বঞ্চনা ও বৈষম্যের মাঝে যুগের পর যুগ অতিবাহিত হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। বৈষম্যে নিমজ্জিত প্রাথমিক শিক্ষকদের এ যেনো অদৃষ্টের লিখন।
প্রাথমিকের সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ সৃজনের বিষয়টি আজ আশীর্বাদ হয়েও গলার কাঁটা হয়ে পড়েছে। যেখানে দীর্ঘ সময় থেকে প্রাথমিক শিক্ষকরা পদোন্নতি বঞ্চিত। চলতি দায়িত্বের প্রধান শিক্ষকরা পদোন্নতিবিহীন সহকারী শিক্ষকের পদমর্যাদায় ও বেতন স্কেল নিয়ে অবসরে তথা কবরে যাচ্ছেন। সহকারী শিক্ষকরা বৈষম্যের বেড়াজালে ১৩তম গ্রেডের বেতন ভাতা পাচ্ছেন। দীর্ঘ সময় আপিল বিভাগের রায়ের পরও প্রধান শিক্ষকরা দশম গ্রেডের রায়ের আলোর মুখ দেখতে পাচ্ছেন না।
তাদের শুধু নাকে রশি বেঁধে ঘোরাচ্ছে তো ঘোরাচ্ছে । প্রাথমিক শিক্ষক অধিদপ্তর নিয়োগ বিধি ২০২৩ প্রাথমিক শিক্ষক, পিটিআই শিক্ষক ও তৃণমূলের কর্মকর্তাদের পদোন্নতির অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। বর্তমানে সহকারী শিক্ষকরা সকলে দেশ ও জাতির ঘৃণ্য মর্যাদা থার্ড ক্লাস থেকে মুক্তি চায়। তাদের প্রত্যাশা সকল সমযোগ্যতা সম্পন্ন সরকারি কর্মচারীর মত দশম গ্রেড বেতন স্কেল। তাদের চাওয়া আকাশ কুসুম নয়। তারা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো প্রথম শ্রেণির সর্বোচ্চ মর্যাদা দাবি করছেন না। এই প্রত্যশা তাদের ন্যায্য। তবুও বর্তমান ন্যূনতম চাওয়া দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা নিয়ে সবার সঙ্গে এক ও অভিন্ন বেতন স্কেলের ১০ম গ্রেড পেতে চায়। এ ন্যূনতম দাবি বা অধিকার থেকে বঞ্চিত করে প্রাথমিক শিক্ষা হারাচ্ছে জাতির মেধাবীদের। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ০১/০৮/২০২৪ খ্রিস্টাব্দ প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্মারক নং ৩৮০০.০০.০০.০০.৭১৫.০৩২.১৯-১৫৭ মোতাবেক প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের দশম গ্রেড প্রাপ্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬৫ হাজার ৫৬৬ টি পদের পরিবর্তে ৯ হাজার ৫৭২টি সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ সৃজন করার প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়েছিলো। সে প্রস্তাব মোতাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্মতি প্রদান করে ১৬ অক্টোবর প্রজ্ঞাপন জারি করে।
সারাদেশে যখন সহকারী শিক্ষকরা দশম গ্রেড, প্রধান শিক্ষকরা ৯ম গ্রেডসহ শতভাগ পদোন্নতি নীতি নির্ধারণী পর্যায় পর্যন্ত দাবিতে ঐক্যবদ্ধ। সে সময় সহকারী প্রধান শিক্ষক পদটি সৃজন নিয়ে ষড়যন্ত্রের খেলায় মেতে উঠে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
সারাদেশের সব শিক্ষকের ঐক্যবদ্ধ ন্যায্য প্রত্যাশাকে উপেক্ষা করে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ষড়যন্ত্রমূলক সহকারী শিক্ষকের পদটি কাম্য নয়। সহকারী শিক্ষকদের দশম গ্রেড ও প্রধান শিক্ষকদের ৯ম গ্রেডসহ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পর্যন্ত শতভাগ পদন্নোতি চালু করে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদের কার্যক্রম চালু হোক। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ সরকারের আমলে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির পাকশী সমাবেশ থেকে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদটির জন্য আবেদন করেছিলো। তখন শিক্ষক স্বল্পতার দরুণ সারা দেশের প্রাথমিক শিক্ষা বিপর্দস্ত ছিলো। সে প্রেক্ষাপটে নতুন পদের সৃষ্টি সব পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মত সহকারী প্রধান শিক্ষক দাবি করা হয়। সে সময় শিক্ষা মন্ত্রী ছিলেন শেখ শহিদুল ইসলাম। তখন তারই নির্দেশনায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর মহাপরিচালকের সরাসরি অনুমোদনে উপজেলা/থানার শিক্ষকদের সিনিয়র শিক্ষকদের সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো। তৎকালীন শিক্ষা মন্ত্রী শিক্ষকদের ২০ টাকা দায়িত্ব ভাতা প্রদান করার বিষয়টিও অনুমোদন করেছিলেন। কিন্তু বিষয়টি জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতি প্রদানের পূর্বেই ৯০ গণআন্দোলনের মুখে এরশাদ সরকারের পতন হয়। যার ফলে পরবর্তী সরকার সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। অবশেষে স্বয়ং মহাপরিচালক প্রাথমিক শিক্ষা নিয়োগপত্র স্বাক্ষর করার পরও ওই নিয়োগের কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। ৩৭ হাজার সহকারী প্রধান শিক্ষকরা পুনরায় সহকারী শিক্ষক রূপে গণ্য হয়। দীর্ঘ সময় পরে আবার সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ সৃষ্টির পাঁয়তারা করা হচ্ছে। তাও ৯ হাজার ৫৭২ টি। এই পদ সৃষ্টি সহকারী শিক্ষকদের পদোন্নতি সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য নয়। এ হলো সহকারী শিক্ষকদের থার্ড ক্লাস মর্যাদা থেকে বের হতে না দেয়ার ষড়যন্ত্র। সচিব মহোদয় পূর্বেই ১২তম গ্রেডের প্রস্তাব দাখিল করেছেন। তিনি কাজের সঙ্গে মুখের কথা মিল না রেখে প্রতারণা করে যাচ্ছেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সহকারী শিক্ষকদের ২য় শ্রেণির মর্যাদায় ১০ম গ্রেড না হলে সমযোগ্যতা সম্পন্ন মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশার আকর্ষণ হারিয়ে ফেলবে। প্রাথমিক শিক্ষা হয়ে উঠবে মেধাহীনদের নরকরাজ্য। শিক্ষকদের প্রতি আহ্বান, নিজেদের মধ্যে দুরত্ব দূর করুন। মর্যাদার লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকুন।
লেখক: শিক্ষাবিদ