নিজের বাসভবনে দেশীয় ভেষজ নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে জগৎখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় (পিসি রায়) গবেষণাকর্ম শুরু করেন। তিনি শুধু বিজ্ঞানীই ছিলেন না একাধারে ছিলেন শিল্পোদ্যোক্তা, সমাজ সংস্কারক, বিজ্ঞানশিক্ষক, দার্শনিক, কবি, শিক্ষানুরাগী, ব্যবসায়ী ও বিপ্লবী দেশপ্রেমিক। দেশের মানুষের কল্যাণে তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। তিনি নিজ জেলা শহর খুলনার মানুষের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ‘এপিসি কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি’ ও ‘এপিসি টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড’। এপিসি টেক্সটাইল মিলস পরবর্তীতে হয়েছে বিখ্যাত খুলনা টেক্সটাইল মিলস। তার হাতে তৎকালীন সময়ে এদেশে বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। তৎকালীন সময়ে এমন কোনো সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ছিলো না, যে প্রতিষ্ঠানে তিনি অনুদান দেননি। অথচ জগৎখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের (পিসি রায়) জন্মস্থান ও স্মৃতিবিজরিত গুরুত্বপূর্ণ স্থানটি অযত্ম-অবহেলায় পড়ে আছে। তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলাধীন রাড়ুলী গ্রামে ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন ‘ফাদার অব নাইট্রাইট’ খ্যাত এই বিজ্ঞানী। তিনি স্থানীয় জমিদার হরিশচন্দ্র রায় ও ভুবনমোহিনী দেবীর পুত্র। ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পিতার নামে আর কে বি কে হরিশচন্দ্র স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে বাগেরহাটের স্বনামধন্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান পিসি রায় কলেজের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। রাড়ুলী গ্রামে অবস্থিত তার বাড়িটি স্থানীয়দের কাছে এখন ‘জমিদার বাড়ি’ নামে খ্যাত। তিনি ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুন, ৮৩ বছর বয়সে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
পিসি রায় ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে এফএ পাস করেন। ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে বিএসসি এবং ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে রসায়নশাস্ত্রে ডিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রফুল্ল চন্দ্র রায় স্বদেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা ও গবেষণা কাজ শুরু করেন। তিনি আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর সহকর্মী ছিলেন। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বেঙ্গল কেমিক্যালেরও প্রতিষ্ঠাতা। ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মারকিউরাস নাইট্রাস (HgNO2) আবিষ্কার করেন। যা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিখ্যাত বিজ্ঞানী মেঘনাথ সাহাসহ অনেক বিখ্যাতজনের তিনি শিক্ষক ছিলেন। অতি সাধারণ জীবনযাপন করে গেছেন বিশ^বরেণ্য এই বিজ্ঞানী। তিনি নিজের কাজ নিজে করতেন, অন্যকে দিয়ে কাজ করাকে তেমন পছন্দ করতেন না। নিজের পোশাক ও জুতা নিজেই পরিষ্কার করতেন। তার জীবনী থেকে জানা যায়, তিনি খাদ্যাভাস ও অভ্যাসকে নিয়ন্ত্রণ করে চলতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীর জন্য শুধু ব্যাচেলর অব সায়েন্স ও মাস্টার্স অব সায়েন্স পর্যাপ্ত নয়। পর্যাপ্ত গবেষণার মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন করাই হলো প্রধান কাজ। সত্যিকারের জ্ঞান অর্জনকে তিনি প্রাধান্য দিয়ে গেছেন। তিনি মনে করতেন, শুধুমাত্র ডিগ্রি নেয়াটা হচ্ছে চাকরির জন্য ব্যয় করা। তিনি প্রয়োগিক জ্ঞান অর্জনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়, মহীশুর