মনীষী লেখক ও দার্শনিক আহমদ ছফা ভাইয়ের সঙ্গে কোথাও যাওয়ার সুযোগটাই আমার কাছে বড় মনে হতো। আমার ক্লাস কিংবা পত্রিকার অ্যাসাইনমেন্ট থাকলেও তা বাদ দিয়ে হলেও কোথাও যাওয়ার জন্য বললেই রাজি হয়ে যেতাম সানন্দে। রাজধানীর বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কাছে তার বাসা ও শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের দোতলার আড্ডাখানায় অনেকেই আসতেন। তাদের মধ্যে অনেকে ওই সময়েই বিখ্যাত, আবার কেউ কেউ এখন বিখ্যাত।
কিছুদিন পরে মনে হলো, কোথাও কোথাও ছফা ভাই যান, কিন্তু আমাকে নেন না, যাওয়ার আগে বলেনও না, উদ্দেশ্য বললেও সেখানে সঙ্গে যাওয়ার জন্য বলেন না। সেই মানুষদের কাছ থেকে ফিরে এসে ছফা ভাই হয় খুব উচ্ছ্বসিত, না হয় গভীর চিন্তিত থাকতেন। মোটামুটি ব্যাটারি চার্জের মতো ঘটনা। এসে কয়েকদিন ধরে লিখতেন। আমি ডিকটেশন নিতাম। আস্তে আস্তে খোঁজ নিয়ে মোটামুটি যেটা জানলাম তা হলো, জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক স্যার, অধ্যাপক ও লেখক হাসান আজিজুল হক ও মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ নামে একজন পীর—এই তিনজনের কাছে যাওয়ার আগে আমাকে বলতেন না।
এর বাইরেও হয়তো আরো কারো কারো কাছে যাতায়াত ছিলো। কিন্তু সদ্য ঝালকাঠী থেকে আসা টিনএজ আমি তা ঠাওরাতে পারিনি। মোটামুটি বুঝলাম, এই তিনজন সাধারণ মানুষ নন।
আমি ছফা ভাইয়ের কাছে গিয়ে আনন্দ পেতাম। ইত্তেফাকসহ বড় বড় জাতীয় পত্রিকায় ছফা ভাইয়ের লেখার নীচে ‘অনুলিখন: সিদ্দিকুর রহমান খান’ ছাপা হওয়া তখনই আমার কাছে বিশাল-অমূল্য। এখন আরো বেশি। যা হোক, কিছুদিনের মধ্যে আরো বুঝলাম-জানলাম রাজ্জাক স্যার বিশাল ব্যাপার। বিশালত্ব বুঝতে হলে যে পরিমাণ মেধা-যোগ্যতা থাকা দরকার তা আমার নেই।
আরো পড়ুন: কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে
এরই মধ্যে দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকার সাহিত্য পাতায় ধারাবাহিকভাবে রাজ্জাক স্যারকে নিয়ে লেখা শুরু করলেন ছফা ভাই। সেই লেখা পড়ে ও ছফা ভাইয়ের কাছ থেকে শুনে সামান্য বুঝলাম রাজ্জাক স্যার সম্পর্কে। পরে সেই লেখাগুলো একত্র করে ‘যদ্যপি আমার গুরু’ নামে প্রকাশিত হয়। যেটা এখন ছফাকৃত অন্যতম সর্বাধিক প্রচারিত বই।
মনে মনে ঠিক করেছিলাম, ছফা ভাইয়ের কাছে আবদার করবো আমাকে রাজ্জাক স্যারের কাছে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু, সাহস পাই না। এরই মধ্যে আজিজ মার্কেটের আড্ডাখানায় এক সন্ধ্যায় লাঠি ভর দিয়ে সরদার স্যার আসলেন। ছফা ভাই তার চেয়ার থেকে উঠে এগিয়ে গিয়ে সরদার স্যারকে হাতে ধরে বসালেন। সরদার মানে দার্শনিক অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম। ছফা ভাইকে উদ্দেশ্য করে স্যার বললেন, গুরু (রাজ্জাক স্যার অসুস্থ) হাসপাতালে ভর্তি। জানেন? সরদার স্যার চলে যাওয়ার পর ছফা ভাই বললেন, সিদ্দিক কাগজ-কলম নাও। ছফা ভাই বলতে থাকলেন। আমি লিখতে থাকলাম। খুব সম্ভবত আজকের কাগজ অথবা ইত্তেফাকে সেই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিলো। গত ১৫ জুন (২০২২) সরদার স্যারের অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী ছিলো। সেই দিন দৈনিক আমাদের বার্তা ও দৈনিক শিক্ষাডটকম-এ ‘তাঁর হৃদয়ের উত্তাপ তরুণদের স্পর্শ করত’ শিরোনামে লেখাটি পুন:প্রকাশ করেছিলাম।
