতিনিধরা নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনকে এতটাই গুরুত্ব দেওয়া হয়, অনেকে ধারণা করেন, যেখানে নির্বাচন আছে সেখানেই গণতন্ত্র রয়েছে। কিন্তু তা যে সর্বাংশে সত্য নয়- আমরা নিজ দেশে অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই জেনেছি।

গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথ যে মোটেও মসৃণ নয়, বরং অনেকটাই এবড়োখেবড়ো এবং বিঘ্নসংকুল, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা দেখেছি, গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক অধিকার ও রাজনীতির নামে তথাকথিত আন্দোলনের ফলে মানুষকে কতটা বিপদসংকুল অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। এসব ঘটনা দূর অতীতের নয়। আবার অনেকেই গণতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন করতে গিয়ে, কথা বলতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েছে; হামলা-মামলার শিকার হয়েছে। বলা ভালো ও সঙ্গত যে, গণতন্ত্রের পথে বাধা একটা নয়, অনেক। এর মধ্যে অন্যতম পরমতসহিষ্ণুতার অভাব। অথচ পরমতসহিষ্ণুতা গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্ত। তেমনি স্বেচ্ছাচারিতা গণতন্ত্রের অন্যতম শত্রু। অন্যসব বিঘ্নের কথা না হয় বাদই দিলাম; তাদের অধিকাংশই অত্যন্ত গভীর ও দুরপনেয়। খুবই সহজ যে ব্যাপার অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, এ নিয়েই তো বিস্তর প্রশ্ন। আর এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই রাজনীতির মেরুকরণের যত সমীকরণ; যে সমীকরণ ডেকে আনছে অনেক আপদ-বিপদ। জামায়াতই বলি আর হেফাজতই বলি, এসবের উত্থান এই সমীকরণের কারণেই।

আরও পরিস্কার করে বলা দরকার। না, নির্বাচন মানেই যে গণতন্ত্র, নির্বাচিত সরকার মানেই যে গণতান্ত্রিক- এমন কথা বলা যাবে না, বলার উপায়ও নেই। হ্যাঁ, গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচন দরকার। কিন্তু নির্বাচনের আভা দেখেই গণতান্ত্রিক সূর্যোদয়ের প্রত্যাশা করা মোটেই বাস্তবসম্মত নয়। গণতন্ত্রের জন্য আরও অনেক কিছু দরকার। গণতন্ত্রের জন্য অনেক কিছু চাই। কিন্তু অন্য সবই হচ্ছে অঙ্গ-প্রতঙ্গ। গণতন্ত্রের প্রাণ থাকে এক জায়গাতেই, আর সেটা হলো সাম্য। সাম্য যেখানে যত কম, গণতন্ত্রের পথঘাট সেখানে তত বিপদসংকুল। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বলতে যা বুঝি তাতে বহু ও নানাবিধ উপাদান থাকা আবশ্যক। কিন্তু ওটাই মেরুদণ্ড, যেটা না থাকলে অন্য সবকিছু ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে বাধ্য, তা যেমনভাবেই তাদের জড়ো করা এবং সাজানো হোক না কেন। বাংলাদেশে নানা সমস্যা বিদ্যমান। দুর্নীতি, দারিদ্র্য, সন্ত্রাস; বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের অভাব- এ সবকিছুই বড় সমস্যা। এর মধ্যে করোনাদুর্যোগ নানা খাতে আরও ব্যাপক বিরূপ অভিঘাত ফেলেছে।

রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা অর্জন করার ব্যাপারটা সামান্য ছিল না। অনেক প্রাণ দিতে হয়েছে; দুর্ভোগ যা সহ্য করতে হয়েছে, তা অপরিমেয়। যেসব অন্ধকারের শক্তিকে পরাভূত করে এই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল; অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে কারও কারও হীনস্বার্থে সেই শক্তিই আবার জেঁকে বসতে শুরু করল। আমরা যেসব লক্ষ্য সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম; বিপুল ত্যাগে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম; সেই বাংলাদেশ কি আমরা গঠন করতে পেরেছি? ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির পথ কি রুদ্ধ করা গেছে? সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প আজও ছড়ায় রাষ্ট্র-সমাজে। বৈষম্য আজও জিইয়ে আছে। শুধু তা নয়, উপরন্তু ক্রমেই তা বাড়ছে। জনগণের ক্ষমতায়ন আজও হয়নি। বাংলাদেশের বামপন্থিরা জনগণকে সঙ্গে নিতে পারেননি। যে জন্য তারা শক্তিশালী হননি। জনগণের আস্থা তাদের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হয়নি। তাদের এই ব্যর্থতার কারণ জনগণের মেজাজ, ভাষা, কল্পনা তারা আত্মস্থ করতে পারেননি এবং একই সঙ্গে জনগণের কখন কার প্রধান দ্বন্দ্ব, সেটা অনুধাবনেও তারা অপারগ। এরও সুযোগ নিয়েছে ধর্মান্ধরা।

জনগণ সংগ্রাম করেছে কিন্তু মুক্তি পায়নি। জনকল্যাণের রাজনীতি ভেসে গেছে হীনস্বার্থের অপরাজনীতির স্রোতে। অর্থাৎ জনকল্যাণের রাজনীতি নির্বাসিত। দৃশ্যত সবাই গণতান্ত্রিক। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কে কতটা গণতন্ত্রের সংজ্ঞাসূত্র মানেন- এর উত্তর নিহিত বিদ্যমান রাজনৈতিক হালচালের মধ্যেই। আমরা আদর্শ ভুলেছি এবং আমাদের আদর্শ ভুলতে প্ররোচনাও দেওয়া হয়েছে। এখন বাঁচার উপায় হচ্ছে, প্রগতিশীল সব শক্তির ঐক্যবদ্ধ হওয়া। মুক্তির যে আকাঙ্ক্ষা আমাদের পরিচালিত করেছিল একাত্তরে, সেই আদর্শবাদকে নিজেদের মধ্যে পুনরুজ্জীবিত করতেই হবে নির্মোহভাবে। নিজের স্বার্থেই সবার স্বার্থকে দেখতে হবে। দাঁড়ানোর জায়গা না থাকলে আমরা কেউ দাঁড়াতে পারব না; সমৃদ্ধি ও সম্মান অর্জনের তো প্রশ্নই ওঠে না।

লেখক: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী,শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্নেষক ,


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0035891532897949