আমি যাঁর হাত স্পর্শ করতে রাজি হইনি, সে জামায়াতের বর্তমান আমির : ড. জাফর ইকবাল

অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল |

সবকিছু দেখেশুনে মনে হচ্ছে, সমস্যাটা আমার একান্তই নিজস্ব। অন্য কাউকে এই সমস্যা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে দেখছি না।

বিষয়টা একটু খুলে বলা যাক। একবারে হঠাৎ দেশে একটা নির্বাচন-নির্বাচন ভাব চলে এসেছে। আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের জন্য এটা খুবই ভালো খবর। বুদ্ধিজীবীদের লেখালেখি এবং টেলিভিশনে টকশো করার জন্য সব সময় কিছু বিষয়ের দরকার হয়। দেশে নির্বাচন-নির্বাচন ভাব চলে আসার কারণে বুদ্ধিজীবীরা লেখালেখি করার জন্য নানা রকম বিষয়ের একটা বিশাল বড় সাপ্লাই খুঁজে পেয়েছেন। সরকার, ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং আওয়ামী লীগও এ উপলক্ষে তাদের লেখার নতুন নতুন বিষয় তৈরি করে দিচ্ছে। বুদ্ধিজীবীরা এখন সেই বিষয়গুলো নিয়ে লিখছেন এবং আমি খুবই মনোযোগ দিয়ে পড়ছি।

আমি সব সময় আশা করে থাকি, তাঁরা লেখাগুলো এইভাবে শেষ করবেন- 'আর যাই হোক আমরা আশা করি, এই নির্বাচনে কোনো রাজাকার কিংবা রাজাকারের দল অংশ নিতে পারবে না। যে দলই নির্বাচিত হয়ে আসুক, তারা হবে পুরোপুরি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দল।' কিন্তু এই কথাগুলো কেউ লিখছেন না। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন এবং আমাদের বোঝান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে 'সাম্য'। কিন্তু কেউ এই কথাটা বলেন না- রাজাকার কিংবা রাজাকারের দলকে নিয়ে সেই 'সাম্য' দেশে আনা যাবে না। রাজাকারদের নিয়ে সাম্যের ভেতরে আর যাই থাকুক সেখানে মুক্তিযুদ্ধের ছিটেফোঁটা নেই। কাজেই দেশকে নিয়ে আমরা যা ইচ্ছে স্বপ্ন দেখতে পারি, কিন্তু সবার ঝেড়ে কাশতে হবে। অর্থাৎ আমতা আমতা না করে স্পষ্ট গলায় বলতে হবে- এই দেশে রাজাকারদের কোনো জায়গা নেই। (আমরা যারা ৭১-এর ভেতর দিয়ে এসেছি তারা জানি, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী দলগুলোর মাঝে সবচেয়ে দরিদ্র অশিক্ষিত অনগ্রসর দলটি ছিল রাজাকার। বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী যে কোনো দল কিংবা মানুষ সবাইকে ঢালাওভাবে 'রাজাকার' শব্দটি দিয়ে বোঝানো হয়।)

আমি এক দুই জায়গায় যেখানে এই বুদ্ধিজীবীরা আছেন সেখানে রাজাকার কিংবা রাজাকারদের দল ছাড়া নির্বাচন করার কথাটি বলে দেখেছি। তাঁরা একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়েছেন। কেউ কেউ আমতা আমতা করে বলেছেন, 'জামায়াতে ইসলামী তো নিবন্ধন পায় নাই।' কেউ কেউ বলেছেন, 'এটা সরকারের ব্যাপার। সরকার নিজের স্বার্থে জামায়াতে ইসলামীকে বেআইনি ঘোষণা করছে না।' অনেকেই আমার কথা না শোনার ভান করে এদিক-সেদিক তাকিয়েছেন। বেশিরভাগ সময়েই পত্রপত্রিকায় কলাম লেখা বুদ্ধিজীবীরা আমার বক্তব্যটুকুই ধরতে পারেননি। তাঁরা সবাই জানেন, শুধু ডিসেম্বর মাসে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে হবে। অন্য মাসে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা হচ্ছে নেহাৎ ছেলেমানুষি ব্যাপার। বিশাল জনপ্রিয় কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় এক তরুণ ছাত্র বুকের মাঝে 'আমি রাজাকার' লিখে দাঁড়িয়ে ছিল। সে ছবি

 পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সবাই সেটাকে ব্যক্তিস্বাধীনতা হিসেবে সহজভাবে নিয়েছে। কারও সেটা নিয়ে সমস্যা হতে দেখিনি। গত নির্বাচনে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের লেখক সর্বজনশ্রদ্ধেয় ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন করেছে। সেই নির্বাচনে জামায়েতে ইসলামীর প্রার্থী ধানের শিষ মার্কায় নির্বাচন করেছে; ড. কামাল হোসেন সেটা হতে দিয়েছেন। সেটাও পত্রপত্রিকা এবং তাদের কলাম লেখক সবাই যথেষ্ট উদারভাবে নিয়েছেন। এই বিষয়গুলো চিন্তা করলে আমার রক্ত গরম হয়; কিন্তু দেখি, অন্য কারও সমস্যা হয় না। কাজেই আমার ধারণা হয়েছে, সমস্যাটা মনে হয় একান্তভাবেই আমার নিজস্ব! আমার মতো করে ভাবেন এ রকম আরও মানুষ নিশ্চয়ই আছেন, তাঁরা দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে অপেক্ষা করেন। কিন্তু আমার কাছে যেহেতু কাগজ-কলম আছে; আমাকে চুপ করে অপেক্ষা করতে হবে, কে বলেছে?

প্রথমেই বলে দিই, আমি শুধু ডিসেম্বরে মুক্তিযুদ্ধ- এই ফিলোসফিতে বিশ্বাস করি না। আমি শুধু সারাবছর না; প্রতি নিঃশ্বাসে মুক্তিযুদ্ধ- এই ফিলোসফিতে বিশ্বাস করি। সেই তরুণ বয়সে আমি মাত্র লেখালেখি শুরু করেছিলাম, তখন একজন বয়স্ক লেখক খুবই বিরক্ত হয়ে আমাকে বলেছিলেন, 'তোমার সমস্যাটা কী? যা-ই লেখো, সেখানেই মুক্তিযুদ্ধ ঢুকিয়ে দাও; কারণটা কী?' বলাই বাহুল্য, আমি তাঁকে সদুত্তর দিতে পারিনি। যেহেতু আমার পৃথিবীর বিশাল ক্যানভাস ব্যবহার করে মহৎ সাহিত্য সৃষ্টি করে সাহিত্যজগতে অমর হয়ে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নাই; তাই কিশোর-কিশোরীদের জন্য কিছু লিখতে হলেই আমি কোনো একজন মুক্তিযোদ্ধার গল্প টেনে আনি। সেই গল্পে রাজাকারদের জন্মের মতো শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দিই! সে জন্য কোনো লাভ হয়নি- সেটাও সত্যি না। অনেক কিশোর-কিশোরী আমাকে বলেছে, তারা আমার বই পডে সেই অর্ধ শতাব্দী আগে ঘটে যাওয়া বিস্মৃত মুক্তিযুদ্ধের জন্য এক ধরনের ভালোবাসা অনুভব করেছে। এর চাইতে বেশি তো আমি কিছু চাইনি।
আমি ১৯৯৪ সালে যখন দেশে ফিরে এসেছি তখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের দায়িত্বে ছিল ছাত্রদল। তারা সাহিত্য সপ্তাহের আয়োজন করেছে। সেখানে উপস্থিত বক্তৃতার বেশিরভাগের বিষয়বস্তু ছিল রাজাকারদের জন্য ঘৃণাসূচক। বক্তৃতা চলাকালে সেই বক্তব্য সহ্য করতে না পেরে ইসলামী ছাত্রশিবিরের একজন ছাত্রদলের একজন নেতার পিঠে চাকু মেরে দিল। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন যোগ দিয়েছি। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মকানুন কিছুই জানি না। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে সেই ঘটনার তদন্ত করতে দিল। আমি তদন্ত শুরু করামাত্রই শহর থেকে বিচিত্র চেহারার লোকজন এসে সেই ছাত্রটিকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য সুপারিশ করতে লাগল। এ রকম যে করা যায়, আমিও সেটা জানতাম না। যাই হোক ঘটনা তদন্ত করে আমি শিবিরের ছাত্রটিকে দোষী সাব্যস্ত করে রিপোর্ট দিয়েছি। তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হলো এবং দুই দিন পর খবর পেলাম, সে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় চলে গেছে। কোনো রকম দুর্ভাবনা ছাড়া শিবির যেন শান্তিমতো সন্ত্রাস করতে পারে, সে জন্য জামায়াতে ইসলামী যে এ রকম চমৎকার ব্যবস্থা করে রেখেছে, সেটাও আমি তখন প্রথম জানতে পেরেছি।

