সংবিধান, সংসদ ও আইন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক প্রয়াত মিজানুর রহমান খান বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আইন ও বেশ কিছু আলোচিত রায়ের যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করেছেন। যুক্তিসিদ্ধ সমালোচনায় করেছেন ‘বিতর্কিত’ বলে বিবেচিত অনেক রায়ের চুলচেরা সুলুক সন্ধান। এই লেখা তেমনই একটি কালজয়ী বিশ্লেষণ। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের আগস্টে প্রকাশিত হলেও এখনও গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক। বিরুদ্ধ সেই সময়ে দৈনিক আমাদের দেশ পত্রিকার দণ্ডিত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের রায়কে সংবাদপত্রের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো একমাত্র সাংবাদিক ছিলেন মিজানুর রহমান খান। সময়ের উপযোগিতা বিবেচনায় অনুসন্ধানী পাঠকদের জন্য লেখাটি পুন:প্রকাশ করা হলো-
অনেক প্রশ্ন ভিড় করল। ‘চেম্বার মানেই সরকার পক্ষে স্টে’। আপিল বিভাগের অবমাননার জন্য অভিযুক্ত আমার দেশ প্রতিবেদনের এটুকুই শিরোনাম ছিল না। এর সঙ্গে আছে, ‘মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে স্থগিত করা হলো হাইকোর্টের রায়’। খুব আশা করেছিলাম আপিল বিভাগের শুনানিতে সত্য-মিথ্যা যাচাই হবে। এমনকি বাকস্বাধীনতার সীমারেখা হতে পারত এই শুনানির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক। সেটাও হলো না। তবে এটা অনস্বীকার্য যে, শিরোনাম দারুণভাবে অবমাননাকর। ‘অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তরের চাহিদা অনুযায়ী বিচার’ নিশ্চয়ই দায়িত্বশীল কথা নয়।
তবে আমাদের অস্বস্তি আমার দেশ-এর তর্কিত প্রতিবেদনের সত্য-মিথ্যা যাচাই হওয়ার বিষয়টি। লেখক হিসেবে সেই আশায় ছিলাম। আদালত অবমাননা নানাভাবে ঘটতে পারে। শুধু যে বিচারক বা আইনজীবীরাই আদালতের ভাবমূর্তি রক্ষার অতন্দ্রপ্রহরী, তা তো নয়। কারণ, কোনো বিচারকের ব্যক্তিগত সুনামহানি থেকে রক্ষা করার জন্য আদালতকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। আদালত অবমাননার সঙ্গে বাকস্বাধীনতা ও মৌলিক মানবাধিকারের একটা চিরকালীন দ্বন্দ্ব আছে। আমরা দুর্ভাগা। আমরা কতটা কী লিখতে পারি বা পারি না, তা সংসদ বা আদালত কেউ আমাদের ঠিক করে দিলেন না।
আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় এলে এ বিষয়ে একটি পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যাবে, এমন আশা আমরা করি। এবং তখন এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ মতামত দেওয়া যাবে। আদালত যখন বলেন যে তাঁর রায়ের সমালোচনা চলবে, তখন আমরা ভাবি, কত তাড়াতাড়ি আমরা পূর্ণাঙ্গ রায় পাব। আদালত বা সংসদ কেউ তো আমাদের বলে দেন না যে, যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধটা কী। এ বিষয়ে ভারতের বিস্তারিত আইন আছে। তদুপরি কিসে আদালত অবমাননা হয় না, তার একটি নীতিমালাও ভারতের সুপ্রিম কোর্ট করে দিয়েছেন। পাকিস্তানের আইন দেখেও ঈর্ষা হয়। সেটাও যথেষ্ট বিস্তারিত। মিথ্যা ও বিকৃত তথ্য ছাপলেই আদালত অবমাননা হবে না, প্রমাণিত হতে হবে যে উদ্দেশ্যটা বিদ্বেষপ্রসূত ছিল কি না। পাকিস্তান এত দূর গেলে আমরা পারি না কেন? আমরা অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াই। ২০০৮ সালের আদালত অবমাননা আইন বাতিল হয় হাইকোর্টে। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক রায় দেন, ‘কোন কোন ক্ষেত্রে বা কী পরিস্থিতিতে আদালত অবমাননা হইবে না বা হইবে, তাহা নির্ধারণ করিবার দায়িত্ব আদালতের। ইহা কোন অধ্যাদেশ দ্বারা সম্পূর্ণভাবে নির্ধারণ করা যায় না।’
আজকের লেখায় আমি অবশ্য এ-সংক্রান্ত আইনগত ফাঁকফোকর ও দণ্ড প্রদানের দিকটি পর্যালোচনা করতে চাইব। আমরা এত দিন জেনে এসেছি যে আদালত অবমাননার জন্য ছয় মাসের জেল আর দুই হাজার টাকা জরিমানার বিধান আছে। এবার আমরা সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম। সে কারণেই এই আলোচনা।
বর্তমানে রাজরোষে থাকা মাহমুদুর রহমান সংবাদপত্র আর প্রচারপত্রের সীমারেখা মানতে উদগ্রীব, তার প্রমাণ পাই না। তবে সে ভিন্ন প্রসঙ্গ।
আমরা জানতাম, ১৯২৬ সালের একটা আদালত অবমাননা আইন আছে। এতে সর্বোচ্চ ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড কিংবা দুই হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয়বিধ সাজা দেওয়া যাবে। তাহলে প্রথম খটকা হলো, তাঁর ছয় মাস জেল হলো। এক লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক মাসের জেল হলো। অন্য আরও দুজনের ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা হলো। কিন্তু কী করে?
সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তাফা কামাল আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। আদালত অবমাননা বিষয়ে তাঁর তৈরি করা ১৩ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন আছে। সেটা পড়ে আমরা নিশ্চিত জানলাম, ১৯২৬ সালের আইনটি শুধু হাইকোর্ট বিভাগের জন্য প্রযোজ্য, আপিল বিভাগের জন্য নয়। আপিল বিভাগ তাহলে কোন আইনের কোন ধারার আওতায় সাজা দিলেন? এর ভিত্তি কী? অ্যাটর্নি জেনারেল মাহ্বুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপিল বিভাগের বিধিমালা ও সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে আদালত দোষী সাব্যস্ত করে সাজার রায় দিয়েছেন।’ ১৯ আগস্ট আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত আদেশে দেখলাম, ১০৮ অনুচ্ছেদের কথা আছে। সেখানে ১৯২৬ সালের আইনের উল্লেখ নেই। তবে আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত আদেশেই তথ্য পেলাম, সাজার ব্যাপারে প্রধান বিচারপতিসহ ছয় বিচারপতি একমত হয়েছেন। কিন্তু সাজার মেয়াদ প্রশ্নে রায় বিভক্ত হয়েছে। ৫: ১ ভোটে সাজার মেয়াদ বহাল হয়।