যা হোক, দুএকদিন পরে ছফা ভাই নিজেই বললেন, সিদ্দিক চলো বারডেমে যাই। যাওয়ার আগে কাকে যেন ফোন করে বললেন- রাজ্জাক স্যার অসুস্থ, বারডেমে এসেছেন।
আমি গেলাম রাজ্জাক স্যারের কাছে। কার কাছে শুনেছি তা এখন মনে নেই। তবে সারমর্ম হলো এই যে, বিদ্বান-পণ্ডিত ও বড় মানুষেরা আগুনের মতো। তাদের কাছে গেলে নিজের মধ্যে যত ছোটত্ব, দীনতা-হীনতা, আগাছা ও উচ্ছিষ্ট আছে সব পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। সব মিলিয়ে আমার নিজেরই উপলব্ধি হলো- আমার কাছে ছফা ভাই যত বিশাল, শ্রদ্ধার ও ভয়ের। ছফা ভাইয়ের কাছে রাজ্জাক স্যার তার চাইতেও অনেক বেশি কিছু। কিন্তু কী কী বেশি তা বোঝার বয়স আমার হয়নি। সুতরাং আর রাজ্জাক স্যারের আড্ডায় যাওয়ার আবদার করা ঠিক হবে না। একইভাবে হাসান আজিজুল হক ও পীর মোহাম্মদ মামুনুর রশীদের কাছেও যাওয়ার আবদার করবো না।
হাসান আজিজুল হক স্যারের অনেক লেখা পড়েছি। লেখা পড়ে যতটুকু না বুঝেছি, তার চাইতে ঢের বেশি জেনেছি ও বুঝেছি ছফা ভাইয়ের কাছ থেকে। রাজ্জাক স্যারও বেঁচে নেই, আজিজুল স্যারও নেই। সম্প্রতি আজিজুল স্যারের মৃত্যুর পর আমাদের সম্পাদিত পত্রিকা দুটোতে তাঁকে নিয়ে বিশেষ লেখা প্রকাশ করেছি। এটাই আপাতত তৃপ্তি।
মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ তখন সরকারি চাকরি করেন। আবার পীর। সরকারি চাকরি করে পীর হয় কেমনে! পীর বলতে তখন পর্যন্ত আমার কাছে শর্ষিণা, ফুরফুরা, চরমোনাই ইত্যাদি। নলছিটিতে আমাদের হাইস্কুল মাঠে চরমোনাই পীরের মাহফিল হতো প্রতিবছর। পীরের পাগড়ি অথবা রুমাল একজন ধরতেন, সেটা ধরতেন আরেকজন, এমন করে রিলেরেসের মতো সবাই সবাইকে ছুঁয়ে কি কি বলে যেন মুরিদ হতেন। পীর সাহেবের খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে উদ্বৃত্ত খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি হতো ভক্ত মুরিদদের মধ্যে। পীরের মাহফিলে হালকা (জিকির) করতে করতে কেউ কেউ তাঁবুর বাঁশ বেয়ে উপরে উঠে যেতেন। ছেলেবেলায় সেগুলো দেখে কেমন যেন লাগতো। এখনও চোখে লেগে আছে।
ঢাকায় এসে ছফা ভাইয়ের কাছ থেকে শুনলাম ও জানলাম সেসব পীরদের সম্পর্কে। পরিষ্কার তথ্য ও ধারণা পেলাম। নিজে শিক্ষা বিষয়ক সাংবাদিকতা করতে গিয়ে তথ্য-প্রমাণ পেলাম- একজন পীর ভুয়া সনদ দিয়ে সাভারের একটা মাদরাসায় চাকরি নিয়ে এমপিওভুক্ত হয়েছিলেন। ধরা পড়ার পর এমপিও বাতিল হলেও পীরগিরি চালিয়ে এমপিও পুনর্বহাল করাতে পেরেছেন।
মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ একজন পীর। সম্ভবত বাংলাদেশে একমাত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা পীর। কবি আসাদ চৌধুরীসহ অনেকেই যেতেন নারায়ণগঞ্জে তার খানকায়। ছফা ভাইও তার কাছে যেতেন। আমাকে কেন নিতেন না তা বুঝিনি। আবদার করায় একবার নিয়ে গিয়েছিলেন তার কাছে। পীর সম্পর্কে স্কুল-জীবনে আমার মনে যে ধারণা জন্মেছিলো, মামুনুর রশীদ তার পুরোটাই উল্টো। স্বাধীন দেশে এই পীর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে অনেক ভালো চাকরি নিতে পারতেন । কিন্তু তার পীরের পরামর্শে পদোন্নতিবিহীন একটা সরকারি চাকরি নিলেন। এই পীর কবিতা লেখেন। আমার কল্যাণ কামনা করে অটোগ্রাফসহ আমাকে তাঁর লেখা একটা কবিতার বই দিয়েছিলেন তিনি। বইটির শিরোনাম ‘ধীর সুর বিলম্বিত ব্যথা’। বইটা এখনও আমার সংগ্রহে আছে।