যাই হোক, তখন দেশে একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটল। বিএনপির একজন রাজনৈতিক বিশ্নেষক একটা গবেষণা করে সিদ্ধান্তে পৌছালেন, বিএনপি এবং জামায়াত যদি সম্মিলিতভাবে নির্বাচন করে তাহলে তারা খুব সহজে নির্বাচনে জিতে যাবে। আমাদের দেশের একটি পত্রিকা পুরো বাংলাদেশের ম্যাপ এঁকে বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকা দেখিয়ে এবং কোন দলের কত ভোট আছে সেটি বিশ্নেষণ করে একটি সংবাদ পরিবেশন করল। আমি সবিস্ময়ে আবিস্কার করলাম, একদিন ঘোষণা দিয়ে বিএনপি এবং জামায়াত একত্রিত হয়ে গেল।

সবচেয়ে মজার ঘটনাটি আমার তখনও দেখা বাকি ছিল। এক দিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দিয়ে হাঁটছি, তখন দেখি এক সময় যাদের ভেতর সাপে-নেউলে সম্পর্ক ছিল, সেই ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের ছাত্ররা একসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোটামুটি কেন্দ্রীয় এলাকায় দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছে। আমাকে দেখেই তারা আমার বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে শুরু করেছে এবং আমি সবিস্ময়ে দেখলাম, রাজাকারদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়ার জন্য ছাত্রদলের যে নেতাটি শিবিরের হাতে চাকু খেয়েছিল এবং আমি যার জন্য তদন্ত করেছিলাম; আমার বিরুদ্ধে তার গলা সবার ওপরে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এত গৌরবময় যে, শুধু জামায়াতের সঙ্গে একত্রিত হয়েছে বলে রাতারাতি সেই ইতিহাসকে প্রত্যাখ্যান করা খুব সহজ নয়! সবাই পারেনি। একজন দু'জন ছাত্র যারা মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয় দিয়ে ধারণ করেছিল, তারা খুব মন খারাপ করে আমার কাছে এলে আমি সান্ত্বনা দিতাম। এখন তারা কে কেমন আছে কে জানে!

আমি জানি, যাঁরা বিএনপি করেন জামায়াতের সঙ্গে তাঁদের এই আত্মিক বন্ধন নিয়ে সব সময় কিছু একটা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন। এটি শুধু নির্বাচনী জোট; আদর্শিকভাবে তাঁরা আসলে মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেন- এ রকম কথাবার্তা শোনা যায়। কিন্তু আমাকে এই ছেলেমানুষি কথাবার্তা বিশ্বাস করতে হবে- কে বলেছে? আমি এখনও শিউরে উঠে যখন চিন্তা করি- এই দেশে বদর বাহিনীর কমান্ডাররা ক্ষমতায় চলে এসেছিল! বিষয়টি যে নৈতিকভাবে ঠিক আছে- সেটা বোঝানোর জন্য ধানাই-পানাই জাতীয় যুক্তি দেবেন। কিন্তু আমার সেগুলো শোনার ধৈর্য নেই। আমি পরিস্কার জানি- পাকিস্তানি মিলিটারি ১৯৭১ সালে এই দেশে যে গণহত্যা করেছিল; মেয়েদের ধর্ষণ করেছিল; সেই অবিশ্বাস্য নৃশংসতায় জামায়াতে ইসলামী নামক রাজনৈতিক দলটি তাদের সঙ্গে ছিল। এই দেশের নাম যদি বাংলাদেশ হয়ে থাকে এবং দেশটি যদি আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে পেয়ে থাকি, তাহলে এই দেশের মাটিতে জামায়াতে ইসলামীর থাকার অধিকার নেই।