বাংলাদেশ সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘সুপ্রিম কোর্ট একটি কোর্ট অব রেকর্ড হইবেন এবং ইহার অবমাননার জন্য তদন্তের আদেশদান বা দণ্ডাদেশদানের ক্ষমতাসহ আইন-সাপেক্ষে অনুরূপ আদালতের সকল ক্ষমতার অধিকারী থাকিবেন।’ এর সরল অর্থ দাঁড়াচ্ছে, আদালত অবমাননার অপরাধের বিচারের এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টকে দেওয়া আছে। সুপ্রিম কোর্ট উভয় বিভাগ নিয়ে গঠিত। এখানে ‘আইন-সাপেক্ষ’ কথাটি গুরুত্বপূর্ণ। সংবিধান সুপ্রিম কোর্টকে বলছে, আপনাকে এই অভিযোগ বিচারের ক্ষমতাটা দিলাম। কিন্তু এর প্রয়োগ করবেন ‘আইনের’ আওতায়। কিন্তু সেই আইন নেই। ১৯২৬ সালের আইনটি সেই আইন নয়। তবে শূন্যতা পূরণ করে চলেছে। আমাদের সুপ্রিম কোর্টের গঠন ভারত ও পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে ঠিক তুলনীয় নয়। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একক সত্তা। এখন আমরা দেখলাম, আদালত অবমাননার বিচার করতে বসে তাঁরা পৃথক সত্তা হলেন। দুটি কোর্ট অব রেকর্ড হিসেবে ধরা দিলেন। তাহলে কি আমাদের দুটি আদালত অবমাননা আইন লাগবে, এবং তাতে দুই ধরনের সাজার বিধান থাকবে? ভারত ও পাকিস্তানের সংসদ একটি করে আইন পাস করেছে।
আইন কমিশন আদালত অবমাননা আইনের যে খসড়া তৈরি করেছিল, সেখানে আপিল বিভাগের জন্য আলাদা কোনো বিধানের ব্যবস্থা রাখেনি। ২০০৮ সালে জরুরি অবস্থার মধ্যে ১৯২৬ সালের আইনটি বিলোপ করা হয়। আদালত অবমাননা-সংক্রান্ত আমরা একটি নতুন অধ্যাদেশ পেয়েছিলাম। সেই অধ্যাদেশেও আমরা আপিল বিভাগের অবমাননার জন্য কোনো স্বতন্ত্র বিধান দেখিনি। তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেলবলেছিলেন, ভুলবশত আপিলবিভাগের কথা বাদ পড়েছে। আপিল বিভাগের বিধিতে কিন্তু আদালত অবমাননা-সংক্রান্ত বিধানাবলি আছে। আমরা বুঝতে চাই, সেখানে দণ্ডাদেশ সম্পর্কে কী বলা আছে? আপিল বিভাগ কেন তাহলে ছয় মাসের জেল দিলেন? সেটা কি ১৯২৬ সালের হাইকোর্টের আইনের অনুসরণ? নাকি তারা একান্ত নিজস্ব বিবেচনায় ছয় মাস নির্দিষ্ট করেছেন? আপিল বিভাগের ১১ বিধিতে লেখা, যে ক্ষেত্রে আদালতের (আপিল বিভাগের) চোখের সামনেই আদালত অবমাননা ঘটবে, সে ক্ষেত্রে দোষী ব্যক্তিকে সংশ্লিষ্ট বিচারক বা চেম্বার জজ বা আদালত ‘আইন অনুযায়ী’ সাজা দেবেন।
সুতরাং হাইকোর্ট এক রকম এবং আপিল বিভাগ ভিন্ন ধরনের সাজা দেবেন? এ ধরনের এখতিয়ার-সংবলিত কোনো ‘আইনের’ অস্তিত্ব আমরা দেখতে পাই না। বরং সংবিধান ও আপিল বিভাগের রুলস আপিল বিভাগকে নির্দিষ্টভাবে ‘আইন অনুযায়ী’ সাজা দিতে বলেছে। সংবিধানের ৩৫(১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘অপরাধের দায়যুক্ত কার্যসংঘটনকালে বলবৎ ছিল, এই রূপ আইন ভঙ্গ করিবার অপরাধ ব্যতীত কোনো ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাইবে না। এবং অপরাধ-সংঘটনকালে বলবৎ সেই আইনবলে যে দণ্ড দেওয়া যাইতে পারিত, তাঁহাকে তাহার অধিক বা তাহা হইতে ভিন্ন দণ্ড দেওয়া যাইবে না।’ মাহমুদুর রহমান কি ‘ভিন্ন দণ্ড’ পেলেন?
