দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক: আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় আসন্ন বাজেটের আকার ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ বাড়ানো হচ্ছে বলে জানা গেছে। একই সঙ্গে প্রবৃদ্ধির সম্ভাব্য লক্ষ্যমাত্রাও ধরা হচ্ছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। প্রবৃদ্ধি অর্জনের গুরুত্ব কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেশি নজর দেয়া হচ্ছে। এছাড়া, বেশ কয়েক মাস মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে থাকলেও আগামী অর্থবছরে গড়ে সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে রাখতে চায় সরকার। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল এবং বাজেট ব্যবস্থাপনা ও সম্পদ কমিটির বৈঠকে গতকাল বৃহস্পতিবার নতুন অর্থবছরের বাজেটের রূপরেখা উপস্থাপন করেন অর্থ সচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদার। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এতে পরিকল্পনামন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এনবিআর চেয়ারম্যানসহ অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ ১০ বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হবে। এগুলো হচ্ছে- বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট বিবেচনায় নিয়ে নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্র্মাণ, প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখা, বাজেট ঘাটতি ধারণা পর্যায়ে রেখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, আমার গ্রাম আমার শহর পরিকল্পনা দ্রুত এগিয়ে নেয়া, সবার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়ানো, ডিজিটাল শিক্ষায় নজর, ফাস্ট-ট্র্যাক অবকাঠামো প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলা করা।
এদিকে, বেশ কিছুদিন ধরেই চাপে রয়েছে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক। এমন পরিস্থিতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে এরই মধ্যে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নেও অনেক ক্ষেত্রে ব্যয় সংকোচনমূলক নীতির পথে হাঁটছে সরকার। যে কারণে চলতি অর্থবছরের তুলনায় বাজেটের আকার বাড়ছে খুব সামান্য। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটের আকার আগের অর্থবছরের তুলনায় বেড়েছিল ১২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাস পর্যন্ত অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো বেশ চাপে থাকায় সরকারের ব্যয়ে বড় ধরনের কাটছাঁট করে সম্প্রতি বাজেট সংশোধন করা হয়েছে। প্রায় ২ বছর ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। মূলস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বাড়ানোসহ সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। এবার একই উদ্দেশ্যে সরকারি ব্যয় কমানো হচ্ছে।
জানা গেছে, নতুন বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৫ লাখ ৩১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে ২ লাখ ৫৭ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ১ লাখ কোটি টাকার বিদেশি ঋণ পাওয়া যাবে বলে আশা করছে সরকার। বাকি ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা দেশের ব্যাংকিং খাতসহ অন্যান্য উৎস থেকে ঋণ নেয়া হবে।
এ ছাড়া বেশ কয়েক মাস মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে থাকলেও আগামী অর্থবছরে গড়ে সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে রাখতে চায় সরকার। একই সঙ্গে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট দেয় সরকার। তবে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় চলতি বাজেট বাস্তবায়নের শুরুতেই টাকা খরচের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ওপর কয়েকটি বিধিনিষেধ দেয়া হয়। এসবের প্রভাবে অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে মোট বাজেটের মাত্র ২৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে সরকারি ব্যয় প্রায় ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ কমানো হয়েছে। যেখানে গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ব্যয় কমানো হয়েছিল মাত্র ২ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
সাবেক অর্থ সচিব ও কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বলেন, বর্তমান পরিস্থিতে সরকারি ব্যয় বাড়ানোর সুযোগ নেই। বিশেষ করে এই মুহূর্তে খুব প্রয়োজন নেই এমন উন্নয়ন প্রকল্প হাতে না নেয়াই উচিত। একই সঙ্গে এসব ব্যয়ে আরো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতির চাপে নি¤œ আয়ের মানুষ খুব কষ্টে আছে। তাই এ শ্রেণির মানুষকে স্বস্তি দিতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যয় বাড়াতে হবে ওএমএস কার্যক্রমে।
তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানবান্ধব বাজেট হওয়া সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক কেন্দ্রীয় নেতা ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বৈশ্বিক সংকট বিবেচনায় নিয়ে ব্যয় সাশ্রয়ী বাজেট প্রণয়ন সময়োপযোগী ও সাহসী পদক্ষেপ। যে ব্যয়গুলো কমানো যায় যেমন- সরকারিভাবে কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর কমিয়ে আনা এবং অপ্রয়োজনীয় বা অপেক্ষাকৃত কম প্রয়োজনীয় প্রকল্প থেকে সরে আসার মতো কর্মসূচি নেয়া। এতে সরকারের খরচ বাঁচবে। অন্যদিকে, ব্যবসাবান্ধব বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। কারণ ব্যবসায়ীরাই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন ও ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বজুড়ে অর্থনীতিতে মন্দা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় আমাদের প্রধান তিন খাত- কৃষি, রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয় বাড়ানোর দিকে সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে।
জানা গেছে, বাজেট প্রণয়নে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বাড়িয়ে দরিদ্রদের কিছুটা স্বস্তি দেয়া এবং রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী করার মাধ্যমে মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল করার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এদিকে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সরকারি ব্যয় কমানো হয়েছে ৬১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। কাটছাঁট শেষে সংশোধিত বাজেটের আকার দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৮৫ কোটি টাকা।
সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে এবং মুদ্রানীতির সঙ্গে সমন্বয় করে সরকারি ব্যয়ে সংকোচনমূলক নীতি নিয়ে বাজেটে বড় ধরনের কাটছাঁট করে অর্থ মন্ত্রণালয়। সংশোধিত বাজেটের আলোকে প্রতিটি মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ও পরিচালন ব্যয় নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।