আমি যখন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তখন এক দিন আমেরিকান দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা আমার সঙ্গে দেখা করে তাঁদের একটা অনুষ্ঠানের দাওয়াত দিলেন। সিলেট শহরে সুধী সমাজ এবং রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সেখানে তাঁরা কথাবার্তা বলবেন। অনুরোধের ঢেঁকি গিলতে হয়; তাই আমি ঢেঁকি গেলার জন্য সে অনুষ্ঠানে যাব বলে কথা দিয়েছি। নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময় সেখানে হাজির হয়ে দেখি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীকেও সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমেরিকান দূতাবাসের যে মানুষটি আমাকে আমন্ত্রণ দিয়ে এনেছেন; তিনি পাশে ছিলেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, 'এই অনুষ্ঠানে আপনারা জামায়াতে ইসলামীকে দাওয়াত দিয়েছেন?'
ভদ্রলোক আমতা আমতা করে বললেন, 'সব রাজনৈতিক দলকেই দাওয়াত দেওয়া হয়েছে।' আমি ক্ষিপ্ত হয়ে বললাম,

'আপনি আমাকে চেনেন, আমার সম্পর্কে জানেন; তারপরও আমাকে এখানে ডেকেছেন?' ভদ্রলোক আমতা আমতা করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন। আমি কোনো সুযোগ না দিয়ে অত্যন্ত রূঢ় ভাষায় তাঁকে কিছু একটা বলে অনুষ্ঠান থেকে বের হয়ে যেতে শুরু করলাম। ঠিক তখন দেখতে পেলাম সিলেট শহরের জামায়াতের নেতা হাজির হয়েছেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের হলের নামকরণ শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নামে করার কারণে এই মানুষটি এবং তাঁর দল আমার বাসায় বোমা মারা থেকে শুরু করে অনেকভাবে আমার জীবনের ওপর কম হামলা করেননি। তা ছাড়া বিএনপি-জামায়াতের সম্মিলিত সভায় আমাকে মুরতাদ ঘোষণা দেওয়ার কারণে অনেকেই আমাকে মুরতাদ হিসেবে খুন করে বেহেশতে যাওয়ার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে।

জামায়াত নেতা আমাকে দেখে আমার সামনে দাঁড়িয়ে করমর্দন করার জন্য মুখে হাসি ফুটিয়ে হাত এগিয়ে দিলেন। আমি আমার হাত সরিয়ে বের হয়ে এলাম। পেছন থেকে আমেরিকান দূতাবাসের কর্মকর্তা ছুটে এসে বললেন, 'স্যার, স্যার, ঢাকা থেকে অনেক বড় বড় মানুষ আসছেন। তাঁদেরকে আপনার কথা বলা হয়েছে। আপনি চলে গেলে আমি এখন তাঁদেরকে কী বলব?' আমি বললাম, 'তাদেরকে কী বলবেন, সেটা আপনার ব্যাপার; আমার না।'

আমি জানি, অনেকে আমার এ রকম ব্যবহারকে যথেষ্ট বিচিত্র বলে মনে করবেন। '৭১-এ জামায়াতে ইসলামীর কার্যকলাপের জন্য বর্তমান জামায়াতে ইসলামী বা ছাত্রশিবিরকে দায়ী করতে রাজি হবেন না। 'অতীত ভুলে গিয়ে ভবিষ্যতের মুখের দিকে তাকিয়ে সবাইকে নিয়ে একত্রে বাংলাদেশ গড়ে তুলি'- এ রকম একটা যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। যাঁরা এই যুক্তি বিশ্বাস করতে চান তাঁরা করতে পারেন। কিন্তু আমার পক্ষে সেই যুক্তি মেনে নেওয়া সম্ভব না। আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। যতদিন বেঁচে আছি নিজের হাতে জেনেশুনে কোনো যুদ্ধাপরাধী কিংবা তাদের সংগঠনের কারও হাত স্পর্শ করিনি- এই অনুভূতি নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই।

সিলেটের সে অনুষ্ঠানে আমি যাঁর হাত স্পর্শ করতে রাজি হইনি, সেই মানুষটি বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীর আমির। জঙ্গি কার্যকলাপের জন্য তাঁর ছেলেকে মাসখানেক আগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কয়েক দিন আগে খবর পেয়েছি, একই কারণে সেই মানুষকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