পাকিস্তান ও ভারতের আদলে আমরাও বাহাত্তরের সংবিধানে ১০৮ অনুচ্ছেদ ধারণ করতে সচেষ্ট ছিলাম। কিন্তু পরে আমরা তা করিনি। ভারত ও পাকিস্তান থেকে সরে দাঁড়াই। সংবিধানপ্রণেতারা যথার্থই ১০৮ অনুচ্ছেদে ‘আইন-সাপেক্ষে’ কথাটি যুক্ত করেন। অবশ্য পরিহাস হলো, আইনের কথাটি যোগ না করেই ভারত ও পাকিস্তান ১৯২৬ সালের আইন বাতিল করেছে। ১৯৫২ সালের পর ১৯৭১ সালে ভারত এবং ১৯৭৬ সালে পাকিস্তান আদালত অবমাননার নতুন আইন করেছে। আমাদের আইন কমিশনও ছয় মাসের জেল ঠিক রাখে। তারা জরিমানার অঙ্ক দুই হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব করেছিল। উপরন্তু ভারত ও পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট একই আইনের আওতায় পরিচালিত হচ্ছে। আপিল বিভাগ ও হাইকোর্টের জন্য আলাদা আইন নেই। আলাদা দণ্ড নেই। উন্নত বিশ্বের কোথাও আছে বলেও জানা নেই।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ মাহমুদুল ইসলাম তাঁর কনস্টিটিউশনাল ল অব বাংলাদেশ গ্রন্থে হাইকোর্টের এক রায়ের বরাতে বলেছেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের দণ্ড প্রদানের ক্ষমতার প্রয়োগ আইনের দ্বারা হতে পারে।’ আমি মনে করি না যে এই মতটি সংবিধানসম্মত। সঠিক ব্যাখ্যা হলো, এটা অবশ্যই আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। ২০০১ সালে পাল্লো শেঠ বনাম কাস্টোডিয়ান মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একটা কথা সাফ বলেছেন। কথাটি হলো, সাজার পরিমাণটা কী হবে, সেটা নির্ধারণ করে দেওয়া আদালতের ব্যাপার নয়।
এখন প্রশ্ন হলো, আপিল বিভাগ অবমাননা আইন না থাকলে কী হবে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি তর্কিত নজির স্থাপন করেছেন। ২০০৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যের বেঞ্চ আদালত অবমাননার দায়ে ৫০ হাজার রুপি জরিমানা করেন। ২০০৬ সালে জহিরা হাবিবুল্লাহ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের দুই সদস্যের বেঞ্চ বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট কতটা সাজা দেবে, তা ঠিক করে দেবে আইন। সে আইন নেই। তাই অভিযুক্তাকে আদালত অবমাননার (গোধরার দাঙ্গাসংক্রান্ত মামলায় জহিরা মিথ্যা সাক্ষ্য দেন) দায়ে এক বছর জেল ও ৫০ হাজার রুপি জরিমানা অনাদায়ে আরো এক বছর জেল দেওয়া হলো।’ ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের কর্মরত বিচারপতি মারকান্দে কাজু এ নিয়ে নিবন্ধ লিখলেন। তিনি এলাহাবাদ ও দিল্লি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। তিনি এর যথার্থ সমালোচনা করেন। তিনি লিখেছেন, ‘এটা বিস্ময়কর। তাহলে তো সুপ্রিম কোর্ট আদালত অবমাননার দায়ে যে কোনো মেয়াদে সাজা দিতে পারেন! একাত্তরের আইনটি অস্পষ্ট বটে। তাই বলে এমন ব্যাখ্যা চলে না।’