বিশ্ববিদ্যালয়, বেনারস বিশ^বিদ্যালয়, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ও এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মাসসূচক ‘ডক্টরেট’ ডিগ্রি লাভ করেন। এছাড়া মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক বিশেষ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। চিরকুমার এই বিজ্ঞানী তার অর্জিত সমস্ত সম্পত্তি মানবকল্যাণে দান করে গেছেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, বিখ্যাত এই রসায়ন বিজ্ঞানীকে বাংলাদেশ কিংবা ভারত কোনো দেশই তেমন মূল্যায়ন করেনি! এমনকি এখনো সুযোগ থাকলেও তার আদর্শ ও কাজকে কোনো দেশই স্মরণ করে না। আর তা যদি করতো তাহলে অন্তত তার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে জাতীয়ভাবে স্মরণ করা হতো। এমন বিশ্ববরেণ্য রসায়ন বিজ্ঞানী ও বহু গুণের অধিকারী ব্যক্তির জীবনাদর্শ ও কর্মকে স্মরণ না করে জাতি হিসেবে আমরা মূর্খতার পরিচয় দিচ্ছি না তো! তিনি বিজ্ঞানের উচ্চতর গবেষণা, বিজ্ঞানমনষ্ক জাতি গঠন ও মাতৃভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন।
শিক্ষকতার জন্য তিনি ‘আচার্য’ খ্যাতি লাভ করেন। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ‘নাইট উপাধি’ লাভ করেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এই বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীর জন্মভিটা ও স্মৃতিবিজরিত ভবনগুলো যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। বসতভিটার দুটি অংশ। একটি সদর মহল, অন্যটি অন্দর মহল। ইতোমধ্যে অন্দর মহলের একপাশ ভেঙ্গে পড়েছে। ভবনটির দুইপাশে রয়েছে দুটি দৃষ্টিনন্দন পুকুর। এই বসতভিটা মূলত ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। ১৭ বিঘা জমির ওপর অবস্থিত এই বাড়িটির জরাজীর্ণ অন্দরমহলের আঁতুরঘরে জন্মেছিলেন জগতখ্যাত বিজ্ঞানী পি সি রায়। স্মৃতিবিজড়িত ভবনের ইট-সুড়কি, পলেস্তারা খসে পড়েছে। জরাজীর্ণ ভবনের চারপাশ নির্জন-জনমানবহীন ও লতাপাতায় ভরপুর। বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে যে, দিনের বেলা কেউ একা একা এই ভবনে প্রবেশ করতেও ভয় পায়। পরিত্যক্ত এই বাড়িটি বিভিন্ন প্রভাবশালী গোষ্ঠী দ্বারা কয়েকবার দখল ও লুটপাট করার চেষ্টা করা হয়েছে।
অবশেষে বাড়িটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ‘সংরক্ষিত পুরাকীর্তি’ হিসেবে ঘোষণা করে দায় শেষ করলেও বাড়িটি রেহাই পাচ্ছে না। বখাটেরা বাড়িটিতে আড্ডা জমায়। দুঃখের বিষয়, বাড়িটির সঠিক রক্ষণাবেক্ষণে যেনো কারোরই দায় নেই। অথচ বাড়িটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হলে সরকার যেমন রাজস্ব পাবে তেমনি বাড়িটিও রক্ষা পাবে। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি পাইকগাছার সেরা পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে উঠলে সবার কাছে প্রিয় স্থান হয়ে উঠবে এটি। অনেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে পিসি রায়ের জমিদার বাড়িটি দেখতে আসেন। ঘুরে ঘুরে দেখেন জমিদার বাড়িটির অন্দর-বন্দর। কিন্তু বাড়ির সেই ঐতিহ্য ও জৌলুস না থাকায় উষ্মা প্রকাশ করেন। রাড়ুলী ইউনিয়নটি বিখ্যাত হয়ে আছে এই জমিদার বাড়িটির জন্য। বাড়িটির ভবনগুলো সংস্কার করে সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ঘিরে জাদুঘর, গবেষণাগার ও আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সময়ের দাবি। এছাড়া আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের আদর্শ ও কর্ম ছড়িয়ে দিতে তার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী জাতীয়ভাবে পালন করা অত্যন্ত জরুরি। দায়সারাভাবে নয়, বিখ্যাত এই স্থানটি রক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সরকারের উচ্চমহল থেকে এখনই এগিয়ে আসা হোক।
লেখক: শিক্ষক