যাঁরা রাজনীতি করেন তাঁরা সব সময় বলেন- রাজনীতিতে নাকি কোনো শেষ কথা নেই। আমি সে কথাটি মানতে রাজি নই। অবশ্যই রাজনীতিতে শেষ কথা আছে; থাকতেই হবে। বাংলাদেশকে এমনি এমনি কেউ হাতে তুলে দেয়নি। ডেইলি টেলিগ্রাফের ভাষায়- রক্ত যদি স্বাধীনতার মূল্য হয়ে থাকে, তাহলে পৃথিবীর আর কোনো দেশ এত মূল্য দিয়ে স্বাধীনতা কিনে আনেনি। সেই বাংলাদেশের রাজনীতির শেষ কথা হচ্ছে- এই দেশে রাজাকাররা রাজনীতি করতে পারবে না। শুধু শেষ কথা নয়; প্রথম কথাটিও তাই।

দেশে প্রায় হঠাৎ নির্বাচন-নির্বাচন আবহাওয়া চলে আসার পর জামায়াতে ইসলামী একটা খাঁটি রাজনৈতিক দলের মতো তাদের নিজেদের দাবিদাওয়া উচ্চারণ করতে শুরু করেছে এবং বেশ কিছু রাজনৈতিক দল খুবই নিরীহ ভঙ্গিতে বলছে, 'গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে তারা যদি অংশ নিতে চায়, তারা নিতেই পারে। এটি তাদের ব্যাপার।' এর পরেই তাদের বলা উচিত, 'তবে এই দলটি হচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের দল। নৈতিকভাবে এই দেশে রাজনীতি দূরে থাকুক; এই দেশে তাদের কোনো ধরনের অস্তিত্ব থাকারই অধিকার নেই।' তবে কোনো রাজনৈতিক দল এ কথা বলছে না। মজার কথা হচ্ছে, প্রগতিশীল বামপন্থি দলগুলোও না। যেহেতু অতীতে আলবদরের কমান্ডাররা এ দেশে মন্ত্রী হয়ে দেশ শাসন পর্যন্ত করেছে; কাজেই এই দেশের রাজনৈতিক দলের কাছে আমি আসলে বড় ধরনের কিছু আশা করি না। সত্যি কথা বলতে কি, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগে যখন জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মী আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দিয়েছে, তখন থেকে এই দেশের রাজনীতি নিয়ে আমার চাওয়া-পাওয়া অনেক কমে গেছে। তবে দেশের মানুষকে কথা দিয়ে সে কথা রেখে এ দেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য আমি শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞ। সত্যি কথা বলতে কি, এই দেশ নিয়ে আমার যে একটি মাত্র শখ অপূর্ণ ছিল, সেটি পূর্ণ হয়েছে। এখন আমার আর কিছু চাওয়ার নেই।

রাজনৈতিক দলের কাছে চাওয়ার কিছু না থাকতে পারে, কিন্তু দেশের বুদ্ধিজীবীদের কাছে অবশ্যই আমার কিছু চাওয়ার আছে। শুধু বুদ্ধিজীবী নয়; পত্রপত্রিকার কাছেও আমার চাওয়ার আছে। প্রধান চাওয়াটি হচ্ছে 'নিরপেক্ষ' শব্দটি নিয়ে। দোহাই আপনাদের, যুদ্ধাপরাধী কিংবা তাদের দলবল এবং অন্য সবাইকে নিয়ে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করবেন না। যখন এই দেশে যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচনের ব্যাপারটি আসবে, তখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ নিন। আমি বুদ্ধিজীবীদের বলব, সরকার কিংবা তাদের দলকে যেভাবে খুশি সমালোচনা করুন; দেশের উন্নতি নিয়ে যেভাবে খুশি তামাশা করতে চান করুন; কারও কাছে বেশি কিছু চাইব না। সবাইকে অনুরোধ করব, তাঁদের লেখা শেষে শুধু একবার পরিস্কার করে লিখবেন- 'এই দেশে সবাই রাজনীতি করবে; শুধু রাজাকারদের রাজনীতি করার অধিকার নেই।'

আমার এখন একটিমাত্র শখ, নির্বাচনের রাতে আমি নাকে তেল দিয়ে ঘুমাব। ঘুম থেকে উঠে দেখব- একটি দল নির্বাচনে জিতে এসেছে। যেটাই জিতুক, সেটাকে নিয়ে আমার কোনো ভাবনা থাকবে না। কারণ এই দেশে সব রাজনৈতিক দলই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে সপক্ষের দল।

এটি কি খুব বেশি কিছু চাওয়া হয়ে গেল? নাকি এটি আমার একটি সমস্যা?

লেখক : অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা - dainik shiksha ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ - dainik shiksha কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.002612829208374