এ পর্যন্ত উচ্চ আদালতের অবমাননার জন্য যত ব্যাখ্যা কিংবা রায় এ দেশের জনগণ জেনেছে, তাতে ১৯২৬ সালের আইনটিই উচ্চারিত হয়েছে। এটি প্রত্যেক ‘কোর্ট অব রেকর্ডের’ জন্য প্রযোজ্য। এটি তাই আপিল বিভাগের জন্যও প্রযোজ্য হওয়া অধিকতর যৌক্তিক। আপিল বিভাগ বলেই তাকে যেকোনো শর্তে দণ্ডদানের অসীম ক্ষমতার অধিকারী ভাবা সংগত নয় বলে মনে করি। ১৯২৬ সালের আইন প্রণয়নের ইতিহাসটাই বলে দেবে বিচারপতি মারকান্দে কাজুর ওই মতামত কতটা যথার্থ। ১৭৭৪ সালের ব্রিটিশ সনদে কলকাতা হাইকোর্টের জন্ম। কলকাতা হাইকোর্টই আমাদের আজকের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের পূর্বসূরি। স্মরণাতীতকাল থেকে হাইকোর্ট তার অবমাননার জন্য শাস্তি দিয়ে আসছেন। এই উপমহাদেশে ১৮৮৩ সালে কলকাতা হাইকোর্টের এক মামলায় প্রথম স্থির হলো, হাইকোর্ট দণ্ড দেবেন। তখনো আইন ছিল না। ১৯০৭ সালে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি হলো। তারা প্রশ্ন তুলল। বলল, হাইকোর্টের স্থানীয় সীমার বাইরের আদালতের অবমাননার বিচার হাইকোর্টগুলো করতে পারেন কি না। শুধু এই সংশয় দূর করাটাই তখন জরুরি ছিল। সে জন্য পাস হলো ১৯২৬ সালের আইন। সেখানে কিন্তু তখনই ছয় মাসের জেল ও জরিমানার বিধান লেখা হলো। তদুপরি ১৯৩৭ সালে লাহোর হাইকোর্ট বললেন, ‘আমাদের হাত ঢের লম্বা। আদালত অবমাননার দায়ে আমরা ছয় মাসের বেশি জেল দিতে পারি।’ এর আগে ১৯১৫ ও ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনেও কিন্তু আদালত অবমাননা-সংক্রান্ত নির্দিষ্ট দণ্ডের বিধান ছিল না। রেওয়াজে ভর করে হাইকোর্টগুলো লঘু শাস্তিই দিতেন। লাহোর হাইকোর্টের ওই আদেশের পর ব্রিটিশ সংসদ হাইকোর্টগুলোর ডানা ছাঁটল। সংশোধনী এল, লেখা হলো, এই সীমার বাইরে যাওয়া চলবে না। আজ পর্যন্ত উপমহাদেশের কোথাও তেমন দাবি ওঠেনি এই শাস্তি অপর্যাপ্ত।
এখন এই অঞ্চলের কোনো কোর্ট অব রেকর্ড যদি বলেন আমাদের আইন নেই। তাহলে আমরা কোথায় যাই? ১৯৩৭ সালের আগ পর্যন্ত বলা হতো ব্রিটিশ কিংস বেঞ্চের মতোই ভারতীয় হাইকোর্টগুলোর ক্ষমতা। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, আমরা এই মুহূর্তে কোথায় দাঁড়ালাম? নতুন দৃষ্টান্ত আমাদের কতটা পেছনে নেবে? ১৬৩১ খ্রিষ্টাব্দের ব্রিটেনের কথা ভাবুন। প্রধান বিচারপতি রিচার্ডসনের দিকে ইট ছোড়া হলো। এতে আদালত অবমাননা ঘটল। তাঁর ডান হাত কাটা হলো। প্রায় চোখের পলকে আদালতের সামনে নির্মিত হলো ফাঁসিকাষ্ঠ। সেখানে প্রকাশ্যে তাঁর ফাঁসি হলো। ১৬৩৪ সাল। জেমস উইলসন একই অপরাধ করলেন। বেঞ্চের দিকে পাথর ছুড়লেন। তাঁর ডান হাত কাটা হলো। সেই কাটা হাত বহু বছর আদালতের প্রবেশপথে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। সেই আদালতের উত্তরাধিকারী বেঞ্চ তিন শ বছর পর ১৮৯৯ সালে বললেন, ‘আদালত কলঙ্কিত’ করার দায়ে ব্রিটেনে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা পরিত্যক্ত হওয়া উচিত। তবে এর দরকার পড়বে সেই সব ঔপনিবেশিক সমাজে, যেখানে গণতন্ত্র পরিপক্ব হয়নি।’ এর ঠিক ১০০ বছর পর ১৯৯৯ সালে আমরা ব্রিটিশ বেঞ্চের আরেকটি রায় পেলাম। আমরা জানলাম, গত ৬০ বছরে ব্রিটেনে কেউ আদালত কলঙ্কিত করার দায়ে সাজা পায়নি। যদিও ব্রিটেনের ১৯৮১ সালের আদালত অবমাননা আইন দুই বছর জেল ও ২৫০০ পাউন্ড জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। তবে এটা কেতাবের গরু হয়ে আছে। ২০১০ সালে বাংলাদেশের একজন পত্রিকা সম্পাদক ‘আদালত কলঙ্কিত’ করার দায়ে উপমহাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সাজা পেলেন। এই দৃষ্টান্তমূলক সাজা আমরা মাথা পেতে নিতে পারি, যদি আমরা জানি যে, সংবাদপত্র মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য দিয়ে উচ্চ আদালতকে পরিকল্পিতভাবে কলঙ্কিত করেছিল।
আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলছিলাম। সেখানেই থাকি। আমরা বাংলাদেশ সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদ ভুলে থাকতে পারি না। ১০৮ অনুচ্ছেদের সঙ্গে এটা মিলিয়ে পড়তে হবে। ১০৩ অনুচ্ছেদ তিনটি ক্ষেত্রে দণ্ডিতের আপিলের সংবিধিবদ্ধ অধিকার নিশ্চিত করেছে। এর অন্যতম আদালত অবমাননা। সুতরাং এর দায়ে হাইকোর্টে কেউ দণ্ডিত হলে আপিল বিভাগকে অবশ্যই আপিল শুনতে হবে। এখন আপিল বিভাগ বিচারিক আদালত হলে তাঁর দেওয়া সাজার বিরুদ্ধে আপিল কে শুনবেন?
দণ্ডিতকে অন্তত একটি আপিলের সুযোগদান আইনের শাসনের অন্যতম মূলমন্ত্র। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীরও আপিলের সুযোগ আছে। আজ বঙ্গবন্ধুর কোনো পলাতক খুনি ধরা পড়লেই তাঁকে ফাঁসি দেওয়া যাবে না। কারণ, একটিবার আপিলের সুযোগ তাঁর প্রাপ্য। ভারতের সংবিধানের সঙ্গে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সংবিধানের একটা পার্থক্য আছে। সেটি হলো ভারতের সংবিধান নির্দিষ্টভাবে আদালত অবমাননা-সংক্রান্ত আপিলের অধিকার দেয়নি। তবে এটা দিয়েছে তাদের আইন। ভারতের ১৯৭১ সালের আইনে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ অবশ্য রাখা হয়নি। সেদিক থেকে পাকিস্তান উন্নত। কারণ আমরা তাদের ২০০৩ সালের আদালত অবমাননা অধ্যাদেশের ১৯ ধারায় দেখি, সুপ্রিম কোর্টের একক বা দুই সদস্যের বেঞ্চের রায়ের বিরুদ্ধে তিন সদস্যের, আর তিন বা ততোধিক বেঞ্চের রায়ের বিরুদ্ধে পাঁচ বা ততোধিক বিচারক নিয়ে গঠিত বেঞ্চের কাছে আন্ত-সুপ্রিম কোর্ট বা আন্ত-আদালত আপিলের একটা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এই ব্যবস্থা বাংলাদেশও হয়তো গ্রহণ করতে পারে। আমার দেশ-এর মামলায় সংশ্লিষ্ট চেম্বার জজ শুনানিতে নাও বসতে পারতেন। তাহলেও পাঁচজন থাকতেন। দুই সদস্যের বেঞ্চ রায় দিতেন। তাঁর বিরুদ্ধে তিন সদস্যের বেঞ্চ আপিল শুনতে পারতেন।
আমার দেশ-এর গত ২১ এপ্রিলের (২০১০) প্রতিবেদনে কথিতমতে অনেক সত্য ঘটনার উল্লেখ আছে। এমনকি তর্কিত প্রতিবেদনে টি এইচ খানের মন্তব্য দেখলাম: ‘হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করে দেওয়াটাই যেন চেম্বার জজ আদালতের মূল কাজ। সরকারের পক্ষ থেকে স্থগিতাদেশ চাওয়া হলেই হলো। অনেকটা মুখ দেখেই চেম্বার জজ আদালতে ইদানীং স্থগিতাদেশ দেওয়া হচ্ছে।’ এই মামলার শুনানিকালে আমরা তাঁকে আপিল বিভাগে হাজির দেখেছি। তাঁর কাছে কিছু জানতে চাওয়া হয়েছে বলে জানি না। এর আগেও চেম্বার আদালতকে স্টার চেম্বারের সঙ্গে তুলনা করার মতো বাকস্বাধীনতার অনুশীলন আমরা দেখেছি।
২০০৬ সালে ভারতের আদালত অবমাননা আইন সংশোধন করা হলো। তাদের ইতিহাসে প্রথম বলা হলো, সত্য প্রকাশে বাধা নেই। ২০০৭ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট মুম্বাইয়ের মিড ডে পত্রিকার কয়েকজন সাংবাদিককে চার মাস করে জেল দিলেন। ওই পত্রিকাটি সাবেক প্রধান বিচারপতি ওয়াই. কে. সাবরওয়ালের সম্পত্তি-সংক্রান্ত অনিয়মের বিষয়ে রিপোর্ট করেছিল। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সত্যাসত্য যাচাইয়ে যাননি। ওই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হতে পারিনি। কী ভাষায় সমালোচনা করা যায়? মোরারজি দেশাই মন্ত্রিসভার জাঁদরেল আইনমন্ত্রী শান্তি ভূষণ। ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে জয়প্রকাশ নারায়ণ ও অরুন্ধতী রায়ের আদালত অবমাননা মামলায় অরুন্ধতীর পক্ষে আইনজীবী ছিলেন। তাঁর মন্তব্য: ‘২০০৬ সালের সংশোধনী মতে, পত্রিকার রিপোর্ট সঠিক বলে প্রমাণিত হলে আদালত অবমাননা ঘটত না। তাই রায় সম্পর্কে বলা চলে, তাদের (সুপ্রিম কোর্টের) একমাত্র লক্ষ্য হলো গণমাধ্যমকে আতঙ্কিত করা এবং সত্যবাদিতার টুঁটি চেপে ধরা।’
আয়ারল্যান্ড সুপ্রিম কোর্টের ১৯৮১ সালের একটি রায় বলেছে, ‘আদালত অবমাননা-সংক্রান্ত শুনানির পয়লা শর্ত হলো তথ্য ও আইনি উভয়বিধ দিক থেকে আনীত অভিযোগ যাচাই করতে হবে।’ আমার দেশ মামলার শুনানিতে আমরা তা দেখলাম না। তাই পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য অপেক্ষায় রইলাম।
আমরা আমাদের আপিল বিভাগকে অত্যন্ত উঁচু আসনেই রাখতে চাই। দণ্ডিত সম্পাদকের দ্বিতীয় মামলার প্রস্তাবিত শুনানি প্রলম্বিত করা যেতে পারে। সচিবদের আদালত অবমাননাসহ বহু পুরোনো অবমাননা মামলা আপিল বিভাগে ঝুলে আছে। ১৯ আগস্টের পূর্ণাঙ্গ রায় দ্রুত পাওয়া দরকার। সেটা পড়ে দণ্ডিতরা তাঁদের কোনো প্রকৃত ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে পারেন কি পারেন না, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু দণ্ডভোগ করার আগেই দোষী সাব্যস্ত হওয়ার বিস্তারিত কারণ জানা তাঁদের অধিকার। তাঁরা দণ্ড পুনর্বিবেচনার সুযোগ পেতে পারেন। এখানে তো অভিযোগকারী নিজেই বিচারক। সুতরাং এখানে অনুকম্পা, মার্জনা ও নমনীয়তা প্রদর্শনের সুযোগ সর্বোচ্চ থাকা প্রত্যাশিত। এবং তেমনটা জনগণের কাছে প্রতীয়মান হওয়া আইনের শাসনের চেতনাসঞ্জাত মনে করি। এই পোড়া দেশে বাক ও সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার বিকাশে উচ্চ আদালতের অসামান্য ভূমিকা পালনের সুযোগ আছে।