দু্ই হাজার দুই খ্রিষ্টাব্দের দিকে আমার অফিস ছিলো মতিঝিলে। এসিআই কোম্পানির ইংরেজি পত্রিকা বাংলাদেশে টুডের অফিস। তার ঠিক বিপরীতেই পীর সাহেবের অফিস। কয়েকবার গিয়েছি সেখানে। ছফা ভাই গত হওয়ার পর সুলতান-ছফা পাঠশালা চালানো, ছফা স্মৃতি পরিষদ বানানো ইত্যাদি নানা বিষয়ে তার সঙ্গে আলোচনা হতো।
আরেকটি নতুন ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজে যোগ দেয়ার পরে ব্যস্ততা বাড়লো। আরও কিছু বছর গত হলো। হঠাৎ একদিন পীর মামুনুর রশীদ সাহেবের কথা মনে হলো। এর ওর কাছে খোঁজ করলাম। কিন্তু, তাঁকে আর পাই না। কেউ বলতেও পারেন না, কোথায় তিনি। প্রায় বিশ বছর পর কাকতালীয়ভাবে জানলাম অনেক কিছু। শুনলাম তার তিরোধানের খবর। দিনাজপুরের বিরামপুরের মন্ডল পরিবারে জন্ম নেওয়া মোহাম্মদ মামুনুর রশিদের মুক্তিযোদ্ধা জীবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্নালিজমে পড়াশোনা, কমরেড নির্মল সেনের সঙ্গে প্রগতিশীল রাজনীতি ইত্যাদি নানা নাটকীয়তা ও ঘটনাপ্রবাহে পীর হয়ে ওঠার টুকরো টুকরো গল্প জানলাম।
মোট বারো ভাই-বোন তারা। এক ভাই একজন অধ্যাবসায়ী সাংবাদিক। এখন একটা জাতীয় দৈনিক পত্রিকা ও একটা ডিজিটাল পত্রিকার প্রধান বার্তা সম্পাদক। নাম তার জাকারিয়া মন্ডল।
বাংলাদেশে অনলাইন সাংবাদিকতার জনক ও আমাদের অভিভাবক আলমগীর হোসেনের মাধ্যমে কাকতালীয়ভাবে জাকারিয়া মন্ডলের সঙ্গে পরিচয়। তারপর টানা চারমাস একই সঙ্গে সাংবাদিকতার চড়াই উতরাই পাড়ি দিয়ে চলেছি। একদিন আরও কাকতালীয়ভাবেই জানলাম, মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ এর অনুজ সহোদর তিনি। বিশ বছর ধরে যাকে খুঁজি তার আপন ছোটো ভাই আমার সামনে! তাকেই আবেগে জড়িয়ে ধরলাম। তার কাছ থেকে শুনলাম, সরকারি চাকরি ছেড়ে কম্বোডিয়ায় হিজরত করেছিলেন তিনি। সেখানে খানকা গড়েছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘুরে ঘুরে সভ্যতার নিদর্শন দেখা ছিলো তার স্বভাব।
অসুস্থ অবস্থায় ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে কোলকাতায় ইহলোক ত্যাগ করেন মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ। দেশে এনে তাঁকে সমাধিস্ত করা হয় দিনাজপুর জেলার বিরামপুর পৌর শহরের উত্তরাংশে, একটি কৃষি ভিটায়। যেখানে অনেক আগেই কবরের জমি কিনে রেখেছিলেন তিনি। রোপন করেছিলেন তার পছন্দের বিভিন্ন ফুলের গাছ। তার রোপিত কাঞ্চন গাছে এখন প্রতি মৌসুমে ফুল ফোটে।
পীর মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ এর সমাধিস্থলের পাশে গড়ে ওঠা জনপদটার নাম মামুনাবাদ। প্রয়াত পীরের একমাত্র দূহিতা ঢাকায় থাকেন। তার স্বামী গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতার। এই ক্যাডেট-বুয়েট-বিসিএস ক্যাডার এখন মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ এর আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার বইছেন।
মনীষী, লেখক ও কবি আহমদ ছফা ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জুন চট্টগ্রামের গাছবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ জুলাই ঢাকায় ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরি। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি তার পীর হযরত মোহাম্মদ মামুনুর রশীদকে।
লেখক: সম্পাদক, দৈনিক শিক্ষাডটকম ও প্রধান সম্পাদক, দৈনিক আমাদের বার্